প্রত্ননিদর্শন অবহেলায় রেখে সংস্কার শুরু বরেন্দ্র জাদুঘরের
বাংলাদেশ

প্রত্ননিদর্শন অবহেলায় রেখে সংস্কার শুরু বরেন্দ্র জাদুঘরের

দীর্ঘ সময় পর হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের গ্যালারির সংস্কারের কাজ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্যালারিগুলোকে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হবে। তবে অযত্ন ও অবহেলায় প্রত্ননিদর্শনগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখায় এগুলোর কারুকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত এই জাদুঘরে ১৭ হাজার প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। কিন্তু মাত্র ১ হাজার ১০০টি নিদর্শন ও ৪৭টি প্রত্নবস্তু গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাকি নিদর্শনগুলো গ্যালারি সংকটের কারণে প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। আর ছয় লাখ টাকার এই সংস্কারকাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে করা হচ্ছে।

মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন থাকায় এখানে ভিডিও ধারণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। তবে গত ২৩ আগস্ট গ্যালারি মেরামতের ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, সংস্কারকাজ করার জন্য প্রত্ননিদর্শনগুলো বারান্দার গ্যালারি থেকে নামিয়ে নিচে রাখা হয়েছে। এগুলো মেঝেতে ফেলেই নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। দেয়াল চটানোর সময় সব ধুলা প্রত্ননিদর্শনের গায়ে পড়ছিল। বারান্দায় টাইলস লাগানোর কাজ চলছে। বারান্দার গ্যালারি থেকে কিছু প্রত্ননিদর্শন সিঁড়ির নিচে রেখে দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ প্রত্ননিদর্শন ওই বারান্দায় রাখা হয়েছে। নীল রঙের পলিথিন দিয়ে মুড়ে মেঝেতেই ফেলে রাখা হয়েছে। কোনোটাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কোনোটাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আশপাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি, টাইলস লাগানো ও দেয়াল ঘষাঘষির কাজ।

জানতে চাইলে জাদুঘরের ডেপুটি চিফ কনজারভেশন অফিসার মো. ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, প্রত্ননিদর্শনগুলো সরিয়ে অন্য কোথাও রাখার জায়গা নেই। এ ছাড়া একেকটি মূর্তির অনেক ওজন। এগুলো সরাতে গেলে যদি এর কোনও একটি কারুকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটি আর ফেরত পাওয়া যাবে না। যেগুলো সহজে সরানো যায়, সেগুলো বারান্দা থেকে নিয়ে তারা সিঁড়ির নিচে রেখে দিয়েছে। সংস্কারকাজ শেষ হলে আবার প্রতিস্থাপন করা হবে। আর এটা নিয়মিত সংস্কারকাজের অংশ। নতুন করে কোনও গ্যালারি বাড়ছে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের সংস্কারকাজ করার সময় জাদুঘরের সংশ্লিষ্ট গ্যালারি দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। এর নানামুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অন্যদিকে ভারী মূর্তিগুলো সরানো সহজ নয়। এগুলো সরাতে গেলে যদি কোনও ক্ষতি হয়, সেটা অপূরণীয় ক্ষতি হবে। কারণ, টাকা দিয়ে এর মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এগুলো অমূল্য সম্পদ। তাই যত্নসহকারে মোটা চট দিয়ে ঢেকে রেখে সংস্কারকাজ করা উচিত। তা ছাড়া দেয়াল চটানোর সময় ইটপাথরের টুকরা পড়েও এর ক্ষতি হতে পারে। সাবধানতার সঙ্গে কাজ করা দরকার।

পৃথিবীর কোনও জাদুঘরেই সব নিদর্শন গ্যালারিতে দেওয়া থাকে না জানিয়ে আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, পর্যায়ক্রমে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। এটা সংগ্রহশালা, তাই এটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে হয়। তাই বলে আরেকটি জাদুঘর বানানোর দরকার পড়ে না। যত্নে রাখলে এসব জিনিসও ভালো থাকবে। প্রত্ননিদর্শন অবহেলায় রেখে সংস্কার শুরু বরেন্দ্র জাদুঘরের
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এখন থেকে শুক্রবারও সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। তবে বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত নামাজ ও মধ্যাহ্নবিরতি থাকবে। গত ৩০ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

প্রসঙ্গত, রবি থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা ও দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি থাকে। শনিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে।

বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থল হাতেম খান মহল্লায় অবস্থিত। বঙ্গীয় শিল্পকলার অপূর্ব সমাহারে সমৃদ্ধ এই সংগ্রহশালাটি রাজশাহী তথা বাংলাদেশের গর্ব ও অহংকার।

বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজন্যরা, সমসাময়িক জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিতরা এখানকার নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৮৬০ সালের ভারতীয় সমিতি আইন অনুযায়ী, ১৯১৪ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নিবন্ধন লাভ করে। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকেই শিল্পকলার একাধিক ঘরানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে গান্ধারা, সারনাথ, মথুরা, মগধ এবং বরেন্দ্র ঘরানা। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর বরেন্দ্র ঘরানাকে প্রতিনিধিত্ব করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের যশস্বী ভাস্কর ধীমান ও তার ছেলে বীতপালের নেতৃত্বে পাল আমলে এই অঞ্চলের বিশেষ ঘরানার প্রতিনিধিত্বশীল ভাস্কর শিল্পের একটি বিদ্যালয় ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চলের উদ্ধার করা সিংহভাগ ভাস্কর্য এই বিদ্যালয় থেকে সৃষ্ট। প্রত্ননিদর্শন অবহেলায় রেখে সংস্কার শুরু বরেন্দ্র জাদুঘরের

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে প্রদর্শিত সুষমামণ্ডিত শত শত মূর্তি, রাজ্যপালের ভাতুরিয়া লিপি, প্রথম মহিপালের রাজভিটালিপি, দেওপাড়া প্রশস্তি এবং লক্ষণ সেনের বাগবাড়ী প্রশস্তিতে বরেন্দ্রের নিজস্ব শিল্প ঘরানার যথার্থতা উন্মোচিত হয়েছে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে রয়েছে সমৃদ্ধশালী একটি পুঁথি সংগ্রহশালা। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় পনেরো হাজার দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পত্রিকা সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার।

জাদুঘরে রক্ষিত প্রত্ননির্দশনগুলো নিয়ে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বইপুস্তক জাদুঘরের গ্রন্থাগারে রয়েছে। জাদুঘরে মুসলিম ঐতিহ্য ও আবহমান বাংলা কক্ষের সংযোজন ঘটেছে। এ ছাড়া জাদুঘরে সংরক্ষিত জৈব্য ও অজৈব্য পুরাবস্তু পরিচর্যার জন্য একটি আধুনিক সংরক্ষণশালা নির্মিত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত বিদ্যার্থী, পর্যটক ও জ্ঞানান্বেষীরা এই প্রাচীন জাদুঘরটির বিশাল ও বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন।

Source link

Related posts

পদ্মা পার হতে লাগবে মাত্র ৭ মিনিট: ওবায়দুল কাদের

News Desk

বাবাসহ চার ছেলেকে হত্যা: ২২ জন‌ কারাগারে

News Desk

দালাল চক্রে দুই হাসপাতালের সাবেক-বর্তমান স্টাফরা

News Desk

Leave a Comment