Image default
আন্তর্জাতিক

পুতিনের কি শেষ রক্ষা হবে

ইউক্রেনের কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাবেক সহপাঠী ভিক্তর মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়েছে, কিয়েভে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বোমা ও দূরপাল্লার তোপের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বলেছে, ‘আমরা হয়তো পরাস্ত হব, কিন্তু কখনোই রাশিয়ার দাসত্ব মেনে নেব না। আমরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাব।’ বার্তার শেষে রুশ ভাষায় লিখেছে, ‘স্লাভা উক্রাইনা, ইউক্রেনের জয় হোক’।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধ, যাকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ নামে অভিহিত করেছেন, তার আপাত লক্ষ্য কিয়েভের বর্তমান জেলেনস্কি সরকারের পতন ও রুশপন্থী একটি অনুগত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের নাম উচ্চারণ না করে পুতিন বলেছেন, ‘তোমরা কমিউনিজম ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাও। দাঁড়াও দেখাচ্ছি, কেমন করে কমিউনিজম (তাঁর কথায় ‘ডি-কমিউনাইজেশন) বিদায় করতে হয়। যারা এই সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করবে তাদের উদ্দেশে বলেছেন, তিনি এমন শিক্ষা দেবেন যে ‘ইতিহাসে কেউ তেমন শিক্ষা পায়নি।’

বদলে যাবে ইউরোপের নিরাপত্তা মানচিত্র
একুশ শতকে একটি বৃহৎ শক্তিধর দেশ তার প্রতিবেশী দুর্বল দেশের ওপর কোনো উসকানি ছাড়া এমন সর্বাত্মক হামলা চালাবে, তা অনেকেই ভাবেনি। বাইডেন প্রশাসন এক মাস ধরে বলে আসছে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের উদ্দেশ্যে তাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আমরা অনেকেই সে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি এবং যুদ্ধ পাঁয়তারার জন্য উল্টো যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছি। বাস্তবে হোয়াইট হাউসের কথা সত্য প্রমাণিত হলো। প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর নতুন ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ সি চিন পিংকে বিব্রত না করে বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই হামলা শুরু করলেন।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই যুদ্ধে রাশিয়া বিজয়ী হলে ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুন করে সাজাতে হবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তির উঁচু আসন থেকে পা হড়কে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রায় ঠাট্টা করেই বলেছিলেন, রাশিয়া এখন কেবল একটি বড় শক্তি ‘মেজর পাওয়ার’, সে পরাশক্তি নয়। পুতিন সে কথা ভুল প্রমাণ করতে চান।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মস্কো আশা করেছিল, শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে যে নতুন নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে উঠবে, রাশিয়া তার অন্তর্ভুক্ত হবে। শোনা যায় ওয়াশিংটন মৌখিকভাবে তেমন আশ্বাসও দিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে ঘটে ঠিক উল্টো। সে দ্রুত রাশিয়ার প্রতিবেশী পূর্ব ইউরোপীয় ও বাল্টিক দেশগুলোকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এর ফলে সে চারদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের মস্কোবিরোধী ‘ময়দান বিপ্লবে’র পর নতুন যে সরকার ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত হয়, তারাও ন্যাটোর সদস্য পদের জন্য আবেদন করলে পুতিনের জন্য তা হয়ে দাঁড়ায় অলঙ্ঘনীয় ‘রেড লাইন’।

২০১৪ সালের সেই বিপ্লবের সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্কো প্রথমে ক্রিমিয়া দখলে নেয়। অব্যবহিত পরে ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী দুটি অঞ্চল রুশপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই দুই বহিঃআক্রমণের ‘শাস্তি’ হিসেবে ওয়াশিংটন মস্কোর বিরুদ্ধে সীমিত আকারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাতে অবশ্য রাশিয়ার গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি। আরও একটি ঘটনা পুতিনকে সাহসী করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি সিরিয়ার আসাদ সরকারের পাশে সব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে বেঁচে যান আসাদ। এই অভিজ্ঞতা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নিজের সামরিক শক্তির ব্যাপারে অতি বিশ্বাসী করে তোলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ২০২০ সালে মস্কোবিরোধী হিসেবে পরিচিত জো বাইডেনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। আফগানিস্তানে সামরিক বিপর্যয় ও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কারণে বাইডেন প্রশাসন এই মুহূর্তে খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেনের তরফ থেকে কোনো উসকানি না থাকলেও এটিই আঘাত হানার মোক্ষম সময়, সেই বিবেচনা থেকেই তোপ দাগলেন পুতিন।

অনেকেই বলছেন, এই যুদ্ধে মস্কোর বিজয় অর্জিত হলে পুতিন তাঁর সোভিয়েত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ পাবেন। বেলারুশ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক আঁতাতে যুক্ত হয়েছে। ইউক্রেন এবং মলদোভাও এই আঁতাতের সদস্যভুক্ত হবে। ফলে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি পোল্যান্ড থেকে তিন বাল্টিক রাষ্ট্রের সীমানা বরাবর প্রসারিত হবে। এটাই হবে ইউরোপের দুই অংশের মধ্যে নতুন সীমানা-চিহ্ন। শুরু হবে দ্বিতীয় ‘শীতল যুদ্ধ’।

তবে সিনেমা যে ঠিক এই চিত্রনাট্য মেনে এগোবে, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমার সহপাঠী ভিক্তরের টেক্সট মেসেজটি স্মরণ করুন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হাজার বছরের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাকে উপেক্ষা করে রাশিয়া এমন সর্বাত্মক যুদ্ধে লাফিয়ে পড়বে, ইউক্রেনীয়রা তা ভাবেনি। এই হামলা ও রক্তপাতের পর ইউক্রেনের ভেতর রুশবিরোধী মনোভাব এখন ঘৃণার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। রুশদের ঠেকাতে ইউক্রেন সরকার দেশের সব সবল দেহী মানুষের মধ্যে অস্ত্র বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে শুরু হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধ। সম্ভবত আরেক আফগানিস্তানের পাঁকে পড়তে যাচ্ছে রাশিয়া।

পুতিনের জন্য অন্য বিপদও রয়েছে। কূটনৈতিকভাবে তিনি একলা হয়ে পড়েছেন। তার একান্ত অনুগত তিনটি দেশ কিউবা, ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়া ছাড়া কেউ তাঁর সামরিক হামলা ভালো চোখে দেখেনি। চার দিন আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীনসহ প্রতিটি দেশ এই আক্রমণের নিন্দা করেছে। কেনিয়ার রাষ্ট্রদূত এই হামলা ও ইউক্রেনের মানচিত্রকে নিজের ইচ্ছামতো আঁকার চেষ্টাকে ‘ঔপনিবেশিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তা সহ্য করা রাশিয়ার জন্য কঠিন হবে। ইতিমধ্যে রুবলের মূল্য তলানিতে ঠেকেছে, শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে পুতিনের ঘনিষ্ঠ মহলের ওপর, যাঁদের পশ্চিমা ব্যাংকে রাখা অর্থ জব্দ করা হয়েছে, ব্যবসায়িক যোগাযোগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এঁদের অনেকের সন্তান ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষারত, সেখানে তাদের বিলাস জীবন। জানা গেছে, এঁদের কেউ কেউ ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছেন।

দেশের সাধারণ মানুষ, যাঁদের অধিকাংশের পুতিনের প্রতি অগাধ আস্থা থাকলেও এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ তাঁদের পছন্দ নয়। বেআইনি জানা সত্ত্বেও মস্কোসহ ৫০টির মতো শহরে যুদ্ধবিরোধী মিছিল হয়েছে। ইউক্রেন থেকে কফিনে করে রুশ সৈনিকের লাশ আসা শুরু হলে এই ক্ষোভ বিদ্রোহে পরিণত হবে। তখন প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে শেষ রক্ষা সম্ভব হবে তো?

Related posts

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হচ্ছে ইউক্রেন

News Desk

জরিমানা গুণতে হবে অনুমতি ছাড়া ওমরাহ পালন করলে

News Desk

মাঝেমধ্যে মনে হয় হৃদযন্ত্রটা ঠিকমতো কাজই করছে না: আগুয়েরো

News Desk

Leave a Comment