ভারতের কর্নাটক রাজ্যের হিজাব ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে। এ উত্তেজনা এখন শুধু ভারত বা উপমহাদেশেই সীমিত নেই; বরং এটি ধর্মীয় অধিকার ও পোশাক পছন্দ করার মৌলিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে বৈশ্বিকভাবে সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই ইস্যুটি ভারতে এমন একসময়ে সৃষ্টি হয়েছে যখন দেশটির বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচনে বিজেপির এই বৃহত্তম রাজ্যে সরকার গঠনই শুধু নয়, সে সাথে সেখানে হিন্দুত্ববাদী দলটি জয়ী হলে যোগী আদিত্যনাথ বিজেপির মোদি-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন বলে ধারণা হচ্ছে।

হিজাব ও মুসকান ভাইরাল

কর্নাটকের হিজাব পরা মুসকান খান নামের মুসলিম মেয়েটিকে গেরুয়া কাপড় দিয়ে কলেজে বাধা দেয়া উগ্রপন্থী ছেলেদের চেহারা দেখে মনে হয়নি তারা সবাই সেই কলেজের ছাত্র। অধিকন্তু তাদের সাথে একজন ভিডিওম্যানকেও দেখা গেছে। ঘটনার পরপর এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভিডিওতে দেখা যায় বোরকা পরা মেয়েটি নিজের কলেজে বাইক চালিয়ে ঢুকছে। সেখানে তাকে লক্ষ্য করে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে স্লোগান দিচ্ছে গেরুয়া কাপড় হাতে জড়ো হওয়া কিছু যুবক। এ সময় মেয়েটি তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পাল্টা স্লোগান দেয়। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে ভেতরে নিয়ে যায়।

মুসকান খান বিবিসিকে বলেছে, ‘আমি এখানে হিন্দু বা মুসলিম কোনো জাতপাত ছড়াচ্ছি না। আমি শুধু আমার শিক্ষার জন্য, আমার অধিকারের জন্য দাঁড়িয়েছি। আমরা হিজাব পরছি বলে আমাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ আমরা বছরের পর বছর ধরে এটি পরছি। ছেলেরা আমার কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে বলছে, সে যদি বোরকা পরে আসে, তাহলে আমরাও এসব সরাব না (গেরুয়া, গামছা-পাতা ইত্যাদি)। আমাদের শুধু হিজাব পরার অনুমতি দরকার। যেভাবেই তারা আসুক না কেন, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের শুধু দরকার শিক্ষা। আমাদের অধ্যক্ষ আমাদের সাথে আছেন, শিক্ষকরা আমাদের সাথে আছেন। বাইরে থেকে এসে কিছু লোক কেবল নজর কাড়ার চেষ্টা করছে।’

এসবের শুরুটা হয় যখন কর্নাটকের বিজেপি সরকার সব স্কুল-কলেজের পোশাক থেকে হিজাব নিষিদ্ধ করে। এরপর হিজাব পরা মেয়েদের ক্লাসে ঢুকতে না দিলে একটি সরকারি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের সামনে ছয় তরুণী এর প্রতিবাদ শুরু করেন। ধীরে ধীরে সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। এরপর হিজাব নিষিদ্ধের পক্ষে পাল্টা প্রতিবাদ হিসেবে কিছু শিক্ষার্থী গেরুয়া পরে আসতে থাকে ক্যাম্পাসে। দুই গ্রুপ মুখোমুখি হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে হিজাব পরা সাংবিধানিক অধিকার দাবি করে আদালতে গিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। সরকার তিন দিনের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।

প্রশ্ন হলো হিজাব পরতে বাধা দেয়ার বিষয়টি ইস্যু হিসেবে রাজ্যটিতে বিজেপি সরকার গঠনের পর কেন সামনে নিয়ে আসা হলো। কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ড্রেসকোডের দোহাই দিয়ে হিজাব পরে ক্লাসে বসার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। এর মধ্যে কর্নাটকের হাইকোর্ট হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে মুসলিম মেয়েদের দায়ের করা আবেদনের শুনানি শুরু করেছে।

আদালতে আবেদনকারীদের প্রবীণ আইনজীবী দেবদত্ত কামাত, যুক্তি দিয়ে বলেন, হিজাব পরা পবিত্র কুরআনে নির্ধারিত একটি ‘অত্যাবশ্যক ধর্মীয় অনুশীলন’ হওয়ায় আবেদনকারীরা শুধু মাথার একটি স্কার্ফ পরার কথা বলছেন। সুতরাং হিজাব পরা সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের অধীনে সুরক্ষিত, রাজ্য সরকারের কোনো আদেশে এটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। মি. কামাত আরো দাবি করেন যে, পোশাক পরার অধিকার হলো ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১)(এ) অনুচ্ছেদের অধীনে কথা বলা ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারের একটি অংশ। আর যদি হিজাব পরাটা ধর্মীয় মৌলিক অধিকার হয় তাহলে সাংবিধানিক প্রটেকশনের কারণে এ নিয়ে সরকার আদেশ জারি করতে পারে না। এ কারণে এটিকে ‘পাবলিক অর্ডার ইস্যুযোগ্য’ নয় বলে এর ওপর সাধারণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে না। কিন্তু সেই একই বিষয় শিক্ষাঙ্গনে কিভাবে সরকারের আদেশযোগ্য হতে পারে, আর হিজাব নিষিদ্ধ করার আদেশ আইনসম্মত হতে পারে?

শুদ্ধি অভিযানের অংশ?

কর্নাটকের এ ঘটনার আগে একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর জন্য উগ্রপন্থী হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মঞ্চ থেকে একজন উগ্রবাদী হিন্দু পুরোহিত নেতাকে বলতে শোনা যায় মিয়ানমারের মতো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তাদের হত্যা করে এই ভ‚মিকে মুসলিমমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলে প্রশাসন লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

কিন্তু এর পরও মুসলিমবিরোধী এজেন্ডা একের পর এক সামনে আসছে। হিজাবের বিষয়টি একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ কি না তা নিয়েই এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাত্রাটি কিছুটা বেশি। ভারতের বিরোধী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী হিজাব ইস্যুর গভীরতা উপলব্ধি করেই এটি ভারতকে অনৈক্য ও বিভক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একই ধরনের আশঙ্কা আরো তির্যকভাবে ব্যক্ত করেছেন বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদব। তিনি বলেছেন, বহুত্ববাদিতাকে ভেঙে দেয়ার এই কার্যক্রম ভারতকে ভৌগোলিকভাবে খণ্ড বিখণ্ড করবে। ভারতের সামরিক বাহিনীর সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তাও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

প্রশ্ন হলো ভারতীয় রাজনীতির নতুন উন্নয়নে গভীর বিষয়টি কী, যার জন্য দেশের সংহতি বিপন্ন হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের চলমান নির্বাচন এর একটি কারণ হতে পারে। লোকসভা বা বিধানসভার নির্বাচনের আগে বিজেপির কৌশল হলো পাকিস্তান হুমকি এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়গত ইস্যু চাঙ্গা করে দেয়া। এটি হলে সংখ্যাগুরু ভোটারদের ভোট বিজেপির পক্ষে পড়বে বলে ধারণা করা হয়। হিজাব ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির সাথে এর যোগসূত্র থাকতে পারে।

এর বাইরে আরেক কারণ হতে পারে আরএসএস ডক্ট্রিন। ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভক্তির সময় পাকিস্তান যেখানে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আলাদা বাসভ‚মি চেয়েছে, সেখানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্লোগান ছিল বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ ভারত প্রতিষ্ঠা হবে সব ধর্মবিশ্বাস সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর একটি রাষ্ট্র হিসেবে। প্রকাশ্যভাবে ঘোষিত এই ধ্যানধারণার সাথে যারা দেশটির নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের লালিত মতবাদের বাস্তব প্রতিফলন কতটা ছিল তা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে; কিন্তু ভারত পরিচালিত হওয়ার দৃশ্যমান আদর্শবাদে এর ব্যতিক্রম মোটা দাগে দেখা যায়নি, যেটি এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে।

বর্তমানে ভারত যে ভাবধারায় চলছে সেটির মূলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ১৯২৫ সালে নাগপুরে ডা: কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠিত এই দলটির মূল ভাবাদর্শ হলো হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ব হলো ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান রূপ। একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে, হিন্দুত্ব শব্দটি ১৯২৩ সালে আরএসএসের তাত্ত্বিক গুরু বিনায়ক দামোদর সাভারকর দ্বারা প্রথম উচ্চারিত হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং অন্যান্য সংগঠনের দ্বারা সমষ্টিগতভাবে সঙ্ঘ পরিবারের বিশ্বাস হিসেবে বর্ণনা করা হয় এটিকে।

বিনায়ক দামোদর সাভারকারের ওপর লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার নিবন্ধ অনুসারে, ‘হিন্দুত্ব… ভারতীয় সংস্কৃতিকে হিন্দু মূল্যবোধের প্রকাশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছিলেন তিনি; এই ধারণাটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের একটি প্রধান নীতিতে পরিণত হয়।’ এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, হিন্দুত্ব হলো সাভারকারের আদর্শের ক্লাসিক বিবৃতিতে সংজ্ঞায়িত ‘হিন্দু জাতির সংস্কৃতি’, যেখানে হিন্দু ধর্ম যার একটি উপাদান। আর হিন্দু ধর্ম হলো এমন একটি ধর্ম যা হিন্দুদের পাশাপাশি শিখ ও বৌদ্ধরাও পালন করে। নিবন্ধে আরো বলা হয়েছে, হিন্দুত্বের প্রবক্তারা হিন্দুদের ধর্মীয় ও বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে জাতীয় পরিচয়ের বিষয়টি এক করে প্রচারের চেষ্টা করেছেন।

সাভারকারের মতে, হিন্দুত্ব হলো ভারতীয় সবকিছুর অন্তর্ভুক্ত একটি শব্দ। তার সংজ্ঞায় হিন্দুত্বের তিনটি অপরিহার্য বিষয় হলো, সাধারণ জাতিরাষ্ট্র, অভিন্ন জাতি এবং অভিন্ন সংস্কৃতি বা সভ্যতা। সাভারকার ‘হিন্দু’ এবং ‘সিন্ধু’ শব্দগুলো পরস্পর পরিবর্তনযোগ্যভাবে ব্যবহার করেছেন। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত ধারণা হিসাবে এই শব্দগুলো তার হিন্দুত্বের ভিত্তি ছিল আর ধর্ম তার সংমিশ্রণে স্থান পায়নি। তার হিন্দুত্বের বিস্তৃতিতে সর্বভারতীয় ধর্ম, যেমন হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্ম অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাভারকার ‘হিন্দু জাতীয়তাকে’ ‘ভারতীয় ধর্মের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছিলেন এই অর্থে যে, তারা একটি সাধারণ সংস্কৃতি এবং তারা তাদের উৎসের ভূমির প্রতি অনুরাগ ভাগ করে নিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফ জাফরেলটের মতে, সাভারকার- নিজেকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে ঘোষণা করেন, হিন্দুর সংজ্ঞায় ধর্মের গুরুত্বকে হ্রাস করেছেন এবং পরিবর্তে একটি ভাগ করা সংস্কৃতি ও লালিত ভূগোলসহ একটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য জোর দিয়েছেন। জাফরেলট বলেছেন, সাভারকারের কাছে একজন হিন্দু হলো প্রথম ও সর্বাগ্রে এমন কেউ যিনি সিন্ধু নদীর ওপারে, হিমালয় এবং ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করেন। সাভারকার খিলাফত আন্দোলনের প্যান-ইসলামিক সংহতির প্রতিক্রিয়ায় তার মতাদর্শ রচনা করেন, যেখানে ভারতীয় মুসলমানরা অটোমান সাম্রাজ্যের ইস্তাম্বুলভিত্তিক খেলাফত এবং ইসলামিক প্রতীকগুলোর প্রতি সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তার চিন্তাধারায় প্রধানত ইসলাম ও এর অনুসারীদের প্রতি গভীর শত্রুতা প্রতিফলিত হয়।

জাফরেলট বলেন, সাভারকারের কাছে, মুসলিমরা ছিল প্রকৃত শত্রু, ব্রিটিশরা নয়। কারণ তাদের ইসলামিক আদর্শ তার দৃষ্টিতে আসল জাতির তথা হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য হুমকি তৈরি করেছিল। যারা এই ঐতিহাসিক ‘সাধারণ সংস্কৃতি’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাদের সবাইকে সাভারকার বাদ দেন। তবে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা খ্রিষ্ট ধর্ম বা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেয়ার্ড ইন্ডিক সংস্কৃতিকে গ্রহণ ও লালন করেন। এ ক্ষেত্রে এই বিবেচনা ছিল যে তারা আবার পুনরায় একত্রিত হতে পারেন।

সাভারকারের হিন্দুত্বের ধারণা তার হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এটি ক্লিফোর্ড গির্টজ, লয়েড ফলার্স এবং অ্যান্টনি ডি. স্মিথ নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে জাতিগত জাতীয়তাবাদের একটি রূপ ছিল। এখন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত হিন্দুত্বের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তার মূল ভিত্তি হলো সাভারকারের ধারণা। তিনিও বলছেন, হিন্দুত্ববাদের মূল কথা হলো ভারত হবে হিন্দুদের রাষ্ট্র। যারা এ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে থাকবে এই হিন্দুত্ববাদের সংস্কৃতিগত ধারণাকে মেনে নিয়ে তাদের চলতে হবে। মোহন ভাগবতের ভাষায় হিন্দু বা হিন্দুত্ব কোনো ধর্মীয় ভাবাদর্শ নয়, এটি হলো একটি পরিচয়। ভারত রাষ্ট্র পরিবারের যে কেউ মুসলিম, খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ হতে পারেন কিন্তু ভারতে থাকলে তার পরিচয় হবে হিন্দু-মুসলিম, হিন্দু-খ্রিষ্টান, হিন্দু-বৌদ্ধ ইত্যাদি।

হিন্দুত্ব ও বহুত্ববাদী ভারত

আরএসএস প্রধানের এই ধারণা ভারতের সব জনগোষ্ঠী গ্রহণ করেছে এ কথা বলার অবকাশ নেই। এই ধারণার বিরোধিতা মুসলিম খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকেই শুধু এসেছে এমন নয়। এর মূল বিরোধিতা এসেছে ভারতে বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে। আজকের ‘হিজাব’ বিতর্কে যেমন অ-বিজেপি সব দল থেকে কম বেশি সমালোচনা এসেছে তেমনিভাবে আরএসএসের ভারত দর্শনের ব্যাপারেও একইভাবে বিরোধিতা এসেছে।

তবে বহুত্ববাদীদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারতের রাজনীতি, ধর্মচেতনা, সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন এমনকি গভীর ক্ষমতা বলয়ে গত এক যুগে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এর মূলে রয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ। আরএসএস চেয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় সামরিক বেসামরিক নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত ক্ষেত্রগুলোতে আদর্শগত আধিপত্য সৃষ্টি করতে। তারা বিশেষভাবে কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর বিচার প্রতিষ্ঠান, বেসামরিক আমলাতন্ত্র, রাষ্ট্রের জাতীয় ও বৈশ্বিক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ও সশস্ত্রবাহিনীতে আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শের একটি বড় বলয় তৈরি করতে চেয়েছে, যাতে ভারতের নীতি প্রণয়ন, শিক্ষাকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে হিন্দুত্ববাদী দর্শনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়।

এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয়। এখন সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে সামরিক বা নিরাপত্তা স্বার্থে পেশাগত বক্তব্যের পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য উচ্চারিত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলো নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে গোপন ভূমিকায় চলে এসেছে বলে অভিযোগ উঠছে, যা স্বাধীনতার পর ৫-৬ দশকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। শিক্ষার কারিকুলামে হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষপূর্ণ ধ্যানধারণাগুলো গভীরভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এর পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিবারের আরএসএস, ভিএইচপি, বজরং ইত্যাদি শাখা সংগঠনের সদস্যদের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটছে। এক পরিসংখ্যান অনুসারে পুরো ভারতে ১৮ মিলিয়ন আরএসএস সদস্য/ক্যাডার রয়েছে, যারা সঙ্ঘ পরিবারের ভাবাদর্শে চরমভাবে উদ্বুদ্ধ। এসব সদস্য সামরিক-বেসামরিক ক্যাডার সার্ভিস, গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য প্রশাসনে নিয়োগ লাভ করছে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই শক্তিটির বিস্তার ভারতকে ভেতর থেকে পাল্টে দিচ্ছে।

এ কারণে হিজাব ইস্যুটিকে বিচ্ছিন্ন কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এর সাথে সঙ্ঘ পরিবারের মূল আদর্শ-বিশ্বাস এবং ধ্যানধারণার সংযুক্তি রয়েছে। এটি এমন এক ইস্যু যার সাথে এনআরসি বা নাগরিকত্ব ইস্যু, ভোটাধিকার থেকে সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করা এবং সংখ্যালঘু গণহত্যার হুমকির সম্পর্ক রয়েছে। এখানকার হুমকি থেকে ভারতের বহুত্ববাদী সংহতিকে রক্ষার জন্য রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণা থেকে মুক্তির চেষ্টা যেমন চালাতে হবে; তেমনিভাবে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সমন্বয়বাদী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ভারতব্যাপী। এটি সম্ভব হলে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভারতীয়ের সমর্থন নিয়ে বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবার দেশটিকে উগ্রবাদী শাসনের দিকে আর নিয়ে যেতে পারবে না। বিভক্তিকে কাজে লাগিয়েই জয় পাচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে এটি পারেনি বলে বিজেপি ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ভারত এই ধারায় কখন কতটা আসতে পারে সেটিই মূল প্রশ্ন এখনকার।

তথ্য সূত্র : https://www.dailynayadiganta.com/

Related posts

কানাডার স্কুল থেকে ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার

News Desk

নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ইমরান খান

News Desk

ইরাকে মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ভয়াবহ ড্রোন হামলা

News Desk

Leave a Comment