টাঙ্গাইলের একসময়ের খরস্রোতা নদী লৌহজং। যা টাঙ্গাইল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। সময়ের বিবর্তনে নদীটি এখন অবৈধ দখলদারদের দখলে। প্রতিনিয়ত পড়ছে দূষণের কবলে। ভরা মৌসুমে ঢেকে আছে কচুরিপানায়। নাব্য হারিয়ে পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীটির বর্তমান চিত্র যেন নীরব কান্না! প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদীটি যেমন অংশীদার ছিল তেমনি শোভাবর্ধন করেছিল জেলা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও।
স্থানীয়রা জানান, লৌহজং নদীটি সদর উপজেলার যুগনী থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার। একসময় শহরের নিরালাড়া মোড় এলাকায় নৌবন্দর ছিল। দেশ-বিদেশ থেকে লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ ও বড় বড় নৌকা বাণিজ্যে আসতো এ নৌবন্দরে। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল এখানে। বর্তমানে এসবের কিছুই নেই। দীর্ঘদিন যাবৎ ড্রেজিং না করায় নদীটি তার নাব্য হারিয়েছে। এই সুযোগে দুই পাড়ের সুবিধাবাদী মহল কৌশলে প্রথমে ময়লা আবর্জনা ফেলে দখল করেছে। পরবর্তীতে স্থায়ী ভবন, দেয়াল ও স্থাপনা নির্মাণ করে নদীটি দখল করেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন কলকারখানা, শহরের সব ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলে দূষিত করা হচ্ছে পানি।
নদীটি দূষণ ও দখলমুক্ত করার জন্য ২০১৬ সালে আন্দোলনে নামে স্থানীয়রা। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর নদীটি দূষণ ও দখলমুক্তকরণ শুরু করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন। শহরের পুলিশ লাইনস হাজরাঘাট এলাকা থেকে বেড়াডোমা পর্যন্ত চার কিলোমিটার দূষণ ও দখলমুক্ত করা হয়। এরপর তিন বছরের মাথায় এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরই ফাঁকে অবৈধ দখল আর দূষণে ফিরে যাচ্ছে আগের রূপে। কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। নদীর স্বাভাবিক গতি হারিয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে নদীটি কচুরিপানায় ভর্তি। পানি থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এতে নদীর দুই পাড়ের পরিবেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। প্রভাব পড়ছে পুরো জীববৈচিত্র্যে। নদীটি দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবি স্থানীয়দের।
এদিকে, ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত সচিব ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক মাহবুব হোসেন।
কাগমারা এলাকার বাসিন্দা বাবু মিয়া বলেন, ‘১৫ বছর আগেও যে নদীতে গোসল ও গৃহস্থালি কাজ করতাম, সেই নদীর পানি বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী। নদীতে মাছ তো দূরের কথা, পানিতে বসবাসকারী কোনও পোকাও থাকে না। নদীটি উদ্ধার কার্যক্রম শুরুর পর দখলমুক্ত হলেও কার্যক্রম না থাকায় আবার নদীর পাড়ের বাসিন্দারা কৌশলে দখলের চেষ্টা করছে।’
শহরের হোমিও চিকিৎসক গোলাম রব্বানী রাসেল বলেন, ‘বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য ফেলে নদীটি বিভিন্নভাবে দূষণ করা হচ্ছে। পানি থেকে পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীটি উদ্ধারে কার্যক্রম শুরু হলেও আবার বন্ধ হয়ে যায়। এটি উদ্ধার হলে টাঙ্গাইল শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়বে। তাই নদীটি উদ্ধারের জোর দাবি জানাচ্ছি।’
নদী, খাল-বিল, জলাশয়, বন ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘লৌহজং নদী উদ্ধারে ২০১৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে অভিযান শুরু হয়। এই নদী উদ্ধারে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম। ওই সময় তিনি আমাদের নদীটি উদ্ধারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এজন্য আমরা আর আন্দোলনে যাইনি। বর্তমানে নদীটি পুনঃখননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে অনুমোদিত হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র বলেন, ‘কয়েক বছর যাবৎ লৌহজং নদীর উদ্ধার কার্যক্রম থমকে আছে। বিষয়টি নিয়ে এনজিও সমন্বয় সভায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ পরিবেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বর্তমানে আইন লঙ্ঘন করে নদী দখল করা হচ্ছে। এ ছাড়াও শহরের বিভিন্ন ড্রেনের লাইন নদীতে দেওয়া আছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও ময়লা আবর্জনাসহ বাসায় টয়লেটের লাইন নদীতে দিয়ে দূষণ করছেন। নদী দখল ও দূষণে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত। যথাযথ আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।’
টাঙ্গাইল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘লৌহজং নদীটি পুনঃখননের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো আছে। অনুমোদন পেলে নদীটি খনন করা হবে। এ ছাড়াও ধলেশ্বরীসহ সংযুক্ত কয়েকটি নদী পুনঃখননের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো আছে।’
জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম বলেন, ‘লৌহজং নদী উদ্ধার কার্যক্রম আগামী জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করা হবে।’