বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসি। চাইলে তর্কযোগ্যভাবে তাকেই এককভাবে বিশ্বসেরা বলে দেয়া যায়। ফুটবল মাঠে মেসি যা করেন, তা অনেক ফুটবলারের জন্য স্রেফ স্বপ্নের মতো। কিন্তু নিয়মিত এসব করেই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় তুলেছেন ছয়বারের ব্যালন ডি অর জয়ী এ ফুটবলার।
অথচ খেলার মাঠে মেসি যতটা ভয়ংকর, মাঠের বাইরে ঠিক ততটাই নিরীহ এবং লাজুক প্রকৃতির একজন স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার এ তারকা ফুটবলার। সেই ছোটবেলা থেকেই ব্যক্তিজীবনে বেশ অন্তর্মুখী ও লাজুক প্রকৃতির মানুষ মেসি। তবে খেলার মাঠে নামলেই দেখা যায় তার দৈত্যাকৃতি। সেটা শারীরিক গঠনে নয়, বরং খেলার মানসিকতায়।
মেসির এই ব্যক্তিজীবনে লাজুক প্রকৃতি কিন্তু খেলার মাঠে পুরোপুরি ভিন্ন চরিত্রের শুরুর সময়টা খুব কাছ থেকে দেখেছেন বার্সেলোনার সাবেক ফুটবলার আন্দ্রে ওরলান্ডি। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত লোনে বার্সেলোনা বি ও মূল দলে খেলেছেন ওরলান্ডি। তখন মেসিও বি দল থেকে প্রমোশন পেয়ে অভিষেক হয় মূল দলে।
নিজের এই অভিজ্ঞতা থেকেই মেসির ক্যারিয়ারের শুরুর সময়গুলোর কথা জানিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী ওরলান্ডি। ফুটবলের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম গোল ডট কমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওরলান্ডির স্মৃতিচারণ নিচে তুলে ধরা হলোঃ
মেসি খুবই অন্তর্মুখী একজন মানুষ ছিল এবং রোনাদিনহো ওর খেয়াল রাখত। আমার মনে আছে, সে রোনালদিনহোর জন্য কফি বানাতো এবং সবসময় চুপচাপ থাকত। কিন্তু মাঠে সে রীতিমতো দৈত্য বনে যেত।
তার সঙ্গে অনুশীলন করা মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। আপনি তার কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নিতে পারবেন না কিংবা তার কাছেও যেতে পারবেন না। মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে ওর মতো মনোভাবের কাউকে দেখিনি। সে যদি কখনও পা থেকে বল হারিয়ে ফেলত, তাহলে রীতিমতো আপনার গোড়ালি কামড়ে ধরত। সে এটা মানতেই পারত না। শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল সে বড় কিছু হবে। কিন্তু আমি কখনও ভাবিনি সে ফুটবল ইতিহাসের সেরা হয়ে যাবে।
তখনকার সময়ে সবার সামনে উদাহরণ হিসেবে ছিলেন রোনালদিনহো। আমার দেখা সবচেয়ে নিখুঁত কোয়ালিটি ছিলেন রোনালদিনহো। মেসি তার চেয়ে আলাদা ছিল। সে কোনোকিছুই আপনাকে দেখানোর জন্য করতো না। কিন্তু সে একটা বল আপনাকে দেখাত, মুহূর্তের মধ্যেই সেটি আর জায়গায় থাকত না।
এগুলো খুবই ছোট ছোট মুভমেন্ট, চাপের মধ্য থেকে বের হওয়ার অনেক কৌশল জানা আছে মেসির। আপনি ওর দুর্বল পা সম্পর্কে বলতে পারবেন না। কারণ দুই পায়েই সে ভালো। আপনি ওকে লাথি মারতে পারবেন না, কারণ আপনি তো ওর কাছেই যেতে পারবেন না।
একজন তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে মেসির ধাঁরেকাছেও থাকতে না পারা হতাশার ছিল। তবে আমি খুবই সৌভাগ্যবান ছিলাম যে, মেসির সঙ্গে খেলতে ও অনুশীলন করতে পেরেছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগত, জটিল সব পরিস্থিতিতে সে কীভাবে বলটা নিজের কাছে নিয়ে নিতো। ছয়জন খেলোয়াড় ঘিরে রাখলেও সেখান থেকে বের হওয়ার কায়দাটা ঠিকই জানত। অনেক খেলোয়াড় হয়তো এটা ভাবতেও পারে না।
আমার সবচেয়ে ভালো মনে আছে একটা স্মৃতি, যেদিন সে ইনজুরি থেকে ফিরে আসল। কোচ ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড একটা প্রস্তুতি ম্যাচের আয়োজন করল। যেখানে বি দল ও প্রথম দলের খেলোয়াড়দের একত্রে করে খেলানো হয়। আমি স্যামুয়েল ইতোর দলে ছিলাম, মেসির বিপক্ষে।
সেদিন মাঝমাঠে বল পায় মেসি, তারপর এক-এক করে পাঁচজনকে কাটিয়ে গোলরক্ষককে ফাঁকিয়ে দিয়ে বল জালে জড়ায়। এটা দেখতে খুবই সহজ মনে হয়। কিন্তু সে ইনজুরি থেকে মাত্রই ফিরেছিল। আমরা হয়তো সেদিন ভাগ্যবান ছিলাম যে মেসি ইনজুরি থেকে ফিরেছিল। পুরো সুস্থ থাকলে হয়তো আরও অনেক কিছু করতো সেদিন।
আমার মনে হয় মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো প্রতিদিনই নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা রাখে। বিষয়টা এমন ছিল যে, কী করতে হবে সে জানে এবং কীভাবে করতে হবে সেটাও খুব ভালোভাবে জানে। এ কারণেই সে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড়। ওর ঐ মানসিকতাটা ছিল।
ভুলে যাবেন না, ও অনুশীলন করত ডেকো, জাভি, ইতোদের সঙ্গে এবং মাঠে কোনোরকমের লাজুকতা ছিল না; যদিও সে ব্যক্তিজীবনে খুবই লাজুক একজন মানুষ। সে মাঠে সবসময়ই আত্মবিশ্বাসী। এসব বড় খেলোয়াড়রা সবসময় আত্মপ্রত্যয়ী। তারা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখায়।
রোনালদিনহোর মধ্যে মেসি ও রোনালদোর গুণ ছিল। কিন্তু এ দুজন (মেসি-রোনালদো) যেভাবে নিজেদের যত্ন নিয়েছে, রোনালদিনহো সেটা করেনি। যে কারণে মেসি-রোনালদোর মতো ধারাবাহিক হতে পারেনি রোনালদিনহো। এমনকি এখনও, নিজেদের ত্রিশ বছর পেরুনোর পরও কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে তারা। যে কারণে এখনও মেসি-রোনালদোই শীর্ষে।