Image default
প্রযুক্তি

মহাবিশ্বের সবথেকে বড় রহস্য: ব্ল্যাকহোল! কতটুকু জানি?

ব্ল্যাকহোল শব্দটি দ্বারা কিন্তু কোন গর্ত বোঝায় না। ব্ল্যাকহোল এমন একটি জায়গা যেখানে খুবই অল্প জায়গায় অনেক অনেক ভর ঘনীভূত হয়ে রয়েছে। এতই বেশী যে, কোন কিছুই এর কাছ থেকে রক্ষা পায় না এমনকি সর্বোচ্চ গতি সম্পন্ন আলোও নয়!

মহাকাশের এক অনন্ত বিস্ময় এই ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোলকে কৃষ্ণবিবর, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি বলা হয়। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোন কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। মহাকাশীয় এই দানবের কাছে পথ হারায় আলোকতরঙ্গ। ব্ল্যাকহোলের ধারণা নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ধোঁয়াশা কাজ করে। হয়তো ভালোভাবে জানার সুযোগ হয় না কিংবা শেষমেষ নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দেই যে, জগতে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমাদের জানার দরকার নেই।

কিন্তু না, অজানা সবকিছুই জানার আগ্রহ থাকতে হবে এবং জানতে হবে। আসলেই তো! কী এই ব্ল্যাকহোল? ব্ল্যাকহোলের রহস্যই বা কী? চলো তবে, আজকের লেখাটি পড়ে জেনে নেয়া যাক, মহাবিশ্বের এই ব্ল্যাকহোলের রহস্য!

ব্ল্যাকহোল কী?

মহাবিশ্বের এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যারা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট, তা-ই ব্ল্যাক হোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ‘ব্ল্যাক হোল’।এই তারকাদের অস্বাভাবিক আকার, ভর ও ঘনত্ব থাকে, আর এর জন্যে এই সব তারকা থেকে নির্গত আলো বাইরে আসতে পারে না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে- যখন একটি তারকার জীবনকাল শেষ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার অভিকর্ষ শক্তি এতই প্রবল হয় যে আলো ওখান থেকে বের হতে পারে না। আর এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন একটি তারকার জীবনকাল অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট জ্বালানি শেষ হয়ে যায়। তারকাটি পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। এভাবেই একটি ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়।

ব্ল্যাকহোল-এর জন্ম কীভাবে?

কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম ইতিহাস অনেকটা কবিতার মতো। একটি তারার মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় একটি কৃষ্ণগহ্বর। বিজ্ঞানীদের মতে- সব চেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোলটির জন্ম ঠিক এই মহাবিশ্বের জন্মের সময়। একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে এর মৃত্যু ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর অভ্যন্তরীণ হাইড্রোজেন গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভিতরে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে। হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে এর কেন্দ্রীয় মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে একটি তারার মৃত্যু হয়।

ব্ল্যাকহোলে রয়েছে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। প্রত্যেক ব্ল্যাকহোলের চারদিকে একটি সীমা আছে যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। এইভাবেই মহাকাশের মহাবিস্ময় হয়ে বেঁচে আছে ব্ল্যাকহোল। একে নিয়েই চলছে বিজ্ঞানের নিরন্তর চর্চা। আলোকে গিলে খাওয়া এই মহাকাশীয় দানবকে নিয়ে তাই আজও কৌতূহলের শেষ নেই।

কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার ইতিহাস :

ব্ল্যাকহোল হলো বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না- এ ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell)। ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তাঁর ‘Exposition du systeme du Monde‘ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারনা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব। আর ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারীরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাকহোল আছে। এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে।

কতো বড় এই ব্ল্যাকহোল?

ব্ল্যাকহোল ছোট হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষুদ্রতম ব্ল্যাকহোল একটি পরমাণুর সমান হতে পারে। এই জাতীয় ব্ল্যাকহোলগুলো অনেক ক্ষুদ্র কিন্তু তাদের এক একটার ভর হতে পারে বিশাল কোন পর্বতের সমান। অন্য এক ধরনের ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “স্টেলার” বা “নাক্ষত্রিক”। এর ভর আমাদের সূর্যের ভর এর চেয়েও ২০ গুণ বেশি হতে পারে।

খুব সম্ভবত অনেক অনেক বেশি ভরেরও নক্ষত্র রয়েছে পৃথিবীর ছায়াপথে। আর পৃথিবীর এই ছায়াপথকে বলা হয় “মিল্কিওয়ে”। সবচেয়ে বৃহৎ ব্ল্যাকহোলকে বলা হয় “সুপারমেসিভ”। কৃষ্ণবিবরকে ভাগ করা হয় তার মাঝে থাকা ভর, আধান, কৌণিক ভরবেগের উপর ভিত্তি করে। ভরের উপর ভিত্তি করে কৃষ্ণবিবর চার ধরনের। যেমন-

১. Super Massive Blackhole (সুপার মেসিভ ব্ল্যাকহোল)
২. Intermediate Blackhole (ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাকহোল)
৩. Micro Blackhole (মাইক্রো ব্ল্যাকহোল)
৪. Steller Blackhole (স্টেলার ব্ল্যাকহোল)

ব্ল্যাক হোল যদি ব্ল্যাক অর্থাৎ কালো হয়, তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে তা দেখতে পান?
সাধারণভাবে, একটি ব্ল্যাকহোলকে দেখা প্রায় অসম্ভব। কারণ এর অতি শক্তিশালী অভিকর্ষীয় শক্তির সবটুকু আলোর কেন্দ্রের দিকে টানে। কিন্তু এর আশেপাশের তারকা এবং গ্যাস কীভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হয় বা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এটা দেখতে পারেন। যেসব তারকারা ব্ল্যাকহোলকে ঘিরে উড্ডয়মান অথবা ঘূর্ণায়মান, গবেষকরা সেই সব তারকাদের উপর স্টাডি করতে পারেন।

ব্ল্যাকহোলকে মহাকাশের দানব বলে আখ্যায়িত করা হয়

যখন একটি ব্ল্যাকহোল ও তারকারা পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে, তখন অনেক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আলো উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট এবং কিছু বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন এই উচ্চ ক্ষমতার আলোকে পর্যবেক্ষণ করতে।

ব্ল্যাকহোল নিয়ে এত দিন আমরা যা জানতাম সেসব কি ভুল?

ব্ল্যাকহোল থেকে কোন কিছু বের হতে পারে না, এমনকি আলোও। এটাই চিরায়ত পদার্থবিদ্যার স্বীকার্য। তবে এই নীতিকে আর মানতে পারছেন না গবেষকরা, যাঁদের কাতারে প্রথমে আছেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ প্রফেসর স্টিফেন হকিং । বর্তমানে এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাঁর “এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম ” বইয়ে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা প্রমাণিত হলে যুগান্তকারী সৃষ্টি বলে প্রমাণিত হবে এই পৃথিবীতে।পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানতে পেরেছেন তা সামান্যই। তবে অতি সম্প্রতি যতটা তথ্য উদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন- তা যথার্থই অভাবনীয়, সাধারণ চিন্তার বাইরে। অতএব, ব্ল্যাকহোল নিয়ে আমাদের ধারণা ভুল নয়। এর অস্তিত্ব আছে!

ব্ল্যাকহোল কি পৃথিবীতে বিপর্যয় বা ধ্বংস সৃষ্টি করতে পারে?

ব্ল্যাকহোল মোটেও স্পেস বা মহাশুন্যের এতটা কাছে ভ্রমণ করে না যে, তা কোন তারকা, চাঁদ বা গ্রহ কে তার শিকার বানাতে পারে। আর পৃথিবীও কোন দিন ব্ল্যাকহোলে গিয়ে পতিত হবে না। কারণ, কোন ব্ল্যাকহোলই কিন্তু পৃথিবীর সৌরজগতের এতটা কাছাকাছি নয়। যদি একটি সূর্যের সমান ভরের একটি ব্ল্যাকহোল সূর্যের জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয়, তবুও নয়।

কোন কোন ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের সমতুল্য হতে পারে। কিন্তু তখনও পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো ঐ ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান থাকবে। যেমনটা আগে ছিল! সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে- ব্ল্যাকহোল আমাদের জন্য এখনো কোনো হুমকির সংবাদ বয়ে আনেনি এবং অদূর ভবিষ্যতেও আনবে না বলে আশা করা হচ্ছে!

বিখ্যাত নারী জ্যোতির্বিদ Hlavacek- Larrondo বলেন, “মনে হয় আমরা যেই ধরনের আশা করেছিলাম তার চেয়ে বড় ও শক্তিশালী ব্ল্যাকহোল পাচ্ছি এবং তা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক।”

ব্ল্যাকহোলকে মহাকাশের দানব বলে আখ্যায়িত করা হয়। ব্ল্যাকহোল এই মহাবিশ্বের অতি রহস্যময় ব্যাপার! আর বিজ্ঞানীরা নিরন্তর লেগেই আছেন এই রহস্যের পেছনে এবং আশা করা যায়, আস্তে আস্তে রহস্যের জাল থেকে একদিন বেড়িয়ে আসবে এই রহস্যময় ব্ল্যাকহোল। তখন অনেক কিছুই হয়তো ব্যাখ্যা করা যাবে যা এখন আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি!

ডার্কম্যাটার থেকে ব্ল্যাকহোল :

ডার্কম্যাটার থেকে কি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল কীভাবে গঠিত হতে পারে? সম্প্রতি এমনই একটা আভাস দিচ্ছে নতুন এক তাত্ত্বিক গবেষণা। ইউনিভার্সিদাদ নাসিওনাল ডে লা প্লাটা এবং আইসিআরএনেটের গবেষক কার্লোস আর্গোয়েলস নেতৃত্বে গবেষণাটি পরিচালনা করছেন একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল। তাঁরা আবিষ্কার করেছেন যে, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা উচ্চ ঘনত্বের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সাধারণ পদার্থ থেকে নয়, বরং ডার্ক ম্যাটার থেকে গঠিত হতে পারে। তাদের এই আবিষ্কার মহাবিশ্ব কীভাবে গঠিত হয়েছে সে সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির মাসিক বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ঠিক কী উপায়ে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠিত হয় তা গ্যালাক্সির বিবর্তন গবেষণার সবচেয়ে বড় একটি প্রশ্ন। বিজ্ঞানীরা মহা বিস্ফোরণের ৮০০ মিলিয়ন বছর পর তৈরি হওয়া সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল পর্যবেক্ষণ করছেন, তবে কীভাবে ব্ল্যাকহোল এতো দ্রুত বিকাশিত হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা মেলেনি এখনও।

এদের স্ট্যান্ডার্ড গঠন মডেল, স্বাভাবিক ব্যারিওনিক পদার্থের সাথে জড়িত। পরমাণু মূলত নক্ষত্র, গ্রহ, এবং সকল দৃশ্যমান বস্তু গঠন করে। আর এসব বস্তু প্রচন্ড মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নিজের গঠন ভেঙে তৈরি করে ব্ল্যাকহোল। এবং সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় সেই ব্ল্যাকহোলের ভর এবং আকার। যাইহোক, নতুন এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা স্থিতিশীল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ডার্ক ম্যাটারের সম্ভাব্য অস্তিত্ব অনুসন্ধান করছেন। ধারণা করছেন, গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ডার্ক ম্যাটার প্রচন্ডভাবে ঘনিভূত হয়ে একটা সময় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হতে পারে।

তাদের এই মডেল অনুসারে প্রস্তাবিত অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় অনেক দ্রুততম সময়ে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠিত হতে পারে। এবং গ্যালাক্সি পূর্ণরূপে বিকাশিত হওয়ার আগেই এই মডেল অনুসারে অতিভরের ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে এর কেন্দ্রে। তবে, তার এই প্রস্তাবনাটি ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে বর্তমান উপলব্ধির সাথে মেলে না।

কার্লোস আর্গোয়েলস বলেন, এই নতুন গঠন পদ্ধতিটি নতুন এক তথ্য দিচ্ছে। নক্ষত্র তৈরি হবার আগেই অথবা এর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ছাড়াই কিভাবে প্রাচীন মহাবিশ্বে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠিত হয়। এ বিষয়ে একটি প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম নতুন এই তত্ত্বটি।

নতুন মডেলের আরও বলছে, বিপুল পরিমাণ ভর ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত কম ডার্ক ম্যাটারের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে বামন গ্যালাক্সি এবং এদের আশেপাশের গ্যালাক্সিগুলোর ক্ষেত্রে এই কথাটি খাটে। গবেষকদের অভিমত, এই বামন ছায়াপথগুলোতে প্রত্যাশিত ব্ল্যাকহোলের বদলে ডার্কম্যাটার নিউক্লিয়াস তৈরি হতে পারে। এই ধরনের ডার্কম্যাটারের কেন্দ্র ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষীয় চিহ্ন অনুকরণ করতে পারে। এর পাশাপাশি ব্যাখ্যা করতে পারে ডার্ক ম্যাটার দিয়ে পরিবেষ্টিত ছায়াপথের ঘূর্ণন।

আর্গুয়েলেস আরও বলেন, এই মডেল দেখায় কীভাবে ডার্কম্যাটারের বলয় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ঘনত্ব তৈরি করতে পারে। যেটা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের গঠন বুঝতে বেশ ভালোভাবে সাহায্য করতে পারে। প্রথমবারের মত প্রমাণ করেছি, এই ধরনের ডার্ক ম্যাটারের বলয় সত্যিই একটি মহাজাগতিক কাঠামো গঠন করতে পারে। এবং একে স্থিতিশীল রাখতে পারে।

গবেষণা পত্রটির লেখকরা আশা করছেন, এ বিষয়ে অদূর ভবিষ্যতের অন্যান্য গবেষণা আমাদের মহাবিশ্বের প্রথম দিনগুলোতে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল গঠনের উপর আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করবে। একই সঙ্গে আমাদের মিল্কিওয়েসহ নিস্ক্রিয় গ্যালাক্সির কেন্দ্রগুলোতে ঘন ডার্কম্যাটারের কীভাবে কাজ করছে তা জানতে সাহায্য করবে।

ব্ল্যাকহোল যখন নক্ষত্র গিলে খায়!

প্রতিটি ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি দানবাকার ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর থাকে। সূর্যের চেয়েও কোটি কোটি গুণ ভারী এসব ব্ল্যাকহোল চারপাশ থেকে গ্যাস গ্রাস করতে থাকে। ফলে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে সেগুলো। এমনকি আস্ত নক্ষত্রও গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে একটি ব্ল্যাকহোল!

কিছু কিছু ব্ল্যাকহোল কয়েক হাজার বছর একেবারে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, যেন অদৃশ্য! তারপর কোনো একদিন একটি নক্ষত্র তার খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় মুহূর্তেই তলিয়ে যায় সেখানে। একটি আস্ত নক্ষত্র বেমালুম গায়েব হয়ে যায় তার ভেতর।

এতে সেটি কয়েক মাস ধরে সুপারনোভার মতো তীব্রভাবে জ্বলতে থাকে। এ ঘটনাকে বলে টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্ট (টিডিই)।
কয়েক বছর আগ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাত্র কয়েকবার এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছেন। বর্তমানে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশাল ক্ষেত্রজুড়ে সার্ভে করা সম্ভব হয়, যার মাধ্যমে সুপ্ত ও প্রায় অদৃশ্য অনেক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান মিলেছে। সেই সঙ্গে নক্ষত্র গ্রাস করে ফেলার ভয়ঙ্কর সব আলোকচিত্র তোলা সম্ভব হয়েছে, যা এ ঘটনা সম্পর্কে নতুন ধারণা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের গবেষক সুভি গেজারি বলেন, ‘আমরা এখনো এ ঘটনার পেছনের মেকানিজম বুঝতে চেষ্টা করছি। হনলুলুতে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে ৩৯টি টিডিই’র আলোকচিত্র তুলে ধরেন এবং এ নিয়ে ব্যাখ্যা করেন তিনি। ৩৯টির মধ্যে ২২টি ঘটেছে গত কয়েক বছরে এবং ১৭টি ঘটেছে ১৮ মাস আগে জুইকি ট্র্যান্সিয়েন্ট ফ্যাসিলিটির (জেটিএফ) অপারেশন শুরু হওয়ার পর। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক দশমিক দুই মিটার সার্ভে টেলিস্কোপের মাধ্যমে জেটিএফের কাজ শুরু হয়।
টিডিই’র আলোকচিত্রগুলোতে দেখা যায়, ব্ল্যাকহোলের তীব্র মধ্যাকর্ষণ বল একটি নক্ষত্রকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়াবহ শক্তিতে একটি নক্ষত্রের অর্ধেক গ্রাস করে ফেলে সেটি। সেসময় সেটি প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে ক্রমাগত এক্স-রে নিঃসরণ করতে থাকে।

গ্রাস করার সময় নিঃসরিত গ্যাসের বর্ণালী থেকে অনেক সময় ধারণা করা যায় নক্ষত্রটি কেমন ছিল। গেজারি ও তার সহকর্মীরা গবেষণা করে দেখেন, টিডিই বর্ণালী তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এতে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম বা মিশ্র গ্যাস থাকতে পারে। হাইড্রোজেন থাকলে বোঝা যায় সেটি বেশ বড় ও নতুন নক্ষত্র। হিলিয়াম থাকলে বোঝা যায় সেটি প্রবীণ নক্ষত্র।

কতো দ্রুত একটি নক্ষত্রকে বেমালুম পেটে পুরে নিচ্ছে ব্ল্যাকহোল, তা পরিমাপ করা সম্ভব হলে একসময় ব্ল্যাকহোলের ভর সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা মিলবে। তবে তার আগে এ ঘটনার পেছনের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ভালো করে বুঝতে হবে বলে জানান হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের গবেষক তসভি পিরান।

কয়েকটি টিডিই তুলনা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্ল্যাকহোলের উজ্জ্বলতা ও এক্স-রে নিঃসরণের পরিমাণ আলাদা। পিরান বলেন, ব্যাপারটা এমন যেন নক্ষত্র গিলে খাওয়ার পর বদহজম হয়েছে ব্ল্যাকহোলের! আর সেটি প্রতিক্ষেত্রে ভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।

তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাকহোলের ভর একশ’ মিলিয়ন সূর্যের ভরের চেয়েও বেশি হতে পারে। তাই নক্ষত্র ছিন্নভিন্ন না করে একেবারেই পুরোটা গ্রাস করার সক্ষমতা থাকার কথা সেটির। কিন্তু তার বদলে নক্ষত্রগুলো ছিন্নভিন্ন হওয়ারই প্রমাণ মিলেছে। তবে এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা প্রায় সবগুলোই ছিল ছোট ছায়াপথের ব্ল্যাকহোল।

টিডিই’র মাধ্যমে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন সেটি কীভাবে ঘোরে এ সম্পর্কে নতুন তথ্য মিলেছে। ভবিষ্যতে টিডিইকে একক হিসেবে ধরে ব্ল্যাকহোলের ভর ও ধরন বের করাও সম্ভব হতে পারে বলে আশাবাদী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

ব্ল্যাকহোল নাকি সুপারনোভা?

এখন পর্যন্ত কোনো ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবারে নাসার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একদল আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ প্রথমবারের মতো একটি নক্ষত্র ধসে জটিল বস্তু গঠিত হওয়ার ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। অবশ্য নক্ষত্র ধসে তৈরি হওয়া বস্তুটি নিউট্রন তারা নাকি কৃষ্ণগহ্বর তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইন্দো এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

নাসার এক বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইতে অবস্থিত মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার অ্যাস্ট্রেরয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইম্প্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম টেলিস্কোপে গত বছরের ১৬ জুন রাতের আকাশে সংক্ষিপ্ত ও অস্বাভাবিক ওই বিস্ফোরণ ধরা পড়ে।

মহাকাশের ওই বিস্ফোরণকে বলা হয় ‘এটি ২০১৮ কাউ’। এ ঘটনাটি ‘দ্য কাউ’ নামেও পরিচিত। এ বিস্ফোরণটি ২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে হারকিউলিস নক্ষত্রপুঞ্জে ‘সিজিসিজি ১৩৭-০৬৮’ নামের নক্ষত্র ধাত্রী ছায়াপথের ভেতরে বা নিকটে ঘটেছে।

নাসার গবেষকেরা বলেন, তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে আকস্মিক ওই বিস্ফোরণের আভা দেখা যায় যা সাধারণ সুপারনোভার ক্ষেত্রেও উজ্জ্বল। এরপর কয়েক মাস ধরে এর উজ্জ্বলতা কমতে থাকে।

ওই বস্তুটির ঘটনা দিগন্ত ঘিরে নাক্ষত্রিক ধ্বংসাবশেষের ঘুরপাক খাওয়ার বিষয়টি অসাধারণ উজ্জ্বল আভা তৈরি করে। নিল গেহ্রিলস সুইফট অবজারভেটরি ও নিউক্লিয়ার স্পেকট্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ অ্যারের (নুষ্টার) মতো একাধিক নাসার মিশন থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে একদল গবেষণ ধারণা করছেন, দ্য কাউ মূলত একটি দৈত্যকার কৃষ্ণগহ্বর যা একটি ক্ষণস্থায়ী নক্ষত্রকে ছিন্নভিন্ন করেছে।

রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ‘মান্থলি নোটিশেস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা সংক্রান্ত নিবন্ধ। গবেষকেরা বলছেন, ছিন্নভিন্ন নক্ষত্রটি একটি সাদা বামন যা পৃথিবীর আকারের একটি অধিক উষ্ণ নক্ষত্রের অবশেষ। এটি আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রের সর্বশেষ পর্যায়।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) জ্যোতির্বিদ পল কুইন বলেন, দ্য কাউ খুব স্বল্প সময়ে বিশাল ধ্বংসাবশেষের মেঘ তৈরি করেছে। বড় আকারের নক্ষত্রকে ঘিরে বড় আকারের মেঘ তৈরি করতে বিশাল একটি ব্ল্যাক হোলের দরকার।

তবে আরেক দল গবেষক ওই তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছেন, একটি নক্ষত্র বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা থেকে দ্য কাউয়ের সৃষ্টি। কাউয়ের বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হয়েছে, এত দ্রুত কোনো বস্তু পরিবর্তন হতে পারেন না। এটি মূলত সুপারনোভা বা এক ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ।

পৃথিবীর খুব কাছেই যে ব্ল্যাকহোল :

দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকালে টেলিস্কোপিয়াম নক্ষত্রপুঞ্জের ওপরের দিকে নীল আলোক বিন্দু চোখে পড়ে। আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ এ আলোকবিন্দু মূলত কাছাকাছি কক্ষপথে আবর্তনরত দুটি নক্ষত্র, যার সঙ্গী হিসেবে রয়েছে আমাদের পৃথিবীর খুব কাছের একটি কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। বুধবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস সাময়িকীতে এই গবেষণাবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, নতুন আবিষ্কৃত কৃষ্ণবিবরটি আমদের সৌরজগৎ থেকে ১ হাজার ১১ আলোকবর্ষ দূরে। এটি এইচআর ৬৮১৯ সৌরমণ্ডলে অবস্থিত। অদৃশ্য এ বস্তুটি দুটি দৃশ্যমান নক্ষত্রের মধ্যে আটকে রয়েছে। এটি সূর্যের ভর থেকে প্রায় চার গুণ ও পরবর্তী ব্ল্যাকহোলের থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ কাছাকাছি বলে ধারণা করা হয়।

বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী করিম আল-বাদরি বলেন, মনে হচ্ছে এটি চোখের সামনেই লুকিয়ে ছিল। আশির দশক থেকে উজ্জ্বল এ নক্ষত্রটি নিয়ে গবেষণা করা হলেও এতে অবাক করার মতো কিছু বিষয় লুকিয়ে ছিল।
পৃথিবীর নিকটতম কৃষ্ণবিবর বলা হলেও মানব স্কেলে, এক হাজার আলোকবর্ষ এক বিশাল দূরত্ব। তবে যদি মিল্কিওয়ে ছায়াপথকে স্কেল ধরা হয়, তবে সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব চুল পরিমাণ আর ওই কৃষ্ণবিবরের দূরত্ব দাঁড়ায় চার কিলোমিটার। তবে মহাবিশ্বের বিশালতা বিবেচনায় যা এক লাখের বেশি আলোকবর্ষ জুড়ে রয়েছে, এইচআর ৬৮১৯ পৃথিবীর বেশ কাছাকাছি।

গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করেছেন যে মিল্কিওয়ে কয়েক মিলিয়ন ব্ল্যাকহোলের আবাসস্থল। কিন্তু তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। গবেষকেরা এর পার্শ্ববর্তী বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে এর অবস্থান বের করেন।

ব্ল্যাকহোল কী?

ব্ল্যাকহোল হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে কোনো কিছু প্রবেশ করলে আর ফিরে আসে না। এমনকি আলোও এই গহ্বরকে অতিক্রম করতে পারে না।
গর্ত বলে পরিচিত হলেও ব্ল্যাকহোলের মধ্যে কিন্তু পুরোটা ফাঁকা জায়গা নয়। বরং এর মধ্যে খুব অল্প জায়গায় এত ভারী সব বস্তু আছে যে এসবের কারণে তীব্র মহাকর্ষীয় শক্তি উৎপন্ন হয়।
ব্ল্যাকহোলের পেছনে ‘ইভেন্ট হরাইজন’ নামের একটি স্থান আছে, যাকে বলা হয় ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। এই জায়গায় মহাকর্ষীয় শক্তি এতটাই তীব্র যে এখান থেকে কোনো কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না।

কৃষ্ণগহ্বর :

কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণ বিবর (ব্ল্যাক হোল নামেও পরিচিত) মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি বিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত ধারণা।[৪] এই ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু যা এত ঘন সন্নিবিষ্ট বা অতি ক্ষুদ্র আয়তনে এর ভর এত বেশি যে এর মহাকর্ষীয় শক্তি কোন কিছুকেই তার ভিতর থেকে বের হতে দেয় না, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকেও (যেমন: আলো) নয়। প্রকৃতপক্ষে এই স্থানে সাধারণ মহাকর্ষীয় বলের মান এত বেশি হয়ে যায় যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। ফলে এ থেকে কোন কিছুই পালাতে পারে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম তৎকালীন মহাকর্ষের ধারণার ভিত্তিতে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টি উত্থাপিত হয়।

সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোন কিছু, এমনকি আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না। এটা তৈরি হয় খুবই বেশি পরিমাণ ঘনত্ব বিশিষ্ট ভর থেকে। কোন অল্প স্থানে খুব বেশি পরিমাণ ভর একত্র হলে সেটা আর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না। আমরা মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠে কল্পনা করি। মহাবিশ্বকে চিন্তা করুন একটি বিশাল কাপড়ের টুকরো হিসেবে এবং তারপর যদি আপনি কাপড়ের উপর কোন কোন স্থানে কিছু ভারী বস্তু রাখেন তাহলে কি দেখবেন? যেইসব স্থানে ভারি বস্তু রয়েছে সেইসব স্থানের কাপড় একটু নিচু হয়ে গিয়েছে। এই একই বাপারটি ঘটে মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। যেসব স্থানে ভর অচিন্তনিয় পরিমাণ বেশি সেইসব স্থানে গর্ত হয়ে আছে। এই অসামাণ্য ভর এক স্থানে কুন্ডলিত হয়ে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি গালাক্সির স্থানে স্থানে কম-বেশি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের কথা জানা যায়। সাধারণত বেশীরভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণয়মান।

কৃষ্ণগহ্বর শব্দের অর্থ কালো গর্ত। একে এই নামকরণ করার পেছনে কারণ হল এটি এর নিজের দিকে আসা সকল আলোক রশ্মিকে শুষে নেয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোন আলোক বিন্দুই ফিরে আসতে পারে না ঠিক থার্মোডায়নামিক্সের কৃষ্ণ বস্তুর মতো।

অনেকদিন পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বরের কোন প্রত্যক্ষ দর্শন পাওয়া গিয়েছিল না, কারণ এ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে না যেকারণে একে দেখা সম্ভব নয়, কিন্ত এর উপস্থিতির প্রমাণ আমরা পরোক্ষভাবে পেয়েছিলাম। কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিতের প্রমাণ কোন স্থানের তারা নক্ষত্রের গতি এবং দিক দেখে পাওয়া যায়। মহাকাশবিদগণ ১৬ বছর ধরে আশে-পাশের তারামন্ডলীর গতি-বিধি পর্যবেক্ষণ করে গত ২০০৮ সালে প্রমাণ পেয়েছেন অতিমাত্রার ভর বিশিষ্ট একটি কৃষ্ণগহ্বরের যার ভর আমাদের সূর্য থেকে ৪ মিলিয়ন গুন বেশি এবং এটি আমাদের আকাশগঙ্গার মাঝখানে অবস্থিত।

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে লাইগো সংগঠন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রত্যক্ষ সনাক্তকরণের ঘোষণা দেয়, যা ছিল দুটি কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের প্রথম পর্যবেক্ষণ।[৭] ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ১১ টি মহাকর্ষীয় তারঙ্গিক ঘটনা পর্যবেক্ষিত হয়েছে যার মাঝে ১০ টি ঘটনা কৃষ্ণগহ্বরের একত্রীভবনের ফলে এবং ১ টি ঘটনা দ্বৈত নিউট্রন তারা একত্রীভবনের ফলে সৃষ্ট।[৮][৯] ২০১৭ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা মেসিয়ে ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিভারী কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণের পর, দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত একটি কৃষ্ণবিবর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রত্যক্ষ চিত্র প্রকাশিত হয়।

ব্ল্যাকহোল ও একটি মহাজাগতিক ম্যারেজ :

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায়ই জ্ঞান এবং বিদ্যার স্বর্ণভল্লুক-সম কম্বিনেশনটি কাঁখে নিয়ে এমন এমন সুকীর্তি মার্কেটে ছাড়েন, যা দেখে ও শুনে আপামর পাবলিকের দিগন্তটাচিং বারোয়ারি অশিক্ষিত রোমরাজি কড়মড় করে ওঠে! তেমনই একটি সামনে এলো সম্প্রতি:- দুই নক্ষত্রের সঙ্গে ‘সেলেস্টিয়াল ম্যারেজ’-এ আবদ্ধ পৃথিবীর নিকটতম ব্ল্যাকহোলটি। ‘সেলেস্টিয়াল ম্যারেজ’ বা স্বর্গীয় বিবাহ বা আমরা অমরসঙ্গী বা রিয়া+বাবাই বা ঐশ্বর্য রাই ও গাছ… অর্থাৎ, জন্ম-জন্মান্তরের রিস্তা। যা নিয়ে প্রচুর হাপুসহুপুস সেকাল-মার্কা সাহিত্য ও সিনিমা চালাতে গিয়ে যুগপৎ কাগজ এবং রিল নষ্ট হয়েছে দিস্তা-দিস্তা।

পৃথিবী থেকে কমবেশি এক হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা এবং সূর্যের ভরের থেকে ৪.২ গুণ বেশি ভরের এই ব্ল্যাকহোলটি মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে দুটি নক্ষত্র দ্বারা আবদ্ধ। অ্যাস্ট্রোনমি এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স জার্নাল প্রকাশিত গবেষণাটির মূল লেখক টমাস রিভিনিয়াসের কথায়, খুব তাড়াতাড়িই ব্যাপারটা ঘটতে চলেছে।

এক বছরে আলো যতটা পথ আকুলিবিকুলি ট্র্যাভেল করে তার পরিমাণ শ’দেড়েক দেশের জিডিপির থেকেও বেশি। ৫.৯ ট্রিলিয়ন মাইল। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর বস্তুটি আসলে কী, তার সম্বন্ধেও এই প্রসঙ্গে কিছুটা বলে নেওয়া যাক। এটি হল আদতে এমন একটি অবস্থা, যেখানে নক্ষত্রের সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে পরিণত হয়। এর ফলে এই বিশেষ অবস্থাটির মহাকর্ষ বল এতটাই বেশি হয়ে যায় যে, আলোও একে আর অতিক্রম করে উঠতে পারে না। নক্ষত্রের সমস্ত ভর একটি বিন্দুতে পরিণত হওয়ায় তার সামগ্রিক ভর এত প্রবল হয়ে পড়ে যে, তা বাঁক তৈরি করতে করতে নতুন গহ্বর সৃষ্টি করে। ওটাই কৃষ্ণগহ্বর।

কিছু কিছু ব্ল্যাকহোল আবার সাইজে প্রায় অলৌকিকের মামা! আক্ষরিক মাথা ঘিজিঘিজি ধকধক! ছায়াপথের ঠিক কেন্দ্রে এরকম কিছু মক্কেল রয়েছে। পৃথিবী থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে! সূর্যের টোটাল ভরের থেকে বেশি না, এই চল্লিশ লক্ষ গুণ ভারি!
নতুন আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোলটির স্টেলার-মাস হল একটি তারার ভরের সমান। মনে করা হচ্ছে, এই নক্ষত্রটি জন্মের সময় সূর্যের থেকে ২০ গুণ বেশি ভরের ছিল। তারপর তা একসময় ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। এই দুটি তারা এবং ব্ল্যাকহোল যে ‘ট্রিপল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে আবদ্ধ, তার নামটি খাজা বাংলা কল্পবিজ্ঞান গল্পের চরিত্রের মতো- এইচআর ৬৮১৯। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে ঠিকঠিক ঠিকঠিক পয়েন্ট বুঝে দাঁড়ালে খালি চোখেই দেখতে পাওয়া যাবে একে।

চেক প্রজাতন্ত্রের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের জ্যোতির্বিজ্ঞানী পেট্রো হারদাভা জানাচ্ছেন, আগে মনে করা হতো, ছায়াপথের মধ্যে স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল রয়েছে ওই সামান্য কয়েক ডজন। ইদানিং, ভাবনা পাল্টেছে। এখন মনে করা হয়, কিছু না হলেও কয়েকশো কোটি স্টেলার-মাস ব্ল্যাকহোল সেঁধিয়ে আছে ছায়াপথের পাকস্থলীতে। জানা গিয়েছে, আমাদের এই আলোচ্য রোমিও ব্ল্যাকহোলটি সূর্যের থেকে পাঁচ-ছয় গুণ ভারি দুটি তারাকে এখনও ছাড়েনি! এমনভাবে ট্রিপল সিস্টেমের মধ্যে আটকে থাকা সাধারণভাবে ব্ল্যাকহোলের চরিত্র নয়! জানাচ্ছেন টমাস রিভিনিয়াস।

একটি নিখাদ ত্রিকোণ প্রেম! কে আগে আসবে, এই হল প্রশ্ন! আরও কাছাকাছি, আরও কাছে এসো বলে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে ব্ল্যাকহোল! এর মধ্যে কোনও একটি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে! তবে, এই প্রক্রিয়াটি ঠিক দু-এক বছরের নয়, কয়েক লক্ষ বছরের কেস! বলছেন রিভিনিয়াস। সেই ‘দেব আনন্দ’-টি কে, এখন সেটাই দেখার!

নক্ষত্রের চেয়ে বেশি নিঃশব্দ আর কী! নক্ষত্র আসে, হাসে, তারপর চলে একা পায়ে। শেষ ট্রাম মুছে গেছে। শেষ শব্দও। নেই জীবনানন্দ দাশ। তবু, অন্তিম নিশীথে এক নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোড়ন স্পর্শ করার চেষ্টা করছে অপর একটি নক্ষত্রকে- এমন কথা ভাবতে পারায়ও তো এই অসময়ে সুখ!

Related posts

ইউটিউবে যে বিজ্ঞাপন আর দেওয়া যাবে না

News Desk

হোয়াটসঅ্যাপে কল রেকর্ড করার উপায়

News Desk

যেভাবে Google Search এবং Google Maps ব্যবহার করে নিকটবর্তী কোভিড-১৯ টিকা কেন্দ্র খুঁজবেন

News Desk

Leave a Comment