বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ খাল ও ড্রেন রয়েছে খোলা এবং অরক্ষিত অবস্থায়। এর ফলে চলতি বর্ষা মৌসুমে দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। এসব খোলা ড্রেন ও খাল যেন মরণ ফাঁদ। সর্বশেষ হাটহাজারী সরকারি ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী নিপা পালিত (২১) গত ৭ আগস্ট পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বের হলে অসাবধানতাবশত ড্রেনে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে।
নিপা পালিত সিটি করপোরেশনের এক নম্বর ওয়ার্ডের হাটহাজারী উপজেলার নন্দিরহাট ইসলামিয়াহাট বাদামতল এলাকার উত্তম পালিতের মেয়ে। তার মতো নগরীতে গত কয়েক বছরে নালা ও গর্তে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরও এসব খাল ও ড্রেন সংস্কারের উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্টদের।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নগরীতে মোট ৫৭টি খাল এবং ৭৬৫ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। ২০২১ সালে ড্রেন, খাল ও ফুটপাতের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর ওপর জরিপ চালায় সিটি করপোরেশন। জরিপের পর পাঁচ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়, যার আয়তন ছিল ১৯ কিলোমিটার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত সাত বছরে নগরীর অরক্ষিত ড্রেন ও খালে পড়ে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বহু লোক। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে চশমা খালে পানির স্রোতে পা পিছলে পড়ে ডুবে যান সালেহ আহমেদ (৫০) নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। তার লাশ এখনও পায়নি পরিবার। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একই খালে পড়ে যায় কামাল উদ্দিন (১০) নামে এক শিশু। নিখোঁজের তিন দিন পর তার লাশ উদ্ধার হয়।
২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ মোড়ে ড্রেনে পড়ে শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) নামে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী মারা যান। ২০২১ সালের ৩০ জুন ষোলশহরের চশমা পাহাড় এলাকায় অটোরিকশা খালে পড়ে তিন জন নিখোঁজ হন। পরে চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগমের (৬৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। বাকি একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল সদরঘাট নালাপাড়া এলাকায় অরক্ষিত ড্রেনে পড়ে তিন বছরের শিশু ওজাইফা মারা যায়।
২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা শহরের কালুরঘাট এলাকার ওসমানিয়া খাল থেকে অর্ধডুবন্ত অবস্থায় এক নারীকে উদ্ধার করে। এর আগে ২০১৮ সালের ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় আল আমিন নামে এক শিশু ড্রেনে পড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। হাটহাজারী উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া ২০১৭ সালের ৩ জুলাই বাকালিয়ায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে আহত হন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানিতে নালা-খাল এবং সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় কোনটা সড়ক এবং কোনটা খাল-নালা, তা দেখা যায় না। যে কারণে সড়ক মনে করে খাল-নালায় পা দিয়ে তলিয়ে যান লোকজন। এখনও নগরীর মুরাদপুর, দুই নম্বর গেটসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে খোলা খাল-ড্রেন রয়েছে। যেগুলোতে ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে নগরীর অন্যতম প্রধান সড়ক মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ড্রেন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ফুটপাতের পাশের বিশাল ড্রেনগুলো এখনও খোলা। পথচারীরা ড্রেনে পড়ার ঝুঁকি নিয়েই ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন। এতে ঘটছে মৃত্যু।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া। চট্টগ্রামে চসিক-সিডিএর অবহেলার কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। দুই সংস্থার গাফিলতির কারণে এসব মৃত্যুকূপ সংস্কার হচ্ছে না। দুই সংস্থার প্রধানের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা হওয়া উচিত।’
গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট করছে। চসিকের আফসোস তারা কেন এই জাতীয় প্রকল্প পেলো না। তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের।’
বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ব্যস্ত সড়কের দুই পাশের ড্রেন বছরের পর বছর ধরে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্ষাকালে কোনটা সড়ক এবং কোনটা খাল-নালা, তা দেখা যায় না। যে কারণে সড়ক মনে করে খাল-নালায় পা দিয়ে প্রাণ হারান লোকজন। সংশ্লিষ্টদের কোনও পদক্ষেপ নেই।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফুটপাতের খোলা ড্রেনে স্ল্যাব স্থাপন এবং খালের পাশে সুরক্ষাদেয়াল (রিটেইনিং ওয়াল) নির্মাণের কাজ চলমান আছে। ইতিমধ্যে ৩০ হাজার বর্গফুট ড্রেনের ওপর স্ল্যাব বসানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ খালগুলোর মধ্যে ১৮ হাজার বর্গফুট এলাকায় সুরক্ষাদেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ বাস্তবায়ন করছে সিডিএ।’
পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরায় খনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী।
এ বিষয়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কথা রয়েছে। বাকি ২১টি প্রকল্পের আওতাভুক্ত নয়। ৩৬টি খালের মধ্যে ১৬টির সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ৯টি খালের কাজ চলমান। বাকি ১১ খালের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে। কারণ এসব খালের জমি অধিগ্রহণ শেষ করতে পারেনি সিডিএ। তবে প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় এবং ২১টি খাল সংস্কার না করায় সুফল মিলছে না। নগরীতে এক হাজার ৬০০ নালা আছে। এসব নালা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে সুফল মিলবে।’