বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুর। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দ্বীপচর নারায়ণপুরের বুক চিরে স্বাভাবিক রূপেই বয়ে চলছিল ব্রহ্মপুত্র। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় চারপাশ শান্ত, স্বাভাবিক। স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির অদূরে বয়ে চলা নদে গোসলে যায় ৫ শিশু। আকস্মিক বিরূপ আবহাওয়ায় শুরু হয় ঝোড়ো বাতাস। নদে ওঠা আগ্রাসী ঢেউ সামলে একজন তীরে উঠলেও ভেসে যায় বাকিরা। দিনের বাকি অংশে স্থানীয়রা নদে তল্লাশি চালিয়েও উদ্ধার করতে পারেনি নিখোঁজদের।
একদিন পর বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) কয়েক কিলোমিটার দূরে পৃথক পৃথক স্থানে ৩ শিশুর ভাসমান লাশ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সকালে মেলে আরেক শিশুর লাশ। শিশুদের লাশ গ্রামে ফিরলে একসঙ্গে লাগোয়া বাঘমারা আর অষ্টাশির চর গ্রামে শুরু হয় স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ। খেলার সাথি যে শিশুরা একসঙ্গে স্কুল থেকে ফিরে গিয়েছিল গোসলে। গ্রামের একই কবরস্থানে পাশাপাশি সমাহিত হয় তারা। ফুটফুটে প্রাণোচ্ছল শিশুদের হারিয়ে গ্রামজুড়ে এখন শোকের আবহ।
ব্রহ্মপুত্রে গোসলে গিয়ে মারা যাওয়া শিশুরা হলো বাঘমারা গ্রামের আলম মিয়ার ছেলে জুয়েল (৭), অষ্টাশির চর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে নাজমুল হোসেন (৭), আহাদ আলীর মেয়ে আঁখি খাতুন (৯) ও ছেলে আতিক হোসেন (৭)। বুধবার নদের পানিতে ভেসে যাওয়ার পর গত দুই দিনে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে পৃথক পৃথক স্থানে তাদের ভাসমান মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা।
বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে নাগেশ্বরীর কচাকাটা থানা এলাকায় আতিক হোসেনের ভাসমান লাশ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। পরে আরও ভাটিতে উলিপুর এলাকায় নাজমুল এবং চিলমারীর রানীগঞ্জ ইউনিয়ন এলাকায় জুয়েলের লাশ ব্রহ্মপুত্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয়রা। স্রোতে ভেসে যাওয়ায় লাশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্থানে উদ্ধার হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বুধবার চার শিশু নদে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তাদের পরিবারের পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝে উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি হয়। ওইদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকা ও জাল দিয়ে অনুসন্ধান করেও খোঁজ না মেলায় সকালের অপেক্ষা করতে থাকে স্থানীয়রা। পরে বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে শিশু আতিক হোসেনের ভাসমান লাশ উদ্ধার হয়। কিছু সময় পর দুপুরের দিকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে উলিপুর এলাকায় নাজুমল এবং চিলমারীর এলাকায় জুয়েলের লাশ উদ্ধার হয়। পরে তাদের লাশ গ্রামে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয়।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন শিশুর লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ আঁখির কোনও সন্ধান মেলেনি। শুক্রবার সকালে উলিপুর উপজেলার সীমানা পেরিয়ে চিলমারী উপজেলা এলাকায় নদের পানিতে ভাসমান অবস্থায় আঁখির মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে স্বজনরা লাশ গ্রামে নিয়ে একই কবরস্থানে দাফন করে। একসঙ্গে গোসলে যাওয়া চার শিশু গ্রামের একই কবরস্থানে সমাহিত হয়।
মারা যাওয়া শিশু জুয়েলের চাচাতো ভাই আলাল উদ্দিন বলেন, ‘আতিক ও আঁখি আপন ভাইবোন। নাজমুল তাদের চাচাতো ভাই। আর জুয়েল তাদের প্রতিবেশী। তারা আগে এভাবে নদীতে গোসলে যায়নি। সেদিন পরিবারের অজান্তে নদীতে নামে। একসঙ্গে গোসলে গিয়ে একসঙ্গেই সমাহিত হলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের দিনমজুর আহাদ আলীর ছেলে-মেয়ে আতিক ও আঁখি। তার আর কোনও সন্তান নেই। মারা যাওয়া শিশুদের বাবা-মা ও পরিবারের লোকজনের কারও কথা বলার মতো অবস্থা নেই। তারা পাগলপ্রায়। শিশুদের বাবা ও মা সবাই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তারা কেউই সুস্থ ও স্বাভাবিক নেই। গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া বিরাজ করছে।’
‘আমারও অন্তর ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে শক্ত থাকতে হচ্ছে। আমার শিক্ষক আমাকে শিখিয়েছেন, পরিবারের সবাই ভেঙে পড়লে বাকিদের সামলাবে কে! এজন্য আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সব তদারকি করছি। কিন্তু মারা যাওয়া শিশুদের বাবা-মা কেউই কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তারা মাতম করে কখনও কখনও জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন।’ সন্তান হারানো পরিবারের অবস্থা জানাতে গিয়ে বলেন আলাল উদ্দিন।
‘বৃহস্পতিবার সকালে আতিকের লাশ পাওয়ার পর ওই দিন বেলা ১১টার দিকে তাকে নারায়ণপুরের পুরাতন বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়। দুপুরে বাকি দুজনের লাশ পাওয়া যায়। তাদের আছরের সময় একই কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার আঁখির লাশ পাওয়ার পর জুমার নামাজের আগে তাকেও একই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বাচ্চাদের এমন মৃত্যুতে এলাকায় সবাই শোকাহত।’
কচাকাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিশ্বদেব রায় বলেন, ‘দুই দিনে চার শিশুর ভাসমান মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাদের গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।’