অর্থনৈতিক সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা আরও গভীর ও দীর্ঘ হচ্ছে। অর্থনীতির অনেকগুলো সূচকই আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ–সংকট আরও বেড়েছে। খাদ্য–সংকটের আশঙ্কা বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই। প্রধানমন্ত্রীও দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন।
চলতি বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের গতি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম বলে লেনদেনের ঘাটতি এখন রেকর্ড পরিমাণ।
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমেছে প্রকৃত আয়। উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সমস্যা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। উৎপাদন কম হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো হিমশিম খাচ্ছে ডলার নিয়ে। সরকারের আয়ও কম। ফলে ভর্তুকির বরাদ্দও বাড়াতে পারছে না।
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়েও কোনো ভালো কোনো পূর্বাভাস নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগ্রাসীভাবে চলতি বছরেই ছয়বার নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতি তেমন কমছে না। বরং এর ফলে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, খারাপ সময় আসা এখনো আরও বাকি। বিশ্বে সামনে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে। অর্থাৎ ২০২৩ সালও ভালো যাবে না।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে একধরনের চাপ আছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নই। এখন পর্যন্ত সূচকগুলো যে পর্যায়ে আছে, তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়মিত করতে পারলে উৎপাদনব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
তাহলে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সমর্থন পেলে ডলারের সংকটও কেটে যাবে। খাদ্যসংকটের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের আমনের ফলন ভালো হয়েছে। বোরোর ফলনও ভালো করার প্রস্তুতি চলছে। কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক আছি।’
সূচকের প্রায় সব কটিই খারাপ
দেশের মূল্যস্ফীতি এখন প্রায় এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে এর হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস হলো ২০২৩ সালে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ হবে। এর মানে, মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভবিষ্যতেও স্বস্তির খবর নেই।
গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল। কিন্তু আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর খানিকটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
আর তাতেই ডলারের দর গিয়ে ঠেকেছে ১০৭ টাকায়। আবার বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা শুরু করে।
এতে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩৩ কোটি ডলারে, যা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে, যা কয়েক মাস আগেও ছিল সাত মাস। যদিও আইএমএফের মতে, হিসাবটি পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, নানা কারণে ৭২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছিল, এর পুরোটা ফেরত আসার নিশ্চয়তা কম। সেই হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৭১৩ কোটি ডলার।
আবার সরকারের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ও এখন অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী আয় করতে পারছে না, কিন্তু খরচ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেল ও সারে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু সরকার আর এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারছে না। এ কারণেই জ্বালানির দাম এক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখন চাপ রয়েছে সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার।