ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ১৭ এপ্রিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর এই দিনে মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান উপজেলা মুজিবনগর) গ্রামের আমবাগানে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিপ্লবী সরকার) শপথ গ্রহণ করেছিলো।
কেউ আম্রকানন বলেন আবার কেউ বলেন আম বাগান। আমি আম বাগানই বললাম। এমন চমৎকার আম বাগানটির মালিক ছিলেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই দিনে দিনে জায়গাটির নাম হয়ে ওঠে বৈদ্যনাথ তলা। আমবাগান বা বৈদ্যনাথ তলাতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা, পাঠ করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। শপথ গ্রহণ এবং ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথ তলার নাম রাখেন মুজিবনগর।
দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু জায়গাটি সঠিকভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনার পর মুজিবনগর সরকারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের দিন মুজিবনগর স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা এটি। ১৯৭১-এর অস্থায়ী সরকারের শপথসহ মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতিসৌধ। নকশা করেন স্থপতি তানভীর করিম।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মূল কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। ২৩ স্তরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। স্মৃতিসৌধের নকশা স্থপতি তানভীর করিম। এরপর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা মুজিবনগর কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজে হাত দেন।
এক নজরে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স :
প্রায় ৮০ একর জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। এখানে আম গাছ রয়েছে ১৩০০। তিনটি ধাপে ছয় স্তর বিশিষ্ট দুটি গোলাপ বাগান। বাগান দুটিতে গোলাপগাছ আছে ২২০০। এখানে আছে বঙ্গবন্ধু তোরণ, অডিটোরিয়াম, শেখ হাসিনা মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকেন্দ্র, মসজিদ, হেলিপ্যাড, ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ দেয়ালের সমন্বয়ে উদিয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিকে প্রতীক করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, প্রশাসনিক ভবন, টেনিস মাঠ, পর্যটন মোটেল, স্বাধীনতা মাঠ, স্বাধীনতা পাঠাগার, বিশ্রামাগার, পোষ্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, শিশুপল্লী, ডরমেটরি ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে ভাগ করে দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। মানচিত্রের ডিজাইন করেছে বুয়েট আর্কিটেক্টদের সংগঠন বিআরটিসি।
কমপ্লেক্সের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, ঐতিহাসিক তেলিয়া পাড়া সম্মেলন, মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, পাকবাহিনীর আত্নসমর্পণ, রাজাকার আল বদর, আল সামস এর সহযোগিতায় বাঙ্গালী নারী পুরুষের ওপর পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনসহ খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানীর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স। অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের মাঝে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন ঘটনাচিত্র।
ঐতিহাসিক ৬ দফার রূপক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ৬ ধাপের গোলাপ বাগান। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। কমপ্লেক্সের বাইরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায় মুক্তিকামী বাঙালির উপর পাকিস্তানি হানাদারদের নির্যাতন, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন ঘটনা স্থাপত্যকলার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
লাল মঞ্চ :
১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার যে স্থানে শপথ গ্রহণ করে ঠিক সেই স্থানে ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত সিরামিকের ইট দিয়ে একটি আয়তকার লাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। যা মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের ভিতরে মাঝখানে।
২৩টি স্মৃতি স্তম্ভ :
সৌধটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হল, ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের উপর মূল বেদিকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চি পুরু ২৩টি দেয়াল, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। সৌধের ২৩টি স্তম্ভ ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের সংগ্রামের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে সৌধে বসানো হয়েছে ৩০ লাখ পাথর। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক স্মৃতিসৌধের বেদিতে আরোহণের ৯টি ধাপ। প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে যেগুলোকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে।
এক লক্ষ বুদ্ধিজীবির খুলি :
স্মৃতিসৌধটির ভূমি থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদীতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত রয়েছে যা দ্বারা ১ লক্ষ বুদ্ধিজীবির খুলিকে বোঝানো হয়েছে।
ত্রিশ লক্ষ শহীদ :
স্মৃতিসৌধের ভূমি থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীতে অসংখ্য পাথর রয়েছে যা দ্বারা ৩০ লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের সম্মানের প্রতি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও স্মৃতিচারণা প্রকাশ করা হয়েছে। পাথরগুলো মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের ১৯টি জেলাকে বুঝানো হয়েছে।
এগারোটি সিঁড়ি :
স্মৃতিসৌধের বেদীতে আরোহণের জন্য ১১টি সিঁড়ি রয়েছে। যা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে যে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল তা বুঝানো হয়েছে।
বঙ্গোপসাগর :
স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশের আম বাগান ঘেঁষা স্থানটিতে মোজাইক করা আছে তার দ্বারা বঙ্গোপসাগর বোঝানো হয়েছে। বঙ্গোপসাগর যদিও বাংলাদেশের দক্ষিণে, কিন্তু শপথ গ্রহণের মঞ্চটির সাথে স্মৃতিসৌধের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য এখানে এটিকে উত্তর দিকে স্থান দেয়া হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক :
স্মৃতিসৌধের মূল ফটকের রাস্তাটি মূল স্মৃতিসৌধের রক্তের সাগর নামক ঢালকে স্পর্শ করেছে। এখানে রাস্তাটি ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
রক্তের সাগর :
স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ তৈরি করা হয়েছে যাকে রক্তের সাগর বলা হয়।
সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতা :
লাল মঞ্চ থেকে যে ২৩টি দেয়াল তৈরি করা হয়েছে তার ফাঁকে অসংখ্য নুরি-পাথর দ্বারা মোজাইক করে লাগানো হয়েছে। যা দিয়ে ১৯৭১ সালের সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতাকে প্রতীক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মুজিবনগর আমবাগান :
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সামনেই ঐতিহাসিক এ আম্রকানন। প্রায় চল্লিশ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ বাগানে সহস্রাধিক আমগাছ রয়েছে। ঐতিহাসিক এ বাগানেই হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। বাগানটি এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। ছায়াঢাকা পুরো বাগান পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর থাকে সবসময়।
যেভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে সড়কপথে সরাসরি মুজিবনগর যাওয়া যায়। এছাড়া বাসে মেহেরপুর জেলা সদর, সেখান থেকে সহজেই যাওয়া যায় মুজিবনগর। মেহেরপুর সদর থেকে মুজিবনগরের দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার।
ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে জে আর পরিবহন, মেহেরপুর ডিলাক্স, চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স এবং শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি যায় মেহেরপুর ও মুজিবনগর। ভাড়া ৩৫০-৫০০ টাকা।
নিজস্ব বাহন নিয়ে গেলে পাটুরিয়ার ফেরি পারাপারের ঝক্কি এড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, পাবনা অতিক্রম করে লালনশাহ সেতু (পাকশী সেতু) পেরিয়ে মেহেরপুর যাওয়া যায়।
যেখানে থাকবেন :
মুজিবনগরে থাকার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল ‘মুজিবনগর’ নির্মাণ করা হলেও সেখানে নেই পানি ও বিদ্যুত। তবে মুজিবনগরে আছে মেহেরপুর জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ‘সূর্যোদয়’। কক্ষ খালি থাকলে এখানে থাকা যায়। মেহেরপুর জেলা সদরেও সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে।
বাস স্টেশনের কাছে আছে ফিন টাওয়ার হোটেল, নাইট বিলাস হোটেল এবং শাহজাদী আবাসিক হোটেল। বড় বাজারের কাছে আছে হোটেল মিতা, হোটেল অবকাশ, হোটেল অনাবিল ইত্যাদি। এসব হোটেলে ১শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।