বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব যেন অনেকটা ‘পরিস্থিতির শিকার’! এক অধিনায়কের যুগ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে গত কয়েক বছরের বিভিন্ন অদল-বদলের হাত ধরে তিন অধিনায়কের যুগে ঢুকে গেল, সেটি একদমই ভেবেচিন্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। বরং পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েই সে পথে যেতে হয়েছে বিসিবিকে। একটি আন্তর্জাতিক দলের নেতৃত্বের কাঠামো কেমন হবে, সেটি অনেক ভাবনাচিন্তার দাবি রাখলেও বাংলাদেশ যেন এ ক্ষেত্রে প্রবল ব্যতিক্রম।
টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির জন্য বাংলাদেশ দলে যে এখন তিন অধিনায়ক, সেটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে নেওয়া সিদ্ধান্তেরই ফল। অধিনায়কদের পর্যাপ্ত সময় দিতে বিসিবি এখনো তিন অধিনায়কের নীতিতে অটল থাকলেও প্রশ্নটা থেকেই যায়—তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক দিয়ে দল পরিচালনার সময় কি আসলেই হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের?
বর্তমানে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বে না থাকলেও একসময় তিন সংস্করণেই দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাকিব আল হাসান। সেই সাকিব বিশ্বাস করেন, এখনো তিন সংস্করণে একজন অধিনায়কই থাকা উচিত বাংলাদেশ দলে। আইপিএল খেলতে বর্তমানে তিনি ভারতে। তিন অধিনায়ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাকিব বলেছেন, ‘প্রশ্নটা কঠিন। বিভিন্ন মতামত থাকবে এটা নিয়ে। তবে আমি কখনোই বলব না তিন সংস্করণে এক অধিনায়ক হলে আমাদের জন্য খারাপ হবে। অবশ্যই এটা খারাপ নয়। বরং এটাই হয়তো ভালো।’
তিন সংস্করণে এক অধিনায়কের পক্ষে দেওয়া নিজের ভোটের পেছনে যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন ওয়ানডের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, ‘যদি তিনটি সংস্করণকে আমরা সমান গুরুত্ব দিতাম এবং তিন সংস্করণে আমাদের পারফরম্যান্স একই রকম থাকত, তাহলে একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমাদের তো তিন সংস্করণে একই রকম পারফরম্যান্স নয়। এটাই সমস্যা, বিশেষ করে যে সংস্করণে আমরা ভালো খেলি না, সেই অধিনায়কের বেশি সমস্যা।’
অধিনায়কত্বের চাপ কী, সেটা বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক থাকার সময় ভালোই টের পেয়েছেন সাকিব। সে অভিজ্ঞতা থেকেই যেন বোঝাতে চাইলেন ভালো না খেলা সংস্করণের অধিনায়কদের সমস্যাটা, ‘যে সংস্করণে আমরা ভালো খেলি, সেই অধিনায়ক সব সময় স্বস্তিতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাকি যে সংস্করণে আমরা ভালো খেলি না বা নিয়মিত সাফল্য পাই না, সেই সংস্করণের অধিনায়কের জন্য তো কাজটা কঠিন হয়ে যায়। তাকে সব সময় চাপে থাকতে হবে, সমালোচনা শুনতে হবে এবং অধিনায়ক হিসেবে তার থিতু হতেও বেশি সময় লাগবে। আবার যে সংস্করণে আমাদের দল ভালো, সে অধিনায়কের সমস্যা কম হবে, তার সময়ও কম লাগবে থিতু হতে।’
বাংলাদেশ দলে তিন সংস্করণে তিন অধিনায়কের সূত্রপাত ২০১৭ সালের এপ্রিলে মাশরাফি বিন মুর্তজা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেওয়ার পর। এর আগ পর্যন্ত সাদা বলের দুই সংস্করণেই অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি, টেস্টের অধিনায়ক ছিলেন মুশফিকুর রহিম। মাশরাফি টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব ছাড়ার পর এই সংস্করণে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাকিবকে। মাশরাফি থেকে যান ওয়ানডে অধিনায়ক। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিন সংস্করণে তিন অধিনায়কের যুগ শুরু।
মাঝে অবশ্য অদল-বদল হয়েছে টেস্ট দলের নেতৃত্বেও। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর মুশফিকের পরিবর্তে টেস্ট দলের নেতৃত্ব দেওয়া হয় সাকিবকে। কিন্তু দায়িত্ব পেয়েও চোটের কারণে ২০১৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুই টেস্টের সিরিজে তিনি খেলতে পারেননি। আপৎকালীন অধিনায়ক হিসেবে ওই দুই টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দেন মাহমুদউল্লাহ।
সুস্থ হয়ে ওই বছরেরই জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে ফেরেন সাকিব। আর টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক তো তিনি ছিলেন আগে থেকেই। পরে অবশ্য সাকিবের ওপর আইসিসির এক বছরের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি দুই নেতৃত্বেই পরিবর্তন আনতে হয়। টেস্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় মুমিনুল হককে এবং টি-টোয়েন্টির অধিনায়ক করা হয় মাহমুদউল্লাহকে। গত বছরের মার্চে মাশরাফি ওয়ানডের নেতৃত্বও ছেড়ে দিলে এই সংস্করণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তামিম ইকবালকে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বে এই যে অদল-বদল এবং যে ধারাবাহিকতায় আজ টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে তিন অধিনায়ক; সাকিবের চোখেও সেটি আসলে পরিস্থিতির কারণেই, ‘আমাদের তো আগে তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক ছিল না। মাশরাফি ভাই যেহেতু টেস্ট খেলতেন না, উনি শুধু সাদা বলে অধিনায়কত্ব করতেন। টেস্টে আরেকজন করেছে। তারপর মাশরাফি ভাই যখন টি-টোয়েন্টিও ছেড়ে দিলেন, তখন টি-টোয়েন্টিতেও আরেকজন অধিনায়ক লেগেছে। এভাবে তিন সংস্করণে তিন অধিনায়ক হয়েছে। এমন নয় যে খুব পরিকল্পনা করে এটা হয়েছে।’
সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে তামিম ইকবালের শুরুটা ভালো হলেও নিউজিল্যান্ড সিরিজটা কেটেছে হতাশায়। টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে মাহমুদউল্লাহও এখনো পারেননি ধারাবাহিক হতে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০টি টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দিয়ে জয় মাত্র তিনটিতে। একটি জয় দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে, মিরপুরে অন্য দুটির প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে। ২০১৯ সালে ভারত সফর দিয়ে টেস্ট অধিনায়কত্ব শুরু করা মুমিনুল হকও ছয় টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে এখন পর্যন্ত শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই একটি জয় পেয়েছেন।
তিন সংস্করণে এক অধিনায়ক হলেই যে সাফল্যের ধারাবাহিকতা আসবে, সে নিশ্চয়তা নেই। তবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে দলের ভিন্ন ভিন্ন পারফরম্যান্স অধিনায়কদেরও ভিন্ন পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, সাকিবের এই কথাটা ভাবনার নতুন জানালা তো খুলে দেয়ই। একজন ব্যাটসম্যান বা বোলারের ওয়ানডের ভালো পারফরম্যান্স যেমন টেস্টের জন্যও তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তিন সংস্করণে একজনই অধিনায়ক থাকলে তিনিও হয়তো এক সংস্করণের সাফল্য থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসটাকে নিয়ে যেতে পারবেন আরেক সংস্করণে।
অধিনায়কত্ব নিয়ে এত আলোচনার পর সাকিবকে নিয়ে একটা প্রশ্ন তো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এসে যায়, আবার যদি কখনো বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সাকিব কি নেবেন তা? মৃদু হেসে সাকিবের উত্তর, ‘দেখা যাক। যদি ও রকম কোনো আলোচনা কখনো হয়, আমার সঙ্গে কেউ আলোচনা করে, তখন এটা নিয়ে ভাবা যাবে।’