প্রতিদিন সন্ধ্যা নামতেই নদীর বুকজুড়ে জ্বলে ওঠে লাল, নীল, সবুজ ও হলুদ আলো। নানা রঙের আলোতে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় চিত্র ফুটে ওঠে। দূর থেকে দেখে যে কারও মনে হয়, যেন এক টুকরো শহর।
নদীতে জ্বলে ওঠা এসব আলো মূলত মাছ ধরার ট্রলারের রঙিন বাতির ঝলকানি। সন্ধ্যা হলেই নদীতে যেন বসে তারার মেলা। কাছাকাছি গেলে শোনা যায়, জেলেদের কোলাহল, জালের শব্দ আর ইঞ্জিনের গর্জন। সবমিলিয়ে নদীটি যেন পরিণত হয় শ্রম, আশা আর সংগ্রামের প্রতীকে। সন্ধ্যার পর মনভোলানো এই সৌন্দর্য আকর্ষণ করে যে কাউকে। তাই নানা বয়সের মানুষ ছুটে আসেন দেখতে। এটি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত খাপড়াভাঙ্গা নদীর প্রতিদিন সন্ধ্যার চিত্র। এই আলো স্থায়ী হয় ভোর পর্যন্ত।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদীর দুই তীরে অবস্থিত মহিপুর-আলীপুর মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারগুলো বৈরী আবহাওয়া বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে দ্রুত এসে আশ্রয় নেয় এই নদীতে। ফলে নদীটি জেলেদের কাছে পোতাশ্রয় নামেও পরিচিতি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব ট্রলার নদীর বুকে ভেসে থাকায় এক টুকরো শহরের মতো দেখায়। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে নানা রঙের বাতির আলো। অন্যরকম দেখায় নদীর বুক। খাপড়াভাঙ্গা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ এ দৃশ্য দেখতে আসেন প্রতিদিন সন্ধ্যায়। অনেকে মোবাইলে ভিডিও ও সেলফি তুলে ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ধীরে ধীরে স্থানীয়দের কাছে এটি এখন বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রাজিব হাওলাদার বলেন, ‘এখন সন্ধ্যা নামলেই মনে হয় নদীর মাঝখানে একটা শহর জেগে উঠেছে। বাতিগুলোর ঝলকানি নদীকে অন্যরকম রূপ দিয়েছে। বহু মানুষ এই দৃশ্য দেখতে আসছেন।’
খাপড়াভাঙ্গা সেতুতে ঘুরতে আসা মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে শুধু এ দৃশ্য দেখার জন্য এখানে এসেছি। সত্যি অসাধারণ লাগছে।’
বরিশাল থেকে আসা পর্যটক মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘এই দৃশ্য অসাধারণ। দেখে মনে হয় নদীর মধ্যে আলোকসজ্জিত শহর ভাসছে।’
প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে ফুচকা বিক্রি করেন স্থানীয় বাসিন্দা জসিম মোল্লা। তিনি বলেন, ‘আগে শুধু ট্রলার ভিড়তো। এখন সন্ধ্যা নামলেই মানুষ ঘুরতে আসে। আমাদের বেচাকেনা ভালো হচ্ছে।’
কুয়াকাটা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি কাজী সাঈদ জানিয়েছেন, আলীপুর-মহিপুর মৎস্যবন্দর, খাপড়াভাঙ্গা নদীটি চমৎকার একটি পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে। নদীতে কিছু প্রমোদতরিও ছাড়া যায়। যাতে পর্যটকরা নদীর দুই মাথার আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ মোহনায় যেতে পারেন। সৌন্দর্য বাড়াতে দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ছাতা ও বেঞ্চ বসানোর ব্যবস্থা করতে পারলে আকর্ষণ আরও বাড়বে। পাশাপাশি নদীর পাড়ে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় স্টল করে সকাল-সন্ধ্যা মাছের দোকান বসালে পর্যটকরা তাজা মাছ কেনার পাশাপাশি সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সম্পর্কে জানতে পারবেন। উপজেলা প্রশাসন পরিকল্পনার মাধ্যমে খাপড়াভাঙ্গা নদীর সৌন্দর্য আরও বাড়াতে পারলে সাগরকন্যা কুয়াকাটা পাবে আরেকটি দর্শনীয় স্থান।
এ ব্যাপারে কলাপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইয়াসিন সাদেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খাপড়াভাঙ্গা সেতুর দুই পাশে সন্ধ্যার পরের দৃশ্য মনোরম। এটি আগত পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন প্রজাতির খাবার নিয়ে ভাসমান দোকান আকারে করলে পর্যটকরা এই স্পটে আসবেন। পাশাপাশি ট্রলারের মাধ্যমে নদীর মোহনাগুলো ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করা হলে এটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো।’