’’আমি গৌরববোধ করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে আমি জীবন দিতে না পারলেও শরীরের পবিত্র রক্ত দিতে পেরেছি৷’’
মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর অবদান সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক, যিনি ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য ব্যতিরেকেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ঢাকা আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। তার পূর্ণ নাম আব্দুল কাদের সিদ্দিকী। তাকে বঙ্গবীর নামেও ডাকা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বাহিনী কাদেরিয়া বাহিনী তার নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
কাদেরিয়া বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে গঠিত একটি সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী। এ বাহিনীর নেতা ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। যুদ্ধকালীন সময়ে এই ক্ষুদ্র অথচ লড়াকু বাহিনীটি সাহসিকতার জন্য স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের কাছে সুপরিচিতি লাভ করে এবং নেতার নামানুসারে কাদেরিয়া বাহিনী নামে খ্যাতি লাভ করে।
আবদুল কাদের সিদ্দিকীর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি উপজেলার ছাতিহাটি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল আলী সিদ্দিকী, মায়ের নাম লতিফা সিদ্দিকী। ১৯৭১ সালে তিনি শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে সামরিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। অধ্যয়নকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন চাকরি করে ১৯৬৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার শিক্ষাজীবনে ফিরে যান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
কাদেরিয়া বাহিনী গঠন
কাদের সিদ্দিকী কোন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না৷ মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁর কোন সামরিক পরিচয়ও ছিল না৷ তবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি৷ সেই কাদের সিদ্দিকী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন লক্ষাধিক যোদ্ধা নিয়ে৷ একাত্তরে ১৮ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আর ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে তৈরি হয় তাঁর বাহিনী, নাম ‘কাদেরিয়া বাহিনী’৷
দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য টাঙ্গাইল অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কাদেরিয়া বাহিনী এক বিস্ময়।১৯৭১ সালের ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা গণ মুক্তি পরিষদের টাঙ্গাইল জেলা ইউনিট গঠিত হয়। তারা স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে এবং তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। অপারেশন সার্চলাইট চালুর পরে, টাঙ্গাইলের স্থানীয় মুক্তি বাহিনী মির্জাপুরের গোরান-সতিয়াচরে টাঙ্গাইলের রাস্তায় অবরোধ স্থাপন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরোধ ভেঙে ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলে প্রবেশ করে। আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে ৫০,০০০ বেসামরিক ব্যক্তি নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন।
১৯৬৭ সালের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আসার পর একটানা এতদিন মাকে ছাড়া থাকেননি কাদের সিদ্দিকী। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও যুদ্ধে যোগদান করেন। কাদের সিদ্দিকী জনতার পক্ষ থেকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে অনুরোধ করেন এবং শপথ পাঠ করানোর সময় বলেন যে, ‘সর্বাধিনায়ক গণপরিষদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হাতের কোরআন ও পতাকা স্পর্শ মুক্তিযোদ্ধা করে শপথ নিন—আপনার জীবন পণ করে এই পতাকা সমুন্নত রাখবেন’।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী শপথ বাক্য উচ্চারণ করলেন, ‘আমি আজ বাঙালি জাতির নামে দেশমাতৃকার নামে পবিত্র কোরআন শরিফ ও বাংলার পতাকা স্পর্শ করে শপথ করছি—গত ২৫ বছর যে মর্যাদায় পাকিস্তানের পতাকাকে সমুন্নত রেখেছি, বাংলাদেশের পতাকাকে তার চাইতে অধিক মর্যাদা দেব। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে এ মর্যাদা রক্ষা করবো। ন্যায়ের সংগ্রামে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ আমাদের ইয়াজিদের মোকাবিলা করার তৌফিক দিন, আমিন।’
কাদেরিয়া বাহিনী বেশ ভালোভাবে সংগঠিত ছিল।
কমান্ডার : কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম।
প্রতিষ্ঠার তারিখ : ২১ এপ্রিল।
প্রথম অভিযান : ২২ মে। (“কালিহাতীর” “চারণ” গ্রামে। সেখানে তিনি এলএমজি চালান।)
মোট সদস্য : ১৭,০০০ জন।
মোট অভিযান : ৭৩ টি, তারা প্রতিটি অভিযানে জয়লাভ করে। তবে কিছু গবেষকের মতে তাদের সংঘর্ষের সংখ্যা ৩০০টি।
অভিযানের এলাকা : টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ এবং জামালপুর জুড়ে প্রায় ১৫,০০০ বর্গমাইল। ( এছাড়া যুদ্ধের শেষের দিকে ঢাকাতে কাদেরিয়া বাহিনী তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করে।)
কাদেরিয়া বাহিনীতে মোট ৯১টি কোম্পানি ছিল। অর্থাৎ, মোটামুটি ১৮৬± যোদ্ধা নিয়ে প্রতিটি কোম্পানি ছিল। আবার কারোর মতে কাদেরিয়া বাহিনীতে মোট ৯৭টি কোম্পানি ছিল । এছাড়া তাদের কিছু বিভাগ ছিল, যথাঃ-
সদরদপ্তর : কোন একটা জঙ্গলের ভিতরে এটা স্থাপন করা হয়েছিল। টাইগার সিদ্দিকীর অনুমতি ছাড়া কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারতো না। বিভাগগুলো টেলিফোনের মাধ্যমে যুক্ত ছিল। এর অধীনে অন্যান্য বিভাগগুলো ছিল। সদরদপ্তরের অধীনে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও ট্রানজিট ক্যাম্প ছিল। সদরদপ্তরের ৫ মাইল সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ছিল।
বেসামরিক দপ্তর : আনোয়ারুল আলম শহীদের অধিনায়কত্বে মহানন্দাপুর বিদ্যালয়ের ভবনে এই বিভাগ গড়ে ওঠে। এই দপ্তরটি সংরক্ষিত এলাকার বাহিরে ছিল, যাতে জনগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। এর অধীনে হিসাব বিভাগের দায়িত্ব পান এনসিও আনোয়ার হোসেন।
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী : প্রাক্তন ছাত্রনেতা সোহরাব আলি খান আরজু এই দায়িত্ব পান।
খাদ্যদপ্তর : করটিয়া কলেজের ছাত্র ওসমান গনি এই দায়িত্ব পান। পূর্বাঞ্চলের মুক্ত এলাকা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা হতো। তার বড় ভাই আলী খাদ্য সংগ্রহে সাহায্য করতেন।
গোয়েন্দা বিভাগ : নুরুন্নবী ও হামিদুল হক এই বিভাগের দায়িত্ব পান। এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল শত্রুর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং নিজ বাহিনীর ভিতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ। প্রত্যেকটা কোম্পানিতে একজনকে গোয়েন্দা হিসেবে গোপনে নিয়োগ করা হতো। শত্রুদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে একটু বয়স্ক লোকদের নিয়োগ করা হতো।
বেতার ও টেলিফোন বিভাগ : এই বিভাগের দায়িত্ব পান আব্দুল আজিজ বাঙ্গাল। বেসামরিক দপ্তর থেকে ১ মাইল দূরে একজন কাঠুরিয়ার বাড়িতে এই দপ্তর স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন থানা থেকে যন্ত্র এনে প্রয়োজন মেটানো হতো। কাঠুরিয়া ব্যাক্তিটি বাবুর্চির দায়িত্ব পান। তারা পাকিস্তানিদের ওয়্যারলেস ইন্টারসেপ্ট করেন। আবার অনেক অপারেটরদের তাদের দলে আনেন, তারা মাঝেমধ্যেই গোপনে তথ্য দিতেন।
সিগনাল বিভাগ : বেতার ও টেলিফোন ছাড়াও বার্তা আদান-প্রদান করার জন্য সিগনাল বিভাগ তৈরি করা হয়। প্রথমে মুসা ও খালেককে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে আনোয়ারুল আলম শহীদ এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বিভাগের লোকজন হেটে, ঘোড়ায় চড়ে, সাইকেলে চড়ে, নৌকা অথবা স্পিডবোটে চড়ে সরাসরি বার্তা প্রেরণ করতেন। এছাড়া প্রতিটি কোম্পানিতে ২জন সিগনালম্যান (সিগনাল মানব) থাকতেন।
জেলখানা : বেসামরিক দপ্তর হতে ১ মাইল দূরে জেলখানা স্থাপন করা হয়। একটা বেশ বড় বাড়িতে জেলখানা স্থাপন করা হয়। মহু নামক একজনকে জেলার বানানো হয় এবং একটি প্লাটুনকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
হাসপাতাল : ময়মনসিংহের ডঃ শাহজাদা চৌধুরীকে হাসপাতালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের নিকটে এই হাসপাতাল খোলা হয়। তিনটি টিনের ঘরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটিতে দুটি কেরোসিনচালিত ফ্যান লাগানো হয়। গোয়েন্দা বিভাগের সাহায্যে ঢাকা থেকে সরঞ্জাম আনা হয়।
সদর দপ্তরের নিরাপত্তার জন্য ১৩নং কোম্পানির ক সেকশন ও কমান্ডার খলিলের কোম্পানির একটি প্লাটুনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া একটি গ্রেনেড পার্টি/ সুইসাইড স্কোয়াড তৈরি করা হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এছাড়াও “রণাঙ্গন” নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হতো।
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা দেশের ভিতরেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাধারণত গেরিলা যুদ্ধ “হিট অ্যান্ড রান” পদ্ধতিতে হয়, তবে কাদেরিয়া বাহিনী “সাডেন হিট, স্টে অ্যান্ড অ্যাডভান্স” নামক পদ্ধতি ব্যবহার করে। টাইগার সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার থেকে জানা তাদের অধিকাংশ যুদ্ধ ছিল সম্মুখযুদ্ধ। তাদের যোগাযোগের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে কুরিয়ার থাকতো, তারা অনেকটা রিলে রেসের মত করে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। নভেম্বর মাস থেকে বেতার ব্যবস্থা চালু হয়।
কাদেরিয়া বাহিনীর মোট ৩১জন সদস্য শহীদ হন। কাদেরিয়া বাহিনীর মোট ১৭জন সদস্যকে বীরত্ব সূচক খেতাব দেওয়া হয় (১ জনকে বীর উত্তম, ২ জনকে বীর বিক্রম এবং ১৪ জনকে বীর প্রতীক।)
তাদের কিছু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের নাম পাথরঘাটা যুদ্ধ, মাকরাই যুদ্ধ, ধলাপাড়া যুদ্ধ ও কাশতার যুদ্ধ। তবে তাদের সবচেয়ে সফল যুদ্ধ ছিল মাটিকাটার অ্যামবুশ (ফাঁদ), যা স্থানীয়ভাবে জাহাজমারার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
জাহাজমারার যুদ্ধ
৫ই আগস্ট, ১৯৭১ সাল। মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর এক ওয়্যারলেস বার্তা ধরে ফেলে। সদরঘাটে কয়েকটি বড় বড় জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে। গন্তব্য বগুড়ার ফুলতলি, তারপর রংপুর। উল্লেখ্য, তখন মুক্তিবাহিনী সীমান্ত সংলগ্ন বিওপিগুলোতে অতর্কিত হামলা শুরু করেছে। সম্ভবত এজন্যই উত্তরের সীমান্তে বাড়তি অস্ত্র পাঠানো। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচর মমতাজ খান চলে যান ঢাকায়। সত্যতা যাচাই করে আসেন। জানা যায়, কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করা এলাকার ভেতর দিয়েই যাবে জাহাজগুলো। মূল লক্ষ্য ইউএসএ ইঞ্জিনিয়ারিং এলসি-৩ এবং এসটি রাজন নামের দুই জাহাজ। শুরু হয় পরিকল্পনা।
১১ তারিখ মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান থেকে সরে একটু পেছনে অবস্থান নেয়। একটু পরে এসেই একজন খবর দেয় যে, জাহাজগুলো উত্তরে যাত্রা শুরু করেছে, অর্থাৎ তাদের সামনেই আসছে। সকাল ৯টায় আবার জাহাজ থেমে যায়। নদীতে ডুবোচর থাকতে পারে এবং সেখানে বড় জাহাজটি আটকে যেতে পারে। এই আশংকা থেকে ছোট একটি জাহাজ আগে যেতে শুরু করে। একপর্যায়ে এটি মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। সারাদিন বাকি জাহাজগুলো থেকে থাকে।
পরেরদিন জাহাজগুলো আবার চলতে শুরু করে। প্রথমে ছোট দুটি জাহাজ ঠিক মুক্তিবাহিনীর সামনে দিয়ে চলে গেল, কিন্তু কমান্ডার গুলি চালালেন না। এবার বহরের বড় দুটি জাহাজ মেশিনগানের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে।
৩ দিন ধরে পজিশন নিয়ে থাকা মুক্তিবাহিনী তাদের নীরবতা ভাঙলো। কাদেরিয়া বাহিনী একঝাঁক বুলেট দিয়ে স্বাগত জানালো জাহাজ দুটিকে। পেছনে থাকা দুটি জাহাজ তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউলের নিখুঁত নিশানায় ১২টি মর্টার নিখুঁতভাবে দুই জাহাজের ব্রিজে আঘাত করে। তিনি। ডানপাশে ছিলেন মঞ্জু, প্রায় কুড়িটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেন তিনি। তবে জাহাজের পুরু লোহার কাছে মর্টার ছিল সামান্য টোকা। এই ক্ষতি নিয়ে দুই জাহাজ অনায়াসেই পালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীনভাবে জাহাজদুটো সামনের চরে গিয়ে আটকে যায়
কিছুক্ষণ গুলি চলতে থাকে। ৩ জন শহীদ হন। ২০-২৫ জন পাক সেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে গুলি বন্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজের দখল নেয়। বন্দী করা হয় সবাইকে।
মুক্তিযোদ্ধারা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, গোলাবারুদের অভাবে ঠিকমতো যুদ্ধ করতে পারছে না সেই আধুনিক অস্ত্র ও গোলা-বারুদে ঠাসা জাহাজটি। অন্যটি ছিল তেলের ট্যাংকার, যাতে ১ লাখ ৮০ হাজার গ্যালন ডিজেল ছিল। অস্ত্র ছাড়াও জাহাজের রান্নাঘর ভর্তি মুরগির মাংস এবং প্রচুর উপাদেয় খাদ্যও ছিলো।
নাগপুরের যুদ্ধ
১৭ অক্টোবর তিনি নাগপুরে অভিযান চালান। ৩০ নভেম্বর তিনিসহ প্রায় ২৫০জন মুক্তিযোদ্ধা ১২৩০ ঘটিকায় নাগপুর থানা সদরে আক্রমণ করেন। সেখানে মাত্র ৬৫ জন মিলিশিয়া ছিল। কাদেরিয়া বাহিনী ১৯টি এলএমজি ২টা ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২ টা ২.৫ ইঞ্চি মর্টার, ৭/৮টা ২ ইঞ্চি মর্টার এবং ৪টা গ্রেনেড লঞ্চার এবং অটোমেটিক অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেন। কিন্তু থানাটির বিদঘুটে অবস্থানের কারণে কাদেরিয়া বাহিনীর কোন কভার ছিল না। তিনি কোন এক ধরণের রকেট লঞ্চার ব্যবহার করতে গিয়ে সামান্য আহত হন।
আহত সিদ্দিকী
কাদের সিদ্দিকী’র এই গেরিলা বাহিনী যুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল অঞ্চলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল৷ পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে যেসব এলাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি, তারই একটি টাঙ্গাইল৷ এই অকুতোভয় সেনা ভূয়াপুরের কাছে মাকরাই’র যুদ্ধে আহত হন৷ এখনও সেসময়ের কথা পরিষ্কার মনে করতে পারেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এই যুদ্ধে একদিকে পাকিস্তানিরা ছিল, অন্যদিকে আমরা৷ তিন দিন ধরে যুদ্ধ হয়েছে৷ আমার গায়ে গুলি লাগে ১৬ই আগস্ট৷ আমার হাতে এবং পায়ে গুলি লাগে৷ এবং আমি গৌরববোধ করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে আমি জীবন দিতে না পারলেও শরীরের পবিত্র রক্ত দিতে পেরেছি৷’’
বাঘা সিদ্দিকী
যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েও দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না বাঘা সিদ্দিকী৷ বরং ভারতের সীমান্তে চিকিৎসা নিয়েই ফিরে আসেন আবার রণক্ষেত্রে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আহত হওয়ার পরে আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি কোন কারণে অচল হয়ে যাই, তাহলে ওরা আমাকে বন্দি করতে পারে৷ বন্দি করলে হত্যা করতে পারে৷ সেজন্য আমি চিকিৎসা করতে ভারতের সীমান্তে গিয়েছিলাম৷ যেতে লেগেছিল সাতদিন, ছিলাম সাতদিন, চারদিন পর আমি আবার যুদ্ধে ফিরে আসি৷’’
জনসমর্থন
কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে বহু গেরিলা যুদ্ধে জয়লাভ করে৷ রণক্ষেত্রের সাফল্য দিয়েই সাধারণ মানুষের মন জয় করে নেয় এই বাহিনী৷ পেতে থাকে মানুষের আস্থা, বাড়ে গ্রহণযোগ্যতা৷ কাদের সিদ্দিকী এই জনসমর্থনকেই গুরুত্ব দেন সবচেয়ে বেশি৷ তিনি বলেন, ‘‘১২ই মে বল্লার যুদ্ধের আগে মানুষ মনে করতো আমরা বক্তৃতা করতে পারি৷ কিন্তু আমরা যুদ্ধ করতে পারবো না৷ কিন্তু সেই যুদ্ধে জয়ের পর আমরা যখন পাচঁজন হানাদারের লাশ বল্লা হাইস্কুলের মাঠে এনে রাখি, তখন হাজার হাজার মানুষ এসে তাদের দেখেছে এবং বলেছে যে, আমাদের এই ছোট ছোট ছেলেরাও যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের হারাতে পারে৷’’
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে কাদের সিদ্দিকী
একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ২ হাজার ভারতীয় সৈন্য টাঙ্গাইলে অবতরণ করে। তারা কাদেরিয়া বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। উভয় বাহিনী মিলে টাঙ্গাইলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে মুক্তি করে। নতুন টাঙ্গাইল শহরটি পাকিস্তানের সর্বশেষ দুর্গ ছিল। টাঙ্গাইল ১১ ই ডিসেম্বর মুক্ত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে কাদেরিয়া বাহিনী ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে ঢাকায় প্রবেশ করে।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য বীর উত্তম উপাধি লাভ করেন কাদের সিদ্দিকী৷ ‘বঙ্গবীর’ নামেও পরিচিত তিনি ৷
স্বাধীনতার পর টাইগার সিদ্দিকী সাংবাদিকদের ডেকে এনে কিছু বিশ্বাসঘাতকদের বেয়নেট দিয়ে মারেন। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই ঘটনা অনেক প্রচার পায়।ইংরেজি কোরাতে “পাইক্কারা” বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেখার সময় মাঝে মধ্যেই ঐসব চিত্র ব্যবহার করে।
এছাড়া পাকিস্তানের আত্নসমর্পনের পরে মুক্তিবাহিনীর কিছু স্নাইপার কিছু পাকিস্তানিকে গুলি করে, এই স্নাইপাররা সম্ভবত কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরেও শেখ মুজিব পাকিস্তানে ছিলেন। তাকে সামরিক ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিল। কাদের সিদ্দিক ঘোষণা দেন যে মুজিব ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি এবং তাঁর ৫০ হাজার লোক আত্মসমর্পণ করবেন না। ১৯৭২ সালে মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে আসলে, কাদের এবং তার লোকেরা টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে মুজিবের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল।
তথ্যসূত্র :
১. বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১
২.১৯৭১ শত্রু মিত্রের কলমে
৩. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; আবু ওসমান চৌধুরী
৪. একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)
৫. মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই; সেজান মাহমুদ
৬. মার্জিয়া লিপি, ২০১৯, ‘ একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা’
৭. যুদ্ধগাথা
৮. Liberation Bangladesh 1971
৯. ১৯৭১ প্রতিরোধ সংগ্রাম বিজয়
১০. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ৯ম খণ্ড