সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাসের টিকার জন্য হাহাকার চলছে। হাত গোনা কয়েকটি দেশে এই টিকা উৎপাদিত হলেও তা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। তাই সব দেশে দ্রুত টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। ইতিবাচক দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি থেকে এসে দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন করোনার টিকার মেধাস্বত্বের অধিকার সাময়িক সময়ের জন্য তুলে নেওয়ার একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন।
বাইডেনের এই সমর্থনকে ‘স্মরণীয়’ সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানোম গ্রেব্রেয়াসুস। তবে এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন টিকার জন্য হাহাকার করা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আশার সঞ্চার করেছে, অন্যদিকে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মেধাস্বত্ব যদি অবশেষে উন্মুক্ত হয়েই যায়, তাহলে মেধাস্বত্ব আইন ভঙ্গের খড়্গের ঝুঁকি ছাড়াই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওষুধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টিকা তৈরি করতে পারবে। এতে বিভিন্ন দেশের প্রয়োজন মিটবে। টিকার ঘাটতি কমবে। তবে মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করা নিয়ে আরও দীর্ঘ দেনদরবার চালিয়ে যেতে হবে।
কারা সমর্থক আর কারা বিরোধী?
করোনার টিকার মেধাস্বত্ব তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে গত অক্টোবরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
টিকাসংকট নিয়ে তীব্র চাপের মুখে অন্তত ৬১টি দেশ এই প্রস্তাবে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে কিছু ধনী দেশ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে জাপান, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ রয়েছে। কারণ, এসব দেশে বড় বড় ওষুধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের কেউ কেউ আবার করোনার টিকা তৈরি করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ঘোষণার পরপরই বিরোধী দেশগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরেছে। করোনা টিকার মেধাস্বত্ব তুলে নেওয়ার সমর্থনে গত বুধবার মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাই বিবৃতি দেন। এরপরই নিউজিল্যান্ড এতে সমর্থন জানায়। ইউরোপীয় কমিশনের (ইইউ) প্রধান উরসুলা ফন ডার লায়েনের সুরও নরম হয়েছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব কীভাবে বিশ্বে টিকার উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, বিষয়টি মূল্যায়ন করে দেখতে প্রস্তুত ইইউ। মেধাস্বত্ব তুলে নেওয়াকে সরাসরি সমর্থন না জানালেও উরসুলা বলেছেন, ‘কার্যকর’ ও ‘বাস্তবসম্মত’ সমাধানের জন্য ইইউ আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।
এই বিষয়ে যুক্তরাজ্য বলেছে, বিষয়টি সমাধান করতে ডব্লিউটিওর সঙ্গে কাজ চলছে। টিকার উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।
তবে জার্মানির সরকার মেধাস্বত্ব তুলে নেওয়ার বিরোধিতা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দেশটির একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভবিষ্যতে অবশ্যই মেধাস্বত্ব সুরক্ষিত রাখতে হবে।
এরপর কী?
টিকা তৈরিতে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো ও বর্তমান মেধাস্বত্ব অধিকার নীতিমালার সংস্কারের আগে ওই প্রস্তাবটি ১৬৪ সদস্য দেশের সংস্থা ডব্লিউটিওতে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হতে হবে। সব সদস্য দেশের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা আরও কয়েক মাস গড়াবে। বিষয়টি নিয়ে গত ৭ মাসে ১০টির মতো বৈঠকও হয়েছে। এসব আলোচনায় খুব বেশি সুফল মেলেনি।
১৯৯০-এর দশকে এইচআইভি সংকট নিয়ে পুরো বিশ্ব যখন টালমাটাল, তখন এইডস চিকিৎসার জন্য একটি ভাইরাসপ্রতিরোধী ওষুধের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছিল। ওষুধটির মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করার বিষয়ে অনেক দেনদরবারের পর ২০০১ সালে ডব্লিউটিও সদস্যভুক্ত দেশগুলো একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। শুধু জরুরি পরিস্থিতিতে ওষুধটি তৈরির জন্য দেশগুলোকে অনুমতি দেওয়া হয়।
করোনার টিকার মেধাস্বত্ব নিয়ে সামনে কী হবে, সেই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসিন ল অ্যান্ড পলিসির পরিচালক ইলেন টি হোয়েন বলেছেন, এখন করোনা টিকার মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করা নিয়ে কাগজে-কলমের আলোচনা চলবে। আলোচনা একটির পর আরেকটিতে গড়াবে। বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরা হবে। এটা খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। তবে খুব বেশি কার্যকর নয়।