Image default
খ্রিষ্টান

যেভাবে এল আজকের ক্রিসমাস ক্যারল

‘ক্যারল’ শব্দের অর্থ ভক্তিগীতি, সংকীর্তন বা ভজন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হাজার বছর ধরে এই গানগুলো গাওয়ার চল। তবে তা আজ আমরা যাকে ক্রিসমাস ক্যারল বলে জানি, অতীতে তা এমন ছিল না। গানগুলো ‘সলস্টিক’ নামে শীতকালীন এক উৎসব উদ্‌যাপনের সময় মাঝখানে পাথরের স্তূপ বানিয়ে তার চারদিকে নাচতে নাচতে গাওয়া হতো। সেদিক থেকে দেখলে এই অনুষ্ঠানের ধরনটি ছিল পৌত্তলিক। অনুষ্ঠানটি সাধারণভাবে শীতকালে হলেও মূলত বছরের সবচেয়ে ছোট দিন, অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়েই এটি অনুষ্ঠিত হতো।

ছবিঃক্রিসমাস ক্যারল (সংগৃহীত)

ক্যারল উৎসব প্রথম দিকে বছরের চার মৌসুমে চারবার অনুষ্ঠিত হতো। তবে চারবারের মধ্যে তিনটি গিয়ে একটি টিকে আছে। বছরের সবচেয়ে ছোটদিন বা ক্রিসমাসের কাছাকাছি সময়ে ডিসেম্বর মাসে উৎসব উদ্‌যাপনের এই ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে। যেহেতু ক্রিসমাস বা যিশুর জন্ম উদ্‌যাপন এই ডিসেম্বরে করা হয় এবং ক্যারল উৎসবও যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে উদ্‌যাপন করা হয়, তাই প্রথম দিকে যখন খ্রিষ্টানরা ক্যারল গাওয়া শুরু করে, তারা পৌত্তলিকতার পরিবর্তে গানগুলোর বিষয়বস্তু বদলে তা খ্রিষ্ট ধর্মবিষয়ক গানে রূপ দেয়।

খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তনের গোড়ার দিকে, অর্থাৎ সেই ১২৯ সালে প্রথমবারের মতো একজন রোমান বিশপ প্রস্তাব করেন, রোমে ক্রিসমাস সার্ভিসের সময় সব ক্যারলগুলোর মধ্যে অন্তত একটি গান ‘দেবদূতের স্তোত্র’ নামে রচনা করে গাওয়া উচিত। এর কয়েক শতাব্দী পর ৭৬০ সালে, ‘কোমাস’ নামে জেরুসালেমের এক অধিবাসী, গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের জন্য একটি বিখ্যাত ক্রিসমাস স্তোত্র রচনা করেছিলেন। এ দুটি বেশ জনপ্রিয় হওয়ার পরই সারা ইউরোপে এর আবেদন বেড়ে যায় এবং বেশ কিছু সংগীতজ্ঞ ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ লিখতে শুরু করেন। কিন্তু মুশকিল হলো, জনসাধারণের বেশির ভাগই এগুলো পছন্দ করত না। তার কারণ, এগুলোর সবই ল্যাটিন ভাষায় লেখা। সাধারণ মানুষ এসব গানের অর্থই বুঝত না। এভাবেই মধ্যযুগ বা ১২০০ সালের মধ্যেই সাধারণ মানুষ ক্রিসমাস ক্যারল উৎসব উদ্‌যাপনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

এর পর ১২২৩ সালে যখন ইতালির আসিসি অঞ্চলের সেন্ট ফ্রান্সিস নামের এক ভদ্রলোক তাঁর ‘নেটিভিটি’ নাটক শুরু করেন, তখন অবস্থাটি পুরোপুরি পাল্টে যায়। নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রীরা নাটক চলাকালে গল্পচ্ছলে গান বা ‘ক্যানটিকল’ গাইতেন। এই নতুন ক্যারলের কোরাস অনেকটাই ল্যাটিন ভাষায় হলেও এগুলো এমন সহজ করে দেওয়া হয়েছিল যেন, নাটকের দর্শকেরা তা বুঝতে পারে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারে! এভাবেই নতুন ক্যারল সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

১৪১০ সালে লেখা একটি ক্যারলের ক্ষুদ্র অংশ এখনো বিদ্যমান। এই ক্যারলের বিষয়বস্তু ছিল মরিয়ম (মেরি) ও যিশুর বেথলেহেমে গিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও মতবিনিময়। এই সময়কার এবং এলিজাবেথীয় যুগে রচিত অধিকাংশ ক্যারল অসত্য গল্প, খুব হালকা ও অসংলগ্নভাবে সাজানো ক্রিসমাসের গল্প এবং যিশুর পরিবার সম্পর্কে রচিত হলেও সেগুলো ধর্মীয় উপাদানের বদলে বিনোদনমূলক গান হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ছাড়া এগুলো গির্জার বদলে বাড়িতে বাড়িতে গাওয়া হতো! আরও মজার ব্যাপার হলো পরিব্রাজকেরা যখন যে অঞ্চলে ভ্রমণ করতেন, তখন তাঁরা সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা ও স্থানীয় জনগণের চিন্তাধারার গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে গানের শব্দ পরিবর্তন করতেন। ‘আমি তিনটি জাহাজ দেখেছি’ ক্যারলটি তার একটি প্রমাণ।

১৬০০ সালে যখন পিউরিটানরা বা কট্টর খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা ইংল্যান্ডে ক্ষমতায় আসে, তখন ক্রিসমাস উদ্‌যাপন ও ক্যারল গাওয়া একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যা হোক, যেমন রাশিয়াতে ধর্ম বা তার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হলেও ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলামে দীক্ষিত ধর্মপ্রাণদের অনেকেই গোপনে ধর্ম পালন করত, সেভাবেই ইংল্যান্ডে গোপনে গোপনে ক্যারলগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল। ভিক্টোরিয়ান যুগে উইলিয়াম স্যান্ডিস ও ডেভিস গিলবার্ট নামে দুই ব্যক্তি ইংল্যান্ডের গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচুর পুরোনো ক্রিসমাস সংগীত সংগ্রহ করেন। প্রথম দিকে ক্যারল ‘পাব’ বা পানশালার মতো জায়গায় লোকসংগীত হিসেবে গাওয়া হতো। কিন্তু সেগুলো মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের কাছে গেঁয়ো; অর্থাৎ সুন্দর, রুচিশীল গান হিসেবে বিবেচিত হতো না (ইংল্যান্ডের উত্তরে, বিশেষ করে নর্থ ডার্বিশায়ার ও সাউথ ইয়র্কশায়ারে এসব এখনো চলে)। তবে গির্জার মতো জায়গায় ক্যারল গান জনপ্রিয় হয় আরও অনেক পরে। এ জন্য অফিশিয়াল ক্যারল গায়কদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আরও পরে ইংল্যান্ডের শহরগুলোতে অনেক অর্কেস্ট্রার ব্যবহার ও সেই সঙ্গে উন্নতমানের সংগীত পরিবেশন শুরু হয়। অনেকে এগুলো ব্যবহার করে ক্রিসমাসের গান গাওয়া শুরু করে এবং এভাবেই ক্রিসমাস ক্যারল আবার গির্জা ও কনসার্ট হলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক নতুন ক্যারল ওই ভিক্টোরিয়ান যুগেই লেখা।

১৮১৯ সালে কিংবদন্তী লেখক ওয়াশিংটন আরভিং লিখেন দ্য স্কেচবুক অফ জোফ্রে ক্রেয়ন নামের একটি গল্পের সিরিজ। গল্পগুলো ছিলো একটি খাদ ইংরেজ পরিবারে তার কাটানো ক্রিসমাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তার এ বইটি আমেরিকায় ক্রিসমাসের উদযাপন পরিবর্তনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। আরো এক প্রথিতযশা লেখক চারলস ডিকেন্সের ‘দ্য ক্রিসমাস ক্যারল’ বইটির ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এ বইটির মাধ্যমে ডিকেন্স দেখান যে, ধনী গরিবের ভেদাভেদ ভোলার জন্য একটি বড়সড় ধর্মীয় ছুটির দিন কতটা প্রয়োজন! যুক্তরাষ্ট্রে ও ইংল্যান্ডে ডিকেন্সের এ মতবাদ বেশ প্রভাব ফেলে।এভাবেই প্রগতিশীলদের অবদানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসমাস অনুষ্ঠান আজকের জনপ্রিয়তার পর্যায়ে পৌঁছায়। একটি উঠতি জাতি হিসেবে ক্রিসমাস হয়ে আসে মার্কিনদের আনন্দের উপলক্ষ।

এ ছাড়া নতুন নতুন ক্যারল সেবার (সার্ভিস) সৃষ্টি হয় এবং তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাস্তায় ক্যারল গাওয়ার প্রথা এমনই এক উদাহরণ। ক্যারল পরিষেবার সবচেয়ে জনপ্রিয় দিক হলো ক্যান্ডেল লাইট সার্ভিসের সঙ্গে ক্যারল। এই সেবায়, গির্জা শুধু মোমবাতি দ্বারা আলোকিত হয় এবং সেটি একটি দারুণ ক্রিসমাস পরিবেশ সৃষ্টি করে। এখন মোমবাতি জ্বালা ক্যারল গান বা ক্যান্ডেল লাইট ক্যারল বিশ্বের নানা দেশে অনুষ্ঠিত হয়। ক্যারল সার্ভিসের সবচেয়ে বিখ্যাতটি হলো ‘আ ফেস্টিভ্যাল অব নাইন লেসনস অ্যান্ড ক্যারলস’। এগুলোর মধ্যে ক্যারলও আছে, আবার বাইবেল রিডিংও আছে। বলা যায়, এর মধ্যে ক্রিসমাসের নানা গল্প নিহিত আছে।

Leave a Comment