ফরিদপুর, প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক জনপদ। ফরায়েজী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজী শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতিধন্য ফরিদপুর। নারিকেলবাড়িয়ায় তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা ইংরেজ কর্নেলের কামানের গোলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেলে ফরিদপুরে নতুন করে গড়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলন। তবে একটু ভিন্নমাত্রায়, আরব মুলুক থেকে হজ্ব সেরে শরীয়ত উল্লাহ নামের এক ভদ্রলোক সরাসরি যুদ্ধ বিগ্রহে না গিয়ে তিনি এ এলাকার মুসলমানদেরকে ঈমান আকিদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ করতে লাগলেন। এই করে ফরিদপুরের মানুষেরা আস্তে আস্তে এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলে। ইতিহাসে এই আন্দোলনই ফরায়েজী আন্দোলন নামে খ্যাত। ফরায়েজী আন্দোলনের কল্যাণেই ফরিদপুরের মানুষেরা স্বাধীনতার প্রশ্নে একটু বেশি সচেতন আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেমন, ইমাম, মৌলভি, সুফি, দরবেশ তাঁরা একটু বেশি সম্মান পান।

ফরিদপুরের এক পল্লীর তেমনি এক সম্মানিত ব্যক্তি মুন্সি মেহেদী হোসেন। ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে তাঁর বসতি। তিনি এই গায়ের মসজিদের ইমাম। ফজরের নামাজের ইমামতি সেরে কিছুক্ষণ মসজিদে বসে দুরুদ পড়ে আকাশ ফর্সা হয়ে এলে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে আপনমনে গায়ের পথ ধরে হাঁটছেন আর ভাবছেন নিজের ভূত ভবিষ্যত্‍ নিয়ে। গায়ের মসজিদের ইমাম হিসেবে তিনি এ এলাকায় যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার পাত্র। সম্মানও পান সকল শ্রেণির মানুষের কাছে। কিন্তু কেবল শ্রদ্ধা আর সম্মান দিয়ে কী জীবন চলে? অথচ একমাত্র ছেলে রব বড় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আর কয়দিন পরেই তাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি টাকার, এই টাকার যোগান আসবে কোত্থেকে? অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মুন্সি মেহেদী হোসেনের বুক থেকে।

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ
ছবি: obhijatra.com

তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট রউফকে পরিবারের সবাই আদর করে ‘রব’ বলেই ডাকত। স্থানীয় আড়পাড়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় ১৯৫৫ সালে তার পিতা মৃত্যুবরণ করলে আর্থিক অনটনের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তার মা অন্যের ফরমায়েশে কাঁথা সেলাই এবং শিকা তৈরির কাজ করে সংসার চালাতেন। সংসারের অভাব দেখে মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে ইপিআরে যোগ দেন।

তিনি চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ক্যাম্পে তার মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লায় তার নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ পর্বে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাসদস্য এবং ইপিআরের সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া একটি কোম্পানির দায়িত্ব ছিল রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথ ঘিরে নিরাপত্তাব্যূহ তৈরির। এই দলের এক নম্বর এলএমজির চালক মুন্সি আব্দুর রউফ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচর উপজেলাধীন বাকছড়ির একটি বাঙ্কারে। তার মৃত্যুর পর সহযোদ্ধারা তাঁর লাশ উদ্ধার করে নানিয়ারচরের চিংড়ি খালসংলগ্ন একটি টিলার ওপর তাকে সমাহিত করেন।

মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সি আব্দুর রউফ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে তিনি চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকুরিরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ল্যান্স নায়েক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগানার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর চলাচল প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ে তাঁর কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চেঙ্গিখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তোলে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।

মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ
ছবি: rangamati.gov.bd

৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে বিধ্বস্ত করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং আর লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলো রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা।

যেভাবে শহীদ হলেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ

১৯৭১ সাল ২০ এপ্রিল। মহালছড়িসহ মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হামলার উদ্দেশ্যে কাপ্তাই লেকের পানিপথ দিয়ে ঢুকে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানিরও বেশি সৈন্য। ৬টি তিন ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রসহ তিনটি লঞ্চ ও দুটি স্পিড বোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এলাকায় ঢুকে তাদের অবস্থানকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে।

সেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পরে জানান, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর হানাদার বাহিনীর আচমকা মর্টার শেল ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে গোলাবর্ষণে আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। কিন্তু, প্রতিরক্ষা ব্যূহতে দায়িত্বরত ল্যান্সনায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ শত্রুপক্ষের প্রবল গোলাবর্ষণের মুখেও ছিলেন অবিচল। তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে মেশিনগান দিয়ে শত্রুর ওপর গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং সহযোদ্ধা সব সদস্যকে নিরাপদে পশ্চাদপসারণে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সেই যুদ্ধের বয়ান আছে মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস বইয়ে। তার সহযোদ্ধারা যখন প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটছিলেন তখন মুন্সী আব্দুর রউফ তার পরিখা থেকে বেরিয়ে মেশিনগান দিয়ে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকেন সরাসরি শত্রুর স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। তার গুলির আঘাতে শত্রুপক্ষের দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট পানিতে ডুবে যায় এবং দুই প্লাটুন শত্রুসৈন্যের সলিল সমাধি হয়। এ অবস্থা দেখে শত্রুসেনাদের বাকি একটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোট দ্রুত পিছিয়ে মুন্সী আব্দুর রউফের মেশিনগানের রেঞ্জের বাইরে চলে যায়। সেখান থেকে সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যুহ এলাকায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। এদিকে, অবস্থান পাল্টাতে দেরি করায় তার মেশিনগানের গুলির উৎস লক্ষ্য করে হানাদার বাহিনী মর্টারের গোলা ছোড়ে। সেই গোলার আঘাতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।

কাপ্তাই হ্রদের বুকে শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজে পাওয়া যাচ্চিলোনা এই বীরের সমাধিস্থল । সেই দিনের যুদ্ধে কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু। তার সহায়তায় স্বাধীনতার প্রায় ২৬ বছর পর ১৯৯৬ সালে এ বীরশ্রেষ্ঠের সমাধি স্থলের সন্ধান মেলে। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) নির্দেশ দেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থলটি খুঁজে বের করার। তার নির্দেশে বিডিআরের রাঙামাটি সেক্টর দয়াল কৃষ্ণ চাকমার সহায়তায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধিস্থল খুঁজে বের করেন।

কাপ্তাই হ্রদের বুকে শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ

এরপর সেখানে নির্মিত হয় শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ। এছাড়া রাঙামাটি শহরের পুরাতন শহীদ মিনার সংলগ্ন কাপ্তাই হ্রদের কোল ঘেঁষে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং সাপছড়ি এলাকায় রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে নির্মাণ করা হয় শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিসৌধ।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সম্মাননা

২০১৪-এ পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ। তাঁর স্মৃতিতে শালবাগান, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক, সাপছড়ির মধ্যবর্তী স্থানে ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ECB-16) একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সম্মাননা
ছবি: online-dhaka.com

মানিকছড়ি, মুসলিম পাড়া, মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এর একটি উচ্চ বিদ্যালয় তাঁর নামে রাখা হয়েছে। সিলেটের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম তাঁর নামে রাখা হয়েছে। ফরিদপুর জেলার একটি কলেজ তাঁর নামে রাখা হয়েছে, যেটি সরকারিকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহি মুন্সি আব্দুর রউফকে অনারারি ল্যান্স নায়েক পদে মরণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে।

Related posts

সকল ইউনিয়ন পরিষদে বঙ্গবন্ধুর ম্যূরাল স্থাপনের নির্দেশ

News Desk

মুক্তিযুদ্ধের ৩ নং সেক্টর এর সীমানা,সেক্টর কমান্ডার এবং হেডকোয়ার্টার

News Desk

বর্তমান পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী জানে এবং কতটা জানে?

News Desk

Leave a Comment