একসময় গোটা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মুসলিম বীর যোদ্ধারা। তাঁদের তরবারির ঝলকানি দেখে কম্পিত হয়ে উঠত কাফিরদের অন্তরাত্মা। মুহূর্তেই শক্তিশালী অমুসলিম রাষ্ট্র পদানত হয়ে যেত তাঁদের কাছে।
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)
হজরত আবু বকর (রা.) যতটা পরিচিত ছিলেন তাঁর কোমল ও নম্র ব্যবহারের জন্য, ঠিক ততটাই বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের কারণে লোকেরা ভয় পেত হজরত ওমর (রা.)-কে। ইসলামের প্রথম যুগেই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হজরত আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব গুণে ইসলাম অনেক দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। একে একে বিজয় হয় দিগ্বিদিক রাজ্যগুলো। হজরত আবু বকর (রা.) যে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন, হজরত ওমর (রা.) সেটা শেষ করেন।
৬৩৩ সালে পারস্য বিজয়ের প্রাথমিক ধাপ শুরু করেন তিনি। এই যুদ্ধ চলে ৬৫২ সাল পর্যন্ত। ধীরে ধীরে মেসোপটেমিয়ায় দুটি আক্রমণ করা হয় ৬৩৩ ও ৬৩৬ সালে। এরপর ৬৪২ সালে নাহাভান্দর যুদ্ধ হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে পারস্য বিজয় শুরু হয়। প্রতাপশালী সাসানীয় সাম্রাজ্যের হাত থেকে পারস্য কেড়ে নিতে থাকে মুসলিম বাহিনী। প্রথমে ফার্স দখল করে নেওয়া হয়, এরপর ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব পারস্য, সাকাস্তান, আজারবাইজান, আরমেনিয়া ও খোরাসান জয়ের মাধ্যমে পারস্য পুরোপুরি মুসলিমদের অধিকারে চলে আসে। ৬৩৬ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস মুসলিমদের কাছে হারানো জায়গাগুলো উদ্ধার করতে আক্রমণ চালান, কিন্তু ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন তিনি। এভাবে বীরত্বের সঙ্গে রাজ্য জয় করে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেন হজরত ওমর (রা.)।
হামজা বিন আব্দিল মুত্তালিব (রা.)
ইসলামের প্রথম দিকে যেসব অকুতোভয় আর দুঃসাহসী সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ইসলামের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছেন, হজরত হামজা বিন আব্দিল মুত্তালিব (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আপন চাচা। নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের শেষ দিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণের পর হজরত হামজা (রা.) বেশ কয়েকটি জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রথম হিজরির রমজান মাসে ‘সারিয়াতু হামাজা’য় ইসলামের সর্বপ্রথম ঝাণ্ডা তাঁর হাতে প্রদান করা হয়। ‘আবওয়া’ ও ‘জুল আশিরা’ যুদ্ধেও রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ঝাণ্ডাবাহী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে বহু কুরাইশ নেতা ও সৈন্য তাঁর হাতে নিহত হয়। দ্বিতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে সংঘটিত ‘বনু কাইনুকা’র যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তৃতীয় হিজরির ৭ শাওয়াল সংঘটিত উহুদ যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য। দুই হাতে এমনভাবে তরবারি পরিচালনা করছিলেন যে শত্রুপক্ষের কেউ তাঁর সামনে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মক্কার কুরাইশ নেতা জোবায়ের ইবনে মুতইম বদর যুদ্ধে নিহত তাঁর চাচা তুআইমা বিন আদির হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওয়াহশি (রা.)-কে নিযুক্ত করেছিলেন হজরত হামজা (রা.)-কে হত্যা করার জন্য। এর বিনিময়ে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। ওয়াহশি (রা.) তখনো মুসলমান হননি। যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি সুযোগমতো হজরত হামজা (রা.)-এর দিকে বর্শা ছুড়ে মারেন। বর্শাটি হজরত হামজা (রা.)-এর নাভির নিচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। ময়দানে পড়ে কিছুক্ষণ কাতরিয়ে শাহাদাত বরণ করেন ইসলামের এই মহান সাহাবি। এ যুদ্ধে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি একাই ৩০ জনেরও বেশি কাফিরকে হত্যা করেছিলেন। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিন উতবাহ বদর যুদ্ধে তার পিতার হত্যাকারী হজরত হামজা (রা.)-এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর বুক ছিঁড়ে কলিজা বের করে চিবাতে থাকে। এমনকি তাঁর নাক ও কান কেটে গলার হার বানায়। যুদ্ধ শেষে এই বীর যোদ্ধাকে উহুদ প্রান্তরে সমাহিত করা হয়। তাঁর জানাজায় দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করেছিলেন। একবার তাঁর সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি গত রাতে জান্নাতে প্রবেশ করে দেখলাম, জাফর ফেরেশতাদের সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে আর হামজা একটি আসনের ওপর ঠেস দিয়ে বসে আছে।’ (আল-মুস্তাদরাকে আলাছ সহিহাইন, হাদিস : ৪৮৯০; সহিহুল জামে, হাদিস : ৩৩৬৩)
আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)
তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচাতো ভাই এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বালকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলামের জন্য তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। তিনি তাঁর সসীম শক্তি ও বীরত্বের পুরোটাই ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রায় সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন। বদরের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর হাতে যুদ্ধের পতাকা তুলে দেন। এ যুদ্ধে তিনি কুরাইশদের বিখ্যাত বীর আমর ইবনে আবুদ্দোজাসহ ২০-২২ জন মুশরিককে হত্যা করেন। তাঁর অসীম বীরত্বের জন্য মহানবী (সা.) তাঁকে ‘জুলফিকার’ তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। খায়বরের যুদ্ধে কাফিরদের পরাজিত করে বিখ্যাত কামুস দুর্গ জয় করে অসাধারণ শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন। তাঁর বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে মহানবী (সা.) তাঁকে ‘আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর বাঘ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মক্কা বিজয়ের পতাকাও তিনি বহন করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরও নাহরাওয়ানের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। (তথ্য সূত্র : আসহাবে রাসুল)
খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)
‘আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরে এমন কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের আঘাতের কারণে হয়নি। এর পরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়।’ খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) (বিশ্বনবীর সাহাবি, অনুবাদ : আব্দুল কাদের)

হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ছিলেন মুসলিম ইতিহাসে এমন এক মহান সেনাপতি, যিনি রণক্ষেত্রে নিজের শক্তি ও মেধার দ্বারা ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত করেছিলেন। মিসরের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাদ ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে তাঁর সামরিক ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে বলেন, ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলিই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অসীম বাহাদুরি, অনুপম সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ মেধা, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর ওপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।’ (আবকারিয়াতু খালিদ, পৃষ্ঠা ৭৬)
ইসলাম গ্রহণের আগে ওহুদের যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ডান বাহুর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তাঁর বিচক্ষণ রণকৌশলে মুসলিম বাহিনীকে কিছুটা ধরাশায়ী হতে হয়। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মাত্র ১৪ বছর জীবিত ছিলেন। এ অল্প সময়েই তিনি মোট ১৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। দ্রুত সম্প্রসারণমান ইসলামী সাম্রাজ্য হজরত খালিদ (রা.)-এর হাতেই বিস্তৃত হয়। হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে মুসলমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে বিখ্যাত যে ইয়ারমুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)। তাঁর অসীম সাহসিকতায় মুসলমানরা বিজয় লাভ করে। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। সামরিক ইতিহাসে এই যুদ্ধ অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়।
মুতার যুদ্ধে তিনি এতটাই বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন যে তাঁর হাতে ৯টি তরবারি ভেঙে যায়। এ প্রসঙ্গে সহিহ বুখারিতে স্বয়ং খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘মুতার যুদ্ধে আমার হাতে ৯টি তলোয়ার ভেঙেছে। এরপর আমার একটি ইয়ামানি তলোয়ার অবশিষ্ট ছিল।’ (সহিহ বুখারি, মুতার যুদ্ধ অধ্যায় : ২/৭১১)
হজরত খালিদ (রা.)-এর রণনিপুণতায় খুশি হয়ে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মক্কা বিজয়, হুনাইনের যুদ্ধ, তায়েফ বিজয় ও তাবুক অভিযান উল্লেখযোগ্য। তিনি খলিফা হজরত আবু বকর ও খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালেও বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি
তাঁর আসল নাম ইউসুফ। ছোটবেলা থেকেই ইউসুফ (আ.)-এর মতো রূপ-সৌন্দর্য, চরিত্র-মাধুর্য আর ঈমানি শক্তিতে তিনি ছিলেন বলীয়ান। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কৌশলের ওপর গভীর জ্ঞান ও আগ্রহের কারণে চাচা শেরেকাহ ও নুরুদ্দিন জঙ্গি তাঁকে স্পেশাল প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এর পরই নুরুদ্দিন জঙ্গি তাঁকে মিসরের গভর্নরের পদের জন্য মনোনীত করেন।
১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ ফাতেমি খিলাফতের কেন্দ্রীয় খলিফার নির্দেশে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (র.) গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসর আগমন করেন। তাঁর বহু আগে থেকেই (দ্বাদশ শতাব্দীতে) ইউরোপ, ফ্রান্স ও জার্মানির ক্রুসেড শক্তি ইসলামী রাষ্ট্র ভেঙে ফেলার জন্য ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ নেন। ইসলামের নাম-নিশানা মুছে দিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্রুশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু করে নানা চক্রান্ত। সেই সঙ্গে তারা একের পর এক চালায় সশস্ত্র অভিযান। মুসলিমদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দখল করে রাখে ইসলামের মহান স্মৃতিচিহ্ন প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) মিসরের স্থায়িত্ব আনার পরই বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করতে বেরিয়ে পড়েন। তিনি সর্বপ্রথম খ্রিস্টানদের ফিলিস্তিনের শোবক দুর্গ অবরোধ করে জয় করে নেন। পরে নুরুদ্দিন জঙ্গির সহায়তায় কার্ক দুর্গও জয় করেন। কার্ক দুর্গ অবরোধের সময় ক্রুসেডদের সহায়তায় সুদানিরা আবারও মিসরে সমস্যা তৈরি করতে চাইলে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) কার্কের অবরোধ নুরুদ্দিন জঙ্গিকে নিয়ে মিসরে চলে আসেন। পরে নুরুদ্দিন জঙ্গি কার্ক দুর্গসহ ফিলিস্তিনের আরো কিছু জায়গার দখল সম্পন্ন করেন।

ফিলিস্তিনের শোবক ও কার্ক দুর্গ পরাজয়ের প্রতিশোধস্বরূপ ক্রুসেডাররা পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। স্পেনের পূর্ণ নৌবহর এবং ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামের সেনারা যুক্ত হয় এতে। তাদের সাহায্যে আসে গ্রিস ও সিসিলির জঙ্গি কিশতি। এদিকে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) গোয়েন্দা মারফত তাদের আগমন ও সর্বপ্রথম মিসরের উপকূলের আলেকজান্দ্রিয়া অঞ্চল আক্রমণের খবর পেয়ে যান।
প্রায় ছয় লাখ সেনার বিশাল আক্রমণ সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) মাত্র ২০ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সেনা দিয়ে প্রতিরোধ করেন। রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ হয়। মুসলমানরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এরপর সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ১১৮৭ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেন। অন্য পক্ষ খ্রিস্টানরাও তাদের দখল করা ভূমি ছাড়তে নারাজ। শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষ হয়। হাঁটু পর্যন্ত বয়ে যায় রক্তের স্রোত। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী পরাজয় বরণ করে ৬ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে নিজ দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) বিজয়ী বেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। এটি ছিল সেই রাত, যেদিন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে মিরাজে গমন করেন। এ বিজয়ের ফলে প্রায় ৯০ বছর পর ক্রুসেডারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায় ফিলিস্তিনের মুসলমানরা।
মোহাম্মদ বিন কাসিম
তিনি ছিলেন উমাইয়া সাম্রাজ্যের একজন বিখ্যাত সেনাপতি। সিন্ধু নদসহ সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চল তিনি জয় করে উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। ইতিহাস খ্যাত এই বীর ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন।

ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর চাচার কাছ থেকে যুদ্ধবিদ্যা শেখেন। বাদশাহ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি পারস্যের গভর্নর হন। সেখানের সব বিদ্রোহ দমন করে সবার নজর কাড়েন। তাঁর সিন্ধু জয়ের ফলে মুসলমানদের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশ বিজয়ের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়।
সুলতান মাহমুদ গজনভি
অসামান্য বীরত্বের জন্য সুলতান মাহমুদ গজনভি (রহ.) সবার হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। ইতিহাস বিখ্যাত এই বীর মোট ১৭ বার ভারতে অভিযান চালান এবং শেষে বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তিনি ৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে আফগানিস্তানের গজনি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সবুক্তগিন ছিলেন তুর্কি ক্রীতদাস ও সেনাপতি। তিনি ৯৭৭ সালে গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি ছিলেন গজনভি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মহান শাসক। ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সাল অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইরান ও ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ জয় করেন। তিনি তাঁর সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেন। তাঁর সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে ছিল। তিনি সুলতান উপাধিধারী প্রথম শাসক, যিনি আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করে নিজের শাসন চালু রেখেছিলেন।
সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি
ভারতের মুসলিম শাসকদের অন্যতম প্রতাপশালী শাসক ছিলেন আলি গারসাপর ওরফে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। তিনি ১২৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শিহাবুদ্দিন খিলজি। ১২৯৬ সালের ১৯ জুলাই খিলজি রাজবংশের প্রথম সুলতান জালালউদ্দিন মালিক ফিরোজ খিলজির মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লির সিংহাসনে সমাসীন হন। ১২৯০ সালে সুলতান জালালউদ্দিন খিলজি তাঁকে ‘আমিরে তুজুক’ পদে নিয়োগ দেন। এর এক বছর পরই অর্থাৎ ১২৯১ সালে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের এক ভ্রাতুষ্পুত্রের বিদ্রোহ দমন করে সফলতা লাভ করলে জালালউদ্দিন খিলজি তাঁকে ‘আলাউদ্দিন’ উপাধি দান করেন। এর পরই তিনি কারার গভর্নরের দায়িত্ব পান।
আলাউদ্দিন খিলজি ছোটবেলা থেকেই একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তরবারি কিংবা অশ্ব, উভয়ই চালানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। একাধারে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক, চৌকস জেনারেল আর দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। মৌর্য সম্রাট অশোকের পর তাঁকেই একমাত্র সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি গোটা হিন্দুস্তানকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিলেন। তিনি এত বেশি পরিমাণ শহর আর নগর জয় করেছিলেন যে তাঁকে সিকান্দার সানি বা দ্বিতীয় আলেক্সান্ডার উপাধিও দেওয়া হয়েছিল।
হিন্দুস্তানের ইতিহাসে বিজেতাদের তালিকা করতে গেলে নিঃসন্দেহে তাঁর নাম ওপরের দিকেই থাকবে। একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজেতা হিসেবে তিনি ১২৯৬ সালে ইলখানি রাজ্যের শাসক গাজান মাহমুদকে পরাজিত করে সিন্ধু দখল করেন। ১২৯৯ সালে চাগতাই খান দুয়া খানকে পরাজিত করে পাঞ্জাব নিজের দখলে নেন। ১৩০১ সালে রণথম্বোর, ১৩০৩ সালে চিতোর, ১৩০৫ সালে মান্দু সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির পদানত হয়। এ ছাড়া তাঁর হাতে নাহান, সিরমুর ও জম্মু আর দেবগিরির পতন হলে অন্যান্য রাজপুত রাজারা তীব্র আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। মালবের রাজা মাহালক সুলতানকে বাধাদানের চেষ্টা করতে গিয়ে পরাজিত হন। ফলে মালব সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির পদানত হন। একই সঙ্গে চান্দেরি আর ধারার পতন ঘটে। ১৩০৮ সালে মারওয়ারের রাজা সতল দেবের পরাজয়ের পর মারওয়ার সুলতানের অধীনে চলে যায়। এরপর মালিক কামালউদ্দিনের নেতৃত্বে জয় করা হয় রাজপুত জালোর রাজ্য। ১৩০৬ আর ১৩০৭ সালে রাজা রায় করণ আর তাঁর মিত্র রাজা রায় রামচন্দ্রকে পরাজিত করা হয়। রাজা রায় রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মালিক কাফুর। তবে পরবর্তী সময়ে রাজা রায়চন্দ্রকে ‘রায় রায়হান’ খেতাব দিয়ে আবার তাঁকে রাজ্য চালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে গুজরাটও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ১৩০৯ সালে রাজা রায় রামচন্দ্রের সহায়তায় মালিক কাফুরের নেতৃত্বে বারাঙ্গল জয় করা হয়। বারাঙ্গল অভিযানের সময়ই কাকাতিয়া রাজবংশের রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব থেকে আলাউদ্দিন খিলজি বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটি অর্জন করেন। ১৩১১ সালে হোয়াসালা রাজা বীর বাল্লারার বিরুদ্ধে অভিযান চালালে রাজা বীর বাল্লারা আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর শাসনামলে বর্বর মঙ্গলরা মোট ১৬ বার হিন্দুস্তানে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু প্রতিবারই তারা হিন্দুস্তানের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির হাতে পরাজিত হয়ে ফেরত যায়। মঙ্গলদের তিনি এত কঠোরভাবে দমন করেন যে এই ১৬টি যুদ্ধে প্রায় তিন লাখ মঙ্গল সেনা তাঁর হাতে নিহত হয়। ১৩০৮ সালের পর মঙ্গলরা ভুলেও আর হিন্দুস্তানের দিকে তাদের বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকাতে সাহস করেনি।
সম্রাট বাবর
ভারতের মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট বাবর। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অল্প বয়স হলেও মেধা, সাহস আর বীরত্বের গুণে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তিনি নিজেকে সিংহাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পুরো নাম জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর। ১৪৮৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তুর্কিস্তানের খোকন্দে তাঁর জন্ম।

পিতা ওমর শেখ মির্জা ছিলেন পরগনার অধিপতি। বাবর ছিলেন সম্রাট তৈমুর লংয়ের বংশধর। তাঁর মা ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধরের কন্যা। মাত্র ১১ বছর বয়সে পরগনার শাসক হিসেবে বাবরকে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়। ১৪ বছর বয়সে তিনি তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ অধিকার করেন। হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে যখন কাবুল অধিকার করেন, তখন বাবরের বয়স ২১। এরপর একে একে গজনি, কান্দাহারসহ বিভিন্ন অঞ্চল বাবরের অধিকারে আসে। ইতিহাস খ্যাত পানিপথের যুদ্ধে এই বীর যোদ্ধা দিল্লির অদূরে পানিপথ প্রান্তরে দিল্লির শাসক ইবরাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতে মোগল রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর রাজত্ব পশ্চিমে হীরা থেকে পূর্বে বিহার এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে চান্দেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাবর ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক, বীর সেনানায়ক, বিদ্যানুরাগী, সংগীতজ্ঞ ও সুলেখক। তুর্কি ও ফারসি ভাষায় তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। তুর্কিতে ‘তুজুক-ই-বাবর’ নামে একটি আত্মরচনা করেন তিনি। চেতনায় বাবর ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক। প্রজাদের কাছেও তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৪৭ বছর বয়সে বাবর মারা যান।
উসমান গাজী
উসমান গাজী ছিলেন প্রথম উসমানীয় সুলতান। উসমানীয় তুর্কিদের এই নেতা বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। সেলজুকদের ভাঙনের পর আনাতোলিয়ায় ছোট ছোট যে কটি তুর্কি রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার একটি ছিল উসমানীয় রাজ্য। মঙ্গলরা পশ্চিম দিকে রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করলে মুসলিমরা উসমানের রাজ্যে আশ্রয় নেয়। উসমান গাজীর দূরদর্শিতা ও রণকৌশলের ফলে মুসলমানরা সামরিকভাবে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। উসমানের বাবার মৃত্যুর পর রাজ্যের দায়িত্ব কাঁধে নেন উসমান।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তারা মরিয়া ছিল। উসমানের দক্ষ নেতৃত্বে এই যোদ্ধারা জীবন বাজি রাখে। উসমান প্রথম দিকে বাইজেন্টাইনদের দিকে সীমানা বাড়াতে চাইলেন। এ সময় তুর্কি প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়ে তিনি সবাইকে চমকে দেন। এই যুদ্ধগুলোয় বিজয় লাভের মাধ্যমে সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকেন তিনি। পরাজিত অঞ্চল দখল ছাড়াও বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য তাঁর অধীন হয়। স্ট্যানফোর্ডের বক্তব্য অনুযায়ী, সেলজুকদের আধিপত্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উসমান গাজী সামরিকভাবে তাঁর প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন। তিনি এসকিশেহির ও কারাজাহিসার দুর্গ দখল করেন। ইয়েনিশেহির নিজের করে নিয়ে উসমানীয়দের রাজধানী ঘোষণা করেন।
টিপু সুলতান
ভারতবর্ষে মুসলিম বীর যোদ্ধাদের খোঁজ করলে সবার আগে আসবে টিপু সুলতানের নাম। ব্রিটিশ-ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তাঁর বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তাঁর বাবা পেরে উঠতে পারেননি। এই পরাজয়ে টিপু সুলতান আরো বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। মহীশূরের স্থানীয় ভাষায় ‘টিপু’ শব্দের অর্থ হলো বাঘ। টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ। এই বাঘ ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার মতো। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। তাঁর বাবা মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন।

বাবার মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। তিনি নতুন একটি সিংহাসন বানান। আট কোণার ওই সিংহাসনের ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। তাঁর সব পরিধেয় পোশাক ছিল হলুদ-কালো রঙে ছাপানো আর বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। সেনাদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লমেও আঁকা থাকত বাঘের প্রতিরূপ। বাঘের মতো দুর্ধর্ষ ও ক্ষিপ্র ছিলেন টিপু সুলতান। ব্রিটিশ বাহিনীও যুদ্ধ-ময়দানে তাঁর ক্ষিপ্রতা, বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করত। যুদ্ধ-ময়দানে তাঁর দুর্ধর্ষ চেহারার কারণে তাঁকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ। তাঁর যুদ্ধ বীরত্বগাথা এখনো মুসলমানদের প্রেরণা জোগায়।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতু ইলয়াস আল ইসলামিয়া টঙ্গী, গাজীপুর।