নিউ ইয়র্ক হার্বারের বুকে ৩০৫ ফিট ৬ ইঞ্চি উঁচু, স্ট্যাচু অব লিবার্টি নামের সেই মূর্তিটি বিশ্বের বুকে যুক্তরাষ্ট্রের অনন্য এক নিদর্শন। নিজেদের কালো অধ্যায়কে পেছনে ফেলে বিশ্বের বুকে আমেরিকার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর এক বার্তাই যেন দেয় এই ভাস্কর্য।

‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ নামে বিশ্ববাসী এই মূর্তিটিকে চিনলেও এর প্রকৃত নাম ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’। বহু লোকের নিরলস পরিশ্রম ও ধৈর্যের ফসল এই ভাস্কর্য আজ মার্কিনীদের জাতীয়তাবোধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রোমান দেবী লিবার্টাসের আদলে, সবুজ রঙের ঢিলে ঢালা গাউন পরা এক নারীর অবয়ব স্ট্যাচু অব লিবাটি। ভাষ্কর্যটির বাইরের অবয়ব নকশা করেন ফরাসি স্থপতি ফ্রেডরিক বার্থোল্ডি এবং এর ভেতরের নকশা করেন, আরেক বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি গুস্তাভ আইফেল, তিনি আইফেল টাওয়ারের নকশাকারী হিসেবে বিখ্যাত। অতীতে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে আমেরিকাকে সাহায্য করেছিল ফ্রান্স। আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের ১০০ বছর পূর্তিতে দুই দেশের বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে, ১৮৮৬ সালে ফ্রান্স ভাষ্কর্যটি আমেরিকাকে উপহার দেয়। আমেরিকার নিউইয়র্ক পোতাশ্রয়ের মুখে লিবার্টি দ্বীপে স্টাচু অব লিবার্টি কে স্থাপন করা হয়। কারণ তৎকালীন সময়ে বহু ইউরোপীয় অভিবাসী নিউইয়র্ক বন্দরের মাধ্যমে আমেরিকায় প্রবেশ করছিল। এই ভাষ্কর্যটি সেইসব অভিবাসীদেরকে আমেরিকায় স্বাগত জানাত। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লক্ষ লোক স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে আসে।

স্ট্যাচু অব লিবার্টি আসলে ছিল ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে মার্কিনীদের জন্য একটি উপহার। ১৭৬৫ সাল থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলা আমেরিকান বিপ্লবের সময়টিতে ব্রিটেনের কাছ থেকে আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রামে সাহায্য করেছিল ফ্রান্স। সেই সহযোগিতার স্মৃতি হিসেবে আমেরিকার স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে এটি নির্মাণ করা হয়।

সেই সময়টিতে ফ্রান্স বা আমেরিকার কেউই অর্থনৈতিকভাবে অতটা স্থিতিশীল ছিল না।
ফ্রান্সের ফ্রেডরিক অগাস্ট বার্থোল্ডি ছিলেন স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূল নকশাকার। তিনি কিন্তু মোটেও আমেরিকায় স্থাপনের কথা ভেবে নকশাটি করেননি। তার ভাবনায় ছিল অন্য কিছু। ১৮৫৫ সালে ২০ বছর বয়সের টগবগে তরুণ বার্থোল্ডি গিয়েছিলেন মিশর ভ্রমণে। সেখানকার পরিবেশ এবং চারপাশের চোখ ধাঁধানো সব শিল্প তার এতই নজর কাড়ে যে, ঠিক করে ফেলেন এখানে তার একটি কাজের নমুনা অবশ্যই রেখে যাবেন। সুযোগও পেয়ে যান একটি।

বার্থোল্ডি জানতে পারলেন, খুব দ্রুতই ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের মাঝে সংযোগ সৃষ্টিকারী একটি খাল তৈরি করা হবে, যা বয়ে যাবে মিশরের মাঝ দিয়ে। এই খাল তৈরির ফলে ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে আর গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হবে না। এর ফলে বেঁচে যাবে সময় এবং বেড়ে যাবে যোগাযোগ ব্যস্ততা। বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই খালটির নাম হবে সুয়েজ খাল।

বার্থোল্ডি সিদ্ধান্ত নিলেন, সুয়েজ খালের পাড়েই বাস্তব রূপ দেবেন তার কাঙ্ক্ষিত নির্মাণশৈলীকে। সরকারি লোকজন এবং সুয়েজ খালের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলে ঠিক করে ফেললেন মূর্তির নকশা- এক মধ্যবয়সী নারী প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে খালের প্রবেশ মুখে।

নামও ঠিক হলো এর জন্য, ‘ইজিপ্ট ব্রিঙিং লাইট টু এশিয়া’। ভেবেছিলেন, মিশরকে পুরো বিশ্বে অসাধারণ মর্যাদা এনে দেবে এই শৈল্পিক মূর্তি। কিন্তু বার্থোল্ডির কপালই বটে! রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্মাণ-সংক্রান্ত নানা জটিলতা, জনবলের অভাব এবং সেই সময়ে কলেরার মহামারী- সব মিলিয়ে খালের নির্মাণকাজ শেষ হতেই লেগে গেল পুরো ১৫ বছর। ১৮৬৯ এর নভেম্বরে জাহাজ যাতায়াত এবং ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সুয়েজ খাল।

এরপর বার্থোল্ডি যখন তার নকশা নিয়ে যান তখন বাধে আরেক বিপত্তি। তার নকশা অনুযায়ী ৬ লক্ষ মার্কিন ডলারের বাজেট দিতে মিশর কোনোভাবেই সক্ষম না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেখান থেকে সরে আসতে হয় সদ্য ৩৫-এ পা দেওয়া বার্থোল্ডিকে।

মিশর ফিরিয়ে দিলেও নিয়তিতে অন্য কিছু লেখা ছিল। ১৮৭১ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এসেই তিনি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের সর্বত্র চষে বেড়াতে শুরু করলেন তার প্রকল্পের প্রচারণার জন্য।প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে বিশিষ্ট জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও মিলছিল না ইতিবাচক সাড়া।

ল্যাবুলে এক কথায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধভক্ত ছিলেন। দেশটিকে তিনি দেখতেন ভালো এবং উৎকৃষ্ট কিছুর উদাহরণ হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ফলাফল, দাসপ্রথার বিলুপ্তি এবং ৪ মিলিয়ন ক্রীতদাসের মুক্তির ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনেক উচ্ছ্বসিত।স্বাভাবিকভাবেই তিনি দেশটির জন্য কিছু করবার তাগিদ অনুভব করছিলেন। সেখানটায় বার্থোল্ডি নিয়ে এলেন ভাস্কর্য নির্মাণের এক দারুণ আহ্বান। দুয়ে দুয়ে মিলে যায় চার।

১৮৭৫ সালে ল্যাবুলে ‘ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়ন’ গঠনের মাধ্যমে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার বার্থোল্ডির হাতে তুলে দেন ভাস্কর্যের কাজ শুরু করার জন্য। বার্থোল্ডি তখন গুস্তাভে আইফেলের সাথে পরামর্শ করে এর গঠন ও আকার ঠিক করেন।ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান ইউনিয়ন থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, মূর্তির ভিত গঠনের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা তোলা হবে মার্কিনীদের কাছ থেকেই এবং জনবল সরবরাহ করবে ফ্রান্স।আমেরিকানদের আগ্রহী করে তোলার জন্য বার্থোল্ডি ১৮৭৬ সালে মূর্তিটির হাত এবং মশাল পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ায় একটি প্রদর্শনীতে উন্মোচন করেন।

১৮৮০ সালে স্ট্যাচু অব লিবার্টির আমেরিকান কমিটি মূল নকশার অনুকরণে ছোট ছোট মডেল আকৃতি তৈরি করে বিক্রি করতে থাকে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। একদম ছোট ৬ ইঞ্চির মডেলগুলো বিক্রি হতো ১ ডলারে এবং সবচেয়ে বড় ১ ফুট আকারের মডেলগুলো বিক্রি হতো ৫ ডলারে।এত চেষ্টার পরেও কীসের যেন একটা কমতি থেকেই যাচ্ছিল।এই সময়েই ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’-এর সম্পাদক জোসেফ পুলিৎজার শেষ চেষ্টায় এগিয়ে আসেন। তার পত্রিকায় প্রতিটি সংখ্যায় ছাপানো স্ট্যাচু অব লিবার্টি নিয়ে বিশেষ লেখা প্রতিটি আমেরিকানকে আগ্রহী করে তুলতে থাকে এর ব্যাপারে।পত্রিকার প্রচারণার থেকেই উঠে আসে ১ লক্ষ মার্কিন ডলার। এভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে শেষ হয় বার্থোল্ডির স্বপ্নের ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’।১৮৮৫ সালে ফ্রান্স ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বসে তৈরি করা স্ট্যাচু অব লিবার্টির ৩৫০টি অংশ নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছায়। সবকটি অংশ জোড়া দিতে সময় লাগে পুরো ১ বছর। অবশেষে ২৮ অক্টোবর, ১৮৮৬ তারিখে মূর্তিটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

স্ট্যাচু অব লিবার্টির উদ্বোধন – Inauguration of the Statue of Liberty

স্ট্যাচু আব লিবার্টি সম্পূর্ন মূর্তিটিই তৈরী করা হয়েছে ফ্রান্সে। লোহাড় ফ্রেমের উপর তামার পাত দিয়ে, ৩০০ টি খন্ডে তৈরী হয়েছে মূর্তিটি। ১৮৮৫ সালে ২১৪ টি বাক্সে ভরে জাহাজে করে ভাষ্কর্যটি আমেরিকায় পাঠানো হয়। ১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবর, তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ভাষ্কর্যটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। স্ট্যাচু আব লিবার্টি প্রথম থেকেই দেখতে সবুজ রঙের ছিল না, এমনকি একে সবুজ রংও করা হয়নি। মূর্তিটি তামার তৈরী হওয়ায়, শুরুতে এর রংও ছিল তামাটে। দীর্ঘকাল ধরে, এর চারদিকে থাকা সমুদ্রের জলীয়বাষ্পের সাথে তামার বিক্রিয়ায় মূর্তিটি সবুজ রং ধারন করছে। এটি এক বিশেষ ধরনের মরিচা।

সূত্র: roar.media,suktaratv

Related posts

জাতিসংঘে জাতির জনকের মহৎকণ্ঠ

News Desk

শ্রমিকদের অধিকারে আপোষহীন জাতির পিতা

News Desk

একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস

News Desk

Leave a Comment