গুগল হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। কিন্তু কীভাবে শুরু হয়েছিল এই গুগলের যাত্রা? কার মাথায় এসেছিল এমন একটা কিছু চালু করার চিন্তা? এর সূচনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র – যারা তখন পিএইচডি করছিলেন। তাদের নাম ল্যারি পেজ আর সের্গেই ব্রিন। এ দু’জনের হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল গুগলের – যা এখন পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কোম্পানি। গুগলের ওই দুই প্রতিষ্ঠাতার সাথে একই সময় স্ট্যানফোর্ডে ছিলেন তামারা মাঞ্জনার – একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী । কীভাবে তার দুই বন্ধু ল্যারি আর সের্গেই ইন্টারনেটের প্রথম যুগে একটা নতুন ধরনের সার্চ ইঞ্জিনের আইডিয়া নিয়ে এসেছিলেন।

বৈপ্লবিক পরিবর্তন

১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি। স্ট্যানফোর্ডের দুজন পোস্ট গ্রেজুয়েট ছাত্রের মাথায় এমন একটা আইডিয়া এলো – যা পরে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল ইন্টারনেটের জগতে।১৯৯৬ সালে পেজ আর ব্রিন একটি থিসিস প্রকল্প শুরু করলেন – কিভাবে ইন্টারনেটে বিভিন্ন পেজ খুঁজে পাবার প্রক্রিয়াটাকে উন্নত করা যায়।

সার্চ ইঞ্জিন গুগল
ছবি : bbc.com(সংগৃহিত)

“সার্চ ইঞ্জিন বলে তখন প্রায় কিছুই ছিল না”

এখন এটা কল্পনা করা মুশকিল, কিন্তু ইন্টারনেটের প্রথম যুগে কোন কিছু খুঁজে পাবার প্রক্রিয়াটা ছিল খুবই বিশৃঙ্খল এবং খুব ঝামেলার। কারণ তখনকার দিনে সার্চ ইঞ্জিন বলে কিছু ছিল না।আজ-কালকার লোকেরা হয়ত বুঝবে না যে তখনকার ইন্টারনেট কেমন ছিল। আসলে আক্ষরিকভাবেই তখন সার্চ বলে কিছু ছিল না। আপনাকে কিছু পেতে হলে হাতে তৈরি ইনডেক্স বা সূচি থেকে কোন কিছু খুঁজে বের করতে হতো।”পেজ আর ব্রিন বুঝতে পারলেন, কেউ যখন কোন ওয়েবপেজ খুজছে তখন সেটা যে শুধু প্রাসঙ্গিক হতে হয় তাই নয়, বরং সেটা আগেকার ব্যবহারকারীদের চোখে মূল্যবান কিনা – তাও দেখা হয়।
যেমন আপনি যখন ‘কিভাবে চকলেট কেক তৈরি করতে হয় বলে সার্চ দিচ্ছেন, আপনি শুধু যে চকলেট কেক কথাটা আছে এমন পেজ খুঁজছেন তাই নয়, আপনি চান সেই পেজটা – যাতে সেরা চকলেট কেক বানানোর পদ্ধতি আছে বলে অন্য লোকেরা রায় দিয়েছে। “

“পেজ র‍্যাংকিং, এ্যালগরিদম – এক নতুন আইডিয়া”

একে বলে পেজ র‍্যাংকিং এবং এটা ছিল একটা নতুন আইডিয়া।একাডেমিক নিবন্ধ যেভাবে অন্যরা পড়ে মূল্যায়ন করেন – তা থেকেই এর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন পেজ আর ব্রিন। কারণ তারা তাদের বাবা-মায়ের কাজ থেকেই এটা জানতেন। আর এজন্য তারা ব্যবহার করেন জটিল এক ধরণের গণিত – যাকে বলা হয় এ্যালগরিদম।”কম্পিউটার কি কাজ করবে এবং কিভাবে কাজ করবে – তাকে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দেয়ার একটা পদ্ধতি হচ্ছে এ্যালগরিদম।”

” পেজর‍্যাংকের মূলে যে চমৎকার আইডিয়াটা কাজ করছে তা হলো – এ ক্ষেত্রে আপনি ওয়েবের গঠনটাকেই ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ অন্য লোক যত বেশি আপনার পেজটির প্রতি আকৃষ্ট হবে ততই আপনার পেজটি শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রধান হয়ে উঠবে।””অসংখ্য রকম নেটওয়ার্ক মিলে যে ইন্টারনেট – তাতে ঠিক কোন্ জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ – তা নির্ধারণের জন্য এখানে ব্যাকলিংক কাঠামোর সুবিধাটা নেয়া হচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করেই পেজর‍্যাংকিং এ্যালগরিদমটা কাজ করছে। ” এই এ্যালগরিদমটা ছিল ব্যাকরাব নামে একটা সার্চ ইঞ্জিনে – এটা পেজ ও ব্রিন চালু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। ব্যাকরাব তখন এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রায়ই চাপ সামলাতে না পেরে স্ট্যানফোর্ডের ইন্টারনেট ক্র্যাশ করতো। এসময়ই এর দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি ও সের্গেই ভাবলেন – কোম্পানিটার একটা নতুন নাম দরকার।

“বানানের ভুলে ‘গুগোল’ হয়ে গেল ‘গুগল'”

ব্যাকরাব তখন এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রায়ই চাপ সামলাতে না পেরে স্ট্যানফোর্ডের ইন্টারনেট ক্র্যাশ করতো। এসময়ই এর দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি ও সের্গেই ভাবলেন – কোম্পানিটার একটা নতুন নাম দরকার। সেজন্য নানা জনের আইডিয়া শোনার জন্য সবাই একটা ‘ব্রেনস্টর্মিং’ সভায় বসলেন। সেই সভা এখন তথ্যপ্রযুক্তিযুগের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। সেখানেই গুগল নামটির প্রস্তাব করা হয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা বোর্ডে লেখা হলো সেই নাম। এটা ছিল Googol – গণিতশাস্ত্রের একটা শব্দ – যার অর্থ ১ এর পিঠে ১০০টা শূন্য। কিন্তু সেটা লিখতে গিয়ে বানানে একটা ভুল হয়ে গেল – হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে, অথবা কে জানে – হয়তো ইচ্ছে করেই। তামারা বলছিলেন, “এটা ছিল তাদের স্বভাবসুলভ দীর্ঘ একটা বৈঠক। আমি জানি – কারণ পরদিন এসে আমিও দেখলাম, সব্বনাশ, এরা তো বানানটা ভুল লিখেছে।” “কারণ আসলে শব্দটা হচ্ছে googol – ‘জি ডবল ও জি ও এল’ – যার মানে হচ্ছে একটা গাণিতিক সংখ্যা, একের পিঠে একশটা শূন্য ‘জি ডবল ও জি এল ই’ নয়। কিন্তু সেটাই টিকে গেল।” ১৯৯৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর গুগল ডট কম ডোমেইন নামটি রেজিস্টার করা হলো। আগস্ট ২০০৪ সালে গুগল তাদের নতুন সদর দফতরে উঠলো – ক্যালিফোর্নিয়ায়। যার নাম গুগলপ্লেক্স।

সার্চ ইঞ্জিন গুগল
ছবি : bbc.com(সংগৃহিত)

“সেই ভুল বানানের ‘গুগল’ এখন একটি বিশেষ্য এবং ক্রিয়াপদ”

গুগল এখন এমনভাবে আমাদের জীবনের অংশ হযে গেছে যে তা একটা বিশেষ্য এবং ক্রিয়াপদে পরিণত হয়েছে। তারা বিজ্ঞাপন থেকে শত শত কোটি ডলার আয় করছে। তাদের বিরুদ্ধে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, বাজারে একচেটিয়া প্রাধান্য কায়েম করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং চীনে তাদের বিরুদ্ধে সেন্সরশিপের অভিযোগও উঠেছে। তামারা মাঞ্জনারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বন্ধূ কি তাদের শুরুর সময়কার নীতিতে অটল থাকতে পেরেছে? “তাদের আদর্শ ছিল তারা যেন অশুভ কিছু হয়ে না ওঠে। তারা ঠিক সেটাই বিশ্বাস করতো। তারা পৃথিবীকে আরো বাসযোগ্য করার জন্য কাজ করেছে। তবে আমি বুঝি যে এত বড় কোম্পানি হয়ে ওঠায় এখন তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ ক্ষমতা এসে গেছে। কিন্তু প্রথম দিকে তারা এটাই চাইতো।” তামারা এখন বিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার কি এখন অনুতাপ হয় এই ভেবে যে কেন তিনি সে সময় গুগল এর সাথে জড়িত হননি, হয়তো তাহলে তিনি একজন বিলিওনিয়ার হয়ে যেতেন? “আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু কিভাবে আমি কাজ করতে চাই তা ঠিক করতে পারিনি। তা ছাড়া আমার চিন্তাভাবনাও তাদের চেয়ে আলাদা ছিল।” “আমার তখন মাথায় ছিল পিএইচডি শেষ করার চিন্তা। আমি ভেবেছিলাম – না না, কোন স্টার্ট-আপে যোগ দিলে আমার পিএইচডি আর শেষ হতো না।”

সার্চ ইঞ্জিন গুগলের কার্যালয়
ছবি : bbc.com(সংগৃহিত)

কিছুটা সংক্ষেপে “তামারা মাঞ্জনারের” বিবিসি কে দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে গুগল এবং সার্চ ইঞ্জিন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং গুগল গড়ে ওঠার কাহিনী জানালাম।

সূত্র : বিবিসি, গণমাধ্যম

Related posts

সার্জারি চলাকালীন হাড় ও ত্বক মেরামতের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন বিজ্ঞানীরা

News Desk

অ‌বিবা‌হিতদের জন্য বাজারে এলো স্ত্রী রোবট (ভিডিও)

News Desk

সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট: জাতিসংঘের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে বাংলাদেশ

News Desk

Leave a Comment