ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে আরবদের সিন্ধু ও মূলতান বিজয় ছিলো এক চমকপ্রদ ঘটনা। কারণ এই বিজয়ের মধ্য দিয়েই মূলত মুসলিম শাসকরা ভারতে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। তাই এই ঘটনাটিকে ঐতিহাসিকগণ আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে দাবি করে আসছেন।
শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কাজ আসা আরবের মুসলিমরা তাদের যাপিত জীবন দিয়ে আকৃষ্ট করেছিলো নির্যাতনের শিকার মুক্তির পথ খোঁজা নিম্নর্ণের হিন্দুদের। ধীরে ধীরে তাদের এই আকৃষ্টতায় গোটা জনপদ চলে আসে মুসলিমদের কব্জায়।মতারপর শুরু হয় সিন্ধু ও মূলতান অভিযান। সিন্ধু ও মূলতানে রাজ্যশক্তির দুর্বলতা, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সামরিক দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতার জন্য সহজেই রাজ্যগুলোতে ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়। ভারত উপমহাদেশ শুরু হয় মুসলিম ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু ও মূলতান বিজয়:
উমাইয়া গোত্রের খলিফা আল ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক (৭০৫-৭১৫) ইসলামের খেলাফত গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সম্রাজ্যে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছিলো বলতে হয়। কারণ সেসময় ওয়ালিদের বিখ্যাত দুই সেনাপতি মূসা বিন নুসায়েরে নেতৃত্বে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা এবং তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন দখল করে নেন। আবার সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিমের প্রচেষ্টায় মধ্য এশিয়ায়ও ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের উৎসাহে মুহম্মদ বিন কাশিমের নেতৃত্বে আরবরা ভারতের সিন্ধু প্রদেশে অভিযান চালায়।
সপ্তম শতকে সিন্ধুই ছিলো ভারতের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য। রাজ্যটির পূর্বে কাশ্মীর, পশ্চিমে মাকরান, দক্ষিণে সমুদ্রোপকূল এবং উত্তরে কিকানন পর্বতের অবস্থান ছিলো। সিন্ধু রাজ্যের রাজধানী তখন ছিলো আলোরে। আর প্রধান বন্দর ছিলো ‘দেবল’। রাজ্যটি বাহ্মণ্যবাদ, ইস্কান্দা, সিস্তান ও মূলতান এই চার প্রদেশে বিভক্ত ছিলো। আরবের মুসলিমরা যখন এই রাজ্যে অভিযান চালায় তখন এখানকার রাজা ছিলেন রাজা চাচের পূত্র দহির।
মুসলমানদের সিন্ধু ও মুলতান অভিযানের কারণ :
মুসলিমদের সিন্ধু ও মূলতান অভিযানের কারণ ছিলো দুটি। একটি প্রত্যক্ষ কারণ অন্যটি পরোক্ষ।
পরোক্ষ কারণ:
প্রথমতঃ ভারতের বাইরে মুসলিম শাসকরা এতোটাই সামরিক সাফল্য পেয়েছিলেন যে তাদের এই মনোভাব তাদেরকে রাজ্যগ্রাসী করে তোলেছিলো। আর দ্বিতীয়তঃ যেহেতু সন্ধু এবং মূলতান ছিলো সময়ের সবথেকে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাধর রাজ্য। অন্যদিকে ভারতের অপার ধন-সম্পদের দিকে আরবদের যোগাযোগ ছিলো বহুকাল আগে থেকেই। যা আরবদের অভিযানে আরও উৎসাহ দিয়েছিলো। তৃতীয়তঃ ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়লেও সিন্ধু ও মূলতান রাজ্যটি ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী থাকার ফলে ইসলামের প্রতি বৈরি মনোভাব ও সামরিক উস্কানি সীমান্তে ইসলামের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাই তাদেরকে দমাতে আরবদের এই অভিযানের প্রয়োজন ছিলো।
প্রত্যক্ষ কারণ:
জানা যায় যে, সিংহলের রাজা আটটি উপঢৌকনসহ জাহাজ খলিফা ওয়ালিদ ও হাজ্জাজের জন্য পাঠান। কিন্তু যাত্রাপথে ঐ জাহাজগুলো সিন্ধুর দেবল বন্দরে পৌঁছালে সেগুলো লুণ্ঠন করে নেয় জলদস্যুরা। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধুর রাজা দহিরের কাছে এর প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ চাইলে রাজা দহির তা দিতে অসম্মতি জানান। ফলে রাজা দহিরের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে যান হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ক্ষুব্ধ হয়েই রাজা হাজ্জাজ সিন্ধু প্রদেশে অভিযান করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু ও মূলতান বিজয়:
সিন্ধু রাজ্যের রাজা দহিরের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধু আক্রমণের ছক আঁকতে শুরু করেন। ছক অনুযায়ী তিনি প্রথমে ওবায়দুল্লাহ ও বুদায়েল নামে দুই সেনাপতির নেতৃত্বে সিন্ধু রাজ্যে দুইটি অভিযান চালান। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এই দুইটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। এতে তিনি আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে তিনি তার সতেরো বছর বয়সী জামাতা মুহম্মদ বিন কাশিমকে প্রধান সেনাপতি করে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুতে আবারও অভিযান প্রেরণ করেন।
ঐতিহাসিকরা মুহম্মদ বিন কাশিমের এই অভিযানকে ইতিহাসের অন্যতম রোমাঞ্চকর একটি অভিযান বলে থাকেন। এই অভিযানে মুহম্মদ বিন কাশিম ৬০০০ সিরিয় এবং ইরাকি সৈন্য, ৬০০০ উষ্ট্রবাহিনী, রসদবাহী ৩০০০ উঠ নিয়ে সিন্ধু রাজ্যের দিকে এগিয়ে যান। মাঝপথে তার হাতকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন মাকরানের শাসনকর্তা হারুন। তিনি কাশিমকে আরও সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেন।
বিশাল এই সামরিক বাহিনী নিয়ে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু রাজ্যে আক্রমণ করেন। এদিকে সিন্ধু রাজ্যেও তখন চলছিলো রাজা দহিরের অত্যাচার, নিপীড়ন। রাজা দহিরের অত্যাচার, নিপীড়নের ফলে অনেক সিন্ধুবাসী তখন মুহম্মদ বিন কাশিমের সামরিক দলে যোগ দেন। যা মুহম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের পথকে আরও সহজ করে দিয়েছিলো।
সিন্ধুরাজ দহির পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৫০০০০ সৈন্য দিয়ে মুহম্মদ বিন কাশিমের বাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন।
৭১২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুন মুসলমান বাহিনী এবং সিন্ধু বাহিনীর মধ্য তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদিন মুহম্মদ বিন কাশিমের সুসজ্জিত, প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় সিন্ধু রাজাকে। আত্মাহুতি ফলে তিনি সিন্ধু যুদ্ধে নিহত হন। আর মুসলমানরা ভারতে প্রথম কোনও রাজ্য নিজেদের করায়ত্ত করে নেয়।