যুদ্ধ মানেই কৌশল। যুদ্ধে যারা যত বেশি রণকৌশল প্রদর্শন করতে পারে, জয়ের পাল্লা তাদের দিকেই ততবেশি ঝুঁকে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ১৯৭১ সালের ২৬ই মার্চ এদেশের মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম এদেশের মানুষের কাছে ছিল না। এমতাবস্থায় স্বাধীনতার যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য বাঙালিদেরকে বিভিন্ন রণকৌশল গ্রহণ করতে হয়। এসব রণকৌশলেরই একটি পদক্ষেপ ছিল পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে ফেলা।
বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র দেশকে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল প্রথমে ৪টি এবং পরের দিন ১১ই এপ্রিল সংশোধন করে ১১টি সেক্টর ও ৬৪টি সাব-সেক্টরে ভাগ করেন। যার ফলে পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনা করা অনেক সহজ হয়ে ওঠে। কীভাবে ভাগ করা হয়েছিল এই সেক্টরগুলো এবং কারা ছিলেন এসব সেক্টরের দায়িত্বে, এসব বিষয়েরই আদ্যোপান্ত আজ আপনাদেরকে জানাবো।
সেই লক্ষ্যে ৪ এপ্রিল সিলেটের হবিগঞ্জ মহকুমার সীমান্ত সংলগ্ন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাকবাংলোয় কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও যশোর- এই চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এই চার অঞ্চল বিভক্তি থেকে সরে আসে নীতিনির্ধারকেরা। ১১ এপ্রিল শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সমগ্র দেশকে আটটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে আটজন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগের ঘোষণা দেন।
২ নম্বর সেক্টর
ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও নোয়াখালী নিয়ে গঠিত হয় ২ নম্বর সেক্টর। ৪- ইস্টবেঙ্গল, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ইপিআর বাহিনী নিয়ে গঠিত হয় এ সেক্টরটি। সদরদপ্তর ছিলো আগরতলার ২০ মাইল দক্ষিণে মেলাঘরে।
মেজর খালেদ মোশাররফ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার পদে নিযুক্ত ছিলেন। পরে মেজর এটিএম হায়দার সেবছর ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।
প্রধান নদ-নদী
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বাদেও আরো যেসব নদ আর নদী বয়ে গেছে ২ নং সেক্টরকে আলিঙ্গন করে- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কালীগঙ্গা, ইছামতি, বংশী, তুরাগ, ডাকাতিয়া, কাটাখালী, রহমতখালী, ভুলুয়া, মুহুরী, সালদা, কুমার, গড়াই, কীর্তিনাশা, আড়িয়াল খাঁ, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ইত্যাদি। সামান্য কিছু উঁচু অঞ্চল বাদে এই সেক্টর মোটামুটি পলিগঠিত এক সমতল ভূমি।
সেক্টর এলাকা
২ নং সেক্টর এলাকা বৃহত্তর ঢাকা (মূলত ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ), কুমিল্লা (আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে), ফরিদপুরের পূর্বাঞ্চল ও নোয়াখালীর অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে) নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ (বর্তমানের সাপেক্ষে) লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশবিশেষও ছিল এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ২ নং সেক্টরের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা, দক্ষিণ-পূর্বে ১ নং সেক্টর, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, উত্তরে ৩ নং সেক্টর, উত্তর-পশ্চিমে যমুনা নদী ও ৭ নং সেক্টর, পশ্চিমে ৮ নং সেক্টর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ৯ নং সেক্টরের অবস্থান। ২ নং সেক্টরের আয়তন প্রায় ১৯, ৫২৬ বর্গ কিলোমিটার। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য এই আয়তনকে আনুমানিক ১৭,৬৫৮ বর্গ কিলোমিটারও বলা হয়েছে।
সদর দপ্তর: ভারতের আগরতলা রাজ্যের মেলাঘর
সেক্টর কমান্ডার: মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল থেকে অক্টোবর) এবং মেজর এটিএম হায়দার (অক্টোবর থেকে ১৬ ডিসেম্বর)
সাব-সেক্টরের সংখ্যা: ৬টি; গঙ্গাসাগর, মন্দভাগ, সালদা নদী, মতিনগর, নির্ভয়পুর, রাজনগর।
স্টাফ অফিসার: মেজর আবদুল মতিন ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলম।
মেডিক্যাল অফিসার: ক্যাপ্টেন আকতার আহমেদ।
সেক্টর বাহিনী: ২ নং সেক্টর বাহিনী গঠিত হয়েছিল নিয়মিত বাহিনীর সাথে সাবেক ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও বেসামরিক জনগণকে সাথে নিয়ে। সেক্টর বাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটি ছিল প্রায় ৮ হাজার সদস্যের নিয়মিত বাহিনী আর অপরটি ছিল গণবাহিনী যা মোট বাহিনীর প্রায় ৮১ শতাংশ। গণবাহিনীতে প্রায় ৩৫ হাজার দেশপ্রেমিক সদস্য ছিল।
বাংলাদেশ হাসপাতাল
এই সেক্টরের উল্লেখযোগ্য হাসপাতালটির নাম বাংলাদেশ হাসপাতাল। মে মাসে এটি আগরতলার সোনামুড়ায় স্থাপিত হয়। জুলাই মাসে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সীমান্ত এলাকা থেকে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী আগরতলাস্থ দারোগা বাগিচায় স্থানান্তরিত হয়। আগস্ট মাসে এই হাসপাতাল আগরতলার সন্নিকটে শ্রী হাবুল ব্যানার্জির বাগানে (বিশ্রামগঞ্জ) স্থানান্তর ও সম্প্রসারিত করা হয়। এই হাসপাতালটি ছিল দু’শ শয্যার। ডা. জাফরউল্লা চৌধুরী, ডা. মবিন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়নরত বহু ছাত্র-ছাত্রী এই হাসপাতালের নির্ঘুম চোখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
শহর, শহরতলী ও অঞ্চলভিত্তিক পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধসমূহ
ঢাকার গেরিলা যুদ্ধ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গেরিলা যুদ্ধ ছিল অনুকরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধাদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র, বুদ্ধিজীবী তথা মেধাবী তরুণ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মুক্তিযুদ্ধে এত উচ্চশিক্ষিত গেরিলা যোদ্ধা দেখা যায়নি যা কিনা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেখা গিয়েছিল। ২ নং সেক্টরে ছিল একাধিক ঢাকাকেন্দ্রিক দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। তাঁরা মেলাঘর, নির্ভয়পুর, পশ্চিম দিনাজপুর ও দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অকুতোভয় হৃদয়ে ঢাকা অ্যাটাক করেছিল।
ক্র্যাক প্লাটুন
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক আবেগমাখা অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ক্র্যাক প্লাটুন। এই দুর্ধর্ষ প্লাটুন মেজর খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজধানীকেন্দ্রিক তাঁদের গেরিলা কার্যক্রম চালাতো। খালেদ মোশাররফ নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি কমান্ডো তথা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্ষিপ্রগতির একটি গেরিলা বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে শিক্ষিত, নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক ছেলেদের নিয়ে বিশেষ গেরিলা দল গঠনের লক্ষ্যে তাঁদের সরাসরি রিক্রুট করার জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন। আর বাছাইকৃত গেরিলাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের বিশিষ্ট বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারকে।
আগরতলা ক্যাম্পে স্বল্পমেয়াদী গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নেতৃত্বে ১৬ জনের প্রথম দলটিকে জুন মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। অন্য কোনো অস্ত্র ছাড়াই এই দলটি চারটি করে হাতবোমা আর ২০ পাউন্ড করে বিস্ফোরক নিয়ে ৬ জুন গোপনে ঢাকাতে প্রবেশ করে।
একাত্তরের সেই উত্তাল রণাঙ্গনে ক্র্যাক প্লাটুন ছিল পাকিস্তানীদের কাছে এক ভয়ের নাম, বিভীষিকার প্রতিশব্দ। ক্র্যাক প্লাটুনের উল্লেখযোগ্য অপারেশন হল-
১। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হ্যান্ড গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ চার্জ,
২। পাঁচটি ১১ কেভি পাওয়ার স্টেশন আক্রমণ ও এক্সপ্লোসিভ চার্জ,
৩। যাত্রাবাড়ী ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ চার্জ,
৪। হামিদুল হক চৌধুরীর প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিতে এক্সপ্লোসিভ চার্জ,
৫। বিডিআর গেট ও ধানমন্ডি আক্রমণ,
৬। গ্যানিজ ও ভোগ বিপণীকেন্দ্রে হামলা ও কয়েকটি পেট্রোল পাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড চার্জ,
৭। ফার্মগেট অপারেশন ইত্যাদি।
ঢাকা গেরিলা (দক্ষিণ)
২৫ মার্চ আজিমপুর এলাকার কিছু ছাত্র ও যুবক পাক বাহিনীর উপর আক্রমণের জন্য তাঁদের গেরিলা কার্যক্রম শুরু করে। এই দলের দলনেতা ছাত্র আদিল খানের (টুটুল) নামে পরিচিত ছিল এই গেরিলা বাহিনী। নভেম্বরে নিউ মার্কেট পেট্রোল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া ও আর্মি রিক্রুটমেন্ট অফিসে গ্রেনেড চার্জ ছিল এই বাহিনীর অন্যতম দুটি অপারেশন।
ঢাকা গেরিলা (উত্তর)
ঢাকা শহরের কিছু ছাত্র ও যুবক পশ্চিম দিনাজপুরের বালুঘাটে একত্রিত হয়ে দেড় মাসের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁদের কথা ২ নং সেক্টর প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ জানতে পারেন। আরও কিছু ঢাকাবাসী ছাত্র-যুবককে উক্ত দলে অন্তর্ভুক্ত করে ১৫ দিনের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। অতঃপর তাঁদের ঢাকার উত্তরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়। তাঁদের উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল- কাকরাইল মোড়ের পেট্রোল পাম্প ধ্বংস করা, সিঙ্গাইর থানার কাছাকাছি একটি গ্রামে অপারেশনের মাধ্যমে ১৪ জন পাকিস্তানী সেনার খাদ্য বহনকারী দলকে হত্যা করা, নভেম্বরে পল্টনে ১৬ পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা, শাহবাগের রেডিও পাকিস্তান দপ্তরে গ্রেনেড চার্জ ইত্যাদি।
এছাড়াও ১৩ অক্টোবর গভর্নর মোনায়েম খানকে গেরিলা আক্রমণ করে হত্যা করেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সাঁতারকুল ইউনিয়নের মোজাম্মেল হক। গুলিবিদ্ধ মোনায়েম খান পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়।
নারায়ণগঞ্জের গেরিলা যুদ্ধ
এখানকার উল্লেখযোগ্য গেরিলা যুদ্ধগুলো হলো ঢাকা-নরসিংদী মহাসড়কের উপর অবস্থিত বরদা গ্রামের কারভার্ট ধ্বংস (১৭ জুলাই), ফতুল্লা থানার বিজেসি গোদনাইল প্রেস হাউজে আগুন (৩ আগস্ট), সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন (১০ আগস্ট), বন্দর থানাধীন লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ অপারেশন (আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ ও ১৪ নভেম্বর), সদর থানার রূপসীবাজার অপারেশন (২৩ আগস্ট), আড়াইহাজার থানা আক্রমণ (২৯ আগস্ট), ফতুল্লা রেলসেতু আক্রমণ (১২ সেপ্টেম্বর), জাঙ্গির অপারেশন (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর), কাঞ্চনবাজার অপারেশন (১০ অক্টোবর), পাগলা রেলসেতু ধ্বংস (১০ অক্টোবর), কলাগাছিয়ার গানবোট অপারেশন (২৬ অক্টোবর), কাশিপুর অপারেশন (৩ ডিসেম্বর), কলাগাছিয়া অপারেশন (১৩ ডিসেম্বর), ইত্যাদি।
নরসিংদীর গেরিলা অপারেশন
জিনারদি অপারেশন (১৩ আগস্ট), রায়পুরা সদর কলোনির যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি), হাটুভাঙ্গা যুদ্ধ (১৬ সেপ্টেম্বর), অপারেশন বড়ৈবাড়ি (সেপ্টেম্বর) ইত্যাদি।
মুন্সিগঞ্জের গেরিলা অপারেশন
সিরাজদিখান থানা আক্রমণ (২৭ সেপ্টেম্বর), গোয়ালীমান্দার হাটের যুদ্ধ (সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ) ইত্যাদি।
মানিকগঞ্জের হালিম বাহিনী
প্রাথমিক প্রতিরোধে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী নিজ উদ্যোগে ও স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে গড়ে তোলেন হালিম বাহিনী। তিনি মানিকগঞ্জ ট্রেজারি থেকে ১৩৬টি রাইফেল ও কয়েক হাজার গুলি নিয়ে প্রাথমিক যুদ্ধ শুরু করেন। দুর্গম অঞ্চল হরিরামপুর থানায় তিনি তাঁর সদর দপ্তর গড়ে তোলেন। আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে হালিম বাহিনীর যুদ্ধ ও প্রতিরোধ তৎপরতা ছিল প্রশংসনীয়। ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারদ্বয়ের সাথে ক্যাপ্টেন হালিমের যোগাযোগ ছিল। নভেম্বর মাসে তিনি মেলাঘর যান এবং সেখানে তাঁকে মানিকগঞ্জ, ঢাকা সদর (দক্ষিণ ও পশ্চিম) এর দায়িত্ব লিখিতভাবে দেওয়া হয়। ১৯ নভেম্বর তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা সদর উত্তর ও দক্ষিণ মহকুমার এরিয়া ফোর্স কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
টাঙ্গাইলের বাতেন বাহিনী
টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর ও দেলদুয়ার থানাভিত্তিক একটি আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী ছিল ছাত্রনেতা খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে বাতেন বাহিনী। দক্ষিণ টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার কনোরা গ্রামে ছিল এই বাহিনীর সদর দপ্তর। বাতেন বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল ৪ মে সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ, ১৭ মে পদ্মাপাড়ের দৌলতপুর থানা আক্রমণ, মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঘিওর থানা আক্রমণ, ১৪ আগস্ট সাটুরিয়া থানা আক্রমণ, ৯ ও ১০ অক্টোবরের কাকনার যুদ্ধ, ১৯ অক্টোবরের তিল্লীর যুদ্ধ, ইত্যাদি।
২ নং সেক্টরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাগণ
বীরশ্রেষ্ঠ: এই সেক্টরে একজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন।
সিপাহি মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল: মোস্তফা কামালের গল্প তখনের যখন সমগ্র বাংলাদেশ (সামরিকভাবে) ১১টি সেক্টরে ভাগ হয়নি। এই গল্প এক অকুতোভয় যোদ্ধার। এই গল্প দরুইন গ্রামের এক প্রতিরোধ যুদ্ধের।
১৭ ও ১৮ এপ্রিল ২ নং প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার সিপাহি মোস্তফা কামালের অসীম সাহসিকতা রচিত হয়েছিল সেদিন বাংলার মেঘাচ্ছন্ন আসমানে, বৃষ্টিস্নাত জমিনে। তুমুল বৃষ্টির মাঝে দক্ষিণ ও পশ্চিম- এই দুই দিক থেকে আসা হানাদার বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাগণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য দরকার নিখুঁত কভারিং ফায়ার। কিন্তু কে হবে এই সাহসী রিয়ারগার্ড যোদ্ধা। এগিয়ে আসেন সিপাহি মোস্তফা কামাল। তিনি তাঁর এলএমজি দিয়ে পূর্ণ উদ্যমে শত্রু অবস্থানের উপর গুলি চালাতে থাকেন। প্রায় দেড়শ’ পাক হানাদারকে শেষ করে দিলেন তাঁর অস্ত্রের ঝলকানিতে। সফল হলেন বীর মোস্তফা কামাল। তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণ নিশ্চিত করলেন নিজের জীবন দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের দরুইন গ্রামে তাঁর রণাঙ্গনের সেই ট্রেঞ্চের পাশেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের এই বীরশ্রেষ্ঠ।
বীর উত্তম: ৬ জন বীর উত্তম ছিলেন।
১। লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ
২। মেজর এটিএম হায়দার
৩। ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী
৪। ক্যাপ্টেন এমএ গাফফার হাওলাদার
৫। ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান
৬। সিপাহি সাফিল মিয়া
বীর বিক্রম: এই সেক্টরের ১৯ জন যোদ্ধাকে এই ৩য় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব দেওয়া হয়।
বীর প্রতীক: ২ নং সেক্টরের ৫৬ জন যোদ্ধাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এই যোদ্ধা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অবদান রেখেছেন। তিনিই একমাত্র বিদেশি যিনি রাষ্ট্রের এই খেতাবটি অর্জন করেছিলেন। টঙ্গীর বাটা জুতার কারখানায় নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ওডারল্যান্ড গোপনে পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতেন আর সেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক অফিসারদের কাছে প্রেরণ করতেন। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক পরম বন্ধু এই উইলিয়াম ওডারল্যান্ড।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার, Sector Boundaries সংক্রান্ত পত্র, এইচ.কিউ/এক্স/সেক্টর, তাং ১৮ জুলাই ‘৭১
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস–সেক্টর এক ও সেক্টর দুই, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত
৩. মুক্তিযুদ্ধে রাইফেল্স্ ও অন্যান্য বাহিনী, সুকুমার বিশ্বাস, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯
৪. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধঃ এগারটি সেক্টরের বিজয় কাহিনী, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
৫. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, এ এস এম সামছুল আরেফিন, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮
৬. Bangladesh Fights for Independence, Lieutenant General ASM Nasim Bir Bikram, Columbia Prokashani, 2002
৭. সেক্টর কমান্ডারস এবং বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা মণ্ডলীর কনফারেন্স-এর মিনিটস, ১২-১৫ জুলাই ‘৭১, বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার
৮. লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে, রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, অনন্যা প্রকাশনী, অষ্টম সংস্করণ
৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম, দশম ও একাদশ খন্ড, হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, প্রথম সংস্করণ নভেম্বর ১৯৮২
১০. মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন, মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত, অনন্যা প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮
১১. আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল, সাগর পাবলিশার্স, ২০০০
১২. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন সম্পাদিত, সাহিত্য প্রকাশ, ১ম খন্ড (১৯৯৪) ও ২য় খন্ড (১৯৯৯)
১৩. মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী, আকবর হোসেন, অক্ষর বিন্যাস, জানুয়ারি ১৯৯৬
১৪. Witness to Surrender, Siddiq Salik, University Press Ltd., 1996