আকাশে চাঁদের হাসি। হালকা কুয়াশায় ভেজা জোছনার আলো। সারা রাত কেউ ঘুমায়নি। পূর্ব আকাশে ভোরের পূর্ণিমাতিথির নতুন সূর্য ওঠার অপেক্ষা। ঊষালগ্নে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নর-নারী মিলিত হয়েছে। পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। আকাশে উড়ছে বাহারি রঙের বেলুন।
ঊষালগ্নে বঙ্গোপসাগরের লোনাজলে নেমেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজারো নর-নারী। মানতকারীরা মাথার কেশ ন্যাড়াসহ প্রায়শ্চিত্ত ও পিণ্ডদান করেন। পুণ্যের আশায় বেলপাতা, ফুল, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, কলা, তেল, সিঁদুর সমুদ্রের জলে অর্পণ করেন। পুণ্যার্থীরা পূর্ণিমার মধ্যে উলুধ্বনি ও মন্ত্রপাঠ করে গঙ্গাস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ করেছেন এ বছরের রাসপূজা। আগত পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীরা সোমবার (২৭ নভেম্বর) সকাল থেকে নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছেন। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরের রাসলীলা উৎসবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। রবিবার (২৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন করেন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক নূর কুতুবুল আলম। এ সময় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আগত পুণ্যার্থীরা জানিয়েছেন, জাগতিক পাপ মুছে যাবে। এই মনস্কামনায় পূর্ণিমাতিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ কুয়াকাটায় সমুদ্রে পুণ্যস্নান করেন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের নীল জলে পুণ্যস্নান করেন পুণ্যার্থীরা। পঞ্জিকা মতে রবিবার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে পূর্ণিমাতিথি শুরু হয়েছে। তা থাকবে আজ সোমবার দুপুর ২টা ৪৬ মিনিট পর্যন্ত। এ তিথিতেই পুণ্যার্থীদের গঙ্গাস্নানের সময় নির্ধারণ করা হয়। পুণ্যের আশায় এ বছরও সৈকতে সমাগম হয়েছে দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী ও সাধু সন্ন্যাসীদের। নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।
এদিকে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শনিবার রাতে শ্রী শ্রী মদন-মোহন সেবাশ্রমে অধিবাসের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী শুরু হয়েছে শ্রী শ্রী কৃষ্ণের রাস উৎসব। মন্দির প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে ১৭ জোড়া রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রতিমা। এ সময় ভাগবত পাঠ, আরতি, উলু ও শঙ্খধ্বনি এবং নাম কীর্তনে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ। কুয়াকাটায় গঙ্গাস্নান শেষে পুণ্যার্থীরা রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রতিমা দর্শন করবে।
জানা গেছে, কুয়াকাটা পৌরসভার উদ্যোগে মন্দির ও সৈকত এলাকায় ভাসমান টয়লেট, পরিধেয় বস্ত্র পরিবর্তন শেড, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তায় রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাব, মেডিকেল টিমসহ ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও এতে অংশ নেয় সর্বস্তরের মানুষ। কুয়াকাটার সৈকত পরিণত হয় সর্বজনীন উৎসবে। রূপ নেয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসবে এমনটাই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
অপরদিকে কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রাসমেলা ও গঙ্গাস্নান উৎসবে আবাসিক হোটেলগুলো বুকিং ছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাসপূজায় আগত পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তা দিতে আনসার ভিডিপি, পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলে পর্যটন নগরী কুয়াকাটাকে।
কুয়াকাটা শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও তীর্থযাত্রী সেবাশ্রমের সভাপতি ও কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল হওলাদার জানান, প্রায় দুইশ বছর ধরে পূর্ণিমাতিথিতে এ রাসলীলা উৎসব ও মেলা চলে আসছে। দ্বাপর যুগে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হিংসা, হানাহানি দেখে দুষ্টের দমন ও সৃষ্টের লালনের জন্য স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নামধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।
কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাবু অনন্ত কুমার মুখার্জী জানান, ব্যাপক নিরাপত্তা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, রাতভর শ্রীকৃষ্ণের নামযজ্ঞ ও উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠান গঙ্গাস্নান ও শ্রীকৃষ্ণের রাসপূজা সীমিত আকারে সম্পন্ন হয়েছে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের ইনচার্জ হাসনাইন পারভেজ বলেন, ‘সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো কুয়াকাটার ট্যুরিস্ট পুলিশও সারা রাত পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তায় কাজ করেছে।’