Image default
ইতিহাস

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন: অসমসাহসী শাণিত কলম

ফিচার ডেস্ক

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে বাঙ্গালী জাতির দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতির দিকে মননশীলতা আর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার অপুর্ব সম্মিলনে যারা প্রধান ভূমিকা রেখে এগিয়ে নিয়েছিলেন, তাদের একজন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন। বিশেষত জাতির আয়না হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যম যে অভূতপূর্ব প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিল শোষণ-বঞ্চনায় জর্জরিত পাকিস্তান পর্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম রচিত হয়েছিল এই দীর্ঘ সময়ে, তার প্রাতঃস্মরণীয় কাণ্ডারির নাম সিরাজুদ্দীন হোসেন। সেজন্যই পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙ্গালী জাতিকে মেধাশূন্য করতে তৈরি বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার অন্যতম প্রধান নামটি ছিল সিরাজুদ্দিনের, ঘাতক আলবদর জল্লাদেরা তাকে কাদালেপা সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল একাত্তরের ডিসেম্বরের ১১ তারিখ। যে শহীদদের তাজা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে সার্বভৌম বাংলাদেশ, তাতে মিশে আছে অসমসাহসী বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের রক্তও!

এদেশের সংবাদপত্র জগতের অন্যতম ভিত্তিমূল ছিলেন তিনি। পাকিস্তান আমলে জান্তা সরকারগুলোর ভয়াবহ শোষণ-নির্যাতন আর বঞ্চনার উপাখ্যানের প্রতিবাদে যে কয়েকজন সাংবাদিকের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত হয়েছিল সাংবাদিকেরা, তাদের একজন সিরাজুদ্দিন হোসেন। মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শরশুনা গ্রামে ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুদ্দিন, মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। একেবারেই অল্প বয়সে পিতৃহীন সিরাজুদ্দিন বহুকষ্টে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে আইএ-তে ভর্তি হন৷ সেখান থেকে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন সিরাজুদ্দিন, থাকতেন বেকার হোস্টেলে।

এই কলেজে পড়ার সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুদ্দীন মোল্লা, আসফউদদৌলা রেজা, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। কলকাতায় ‘আজাদ’ পত্রিকায় তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়েই এ সময় সংবাদপত্রে কাজ নেন তিনি। অর্থকষ্টে কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তার ছিল না তার৷ অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নিজের তৈরি নোটের মাধ্যমে তিনি লেখাপড়া করেন। ‘আজাদ’ তখন কলকাতার মুসলমানদের একমাত্র প্রভাবশালী দৈনিক। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস কাজ করতেন ‘আজাদ’-এ। তিনিই সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে হাজির করলেন সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের কাছে।

প্রতিভাবান সিরাজুদ্দিন স্বীয় কর্মদক্ষতায় মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই শিক্ষানবীশ পর্ব শেষ করে সিনিয়র সাব এডিটর হিসেবে আজাদে কর্মরত হলেন। ধীরে ধীরে তিনি আজাদে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বলাভ করেন। সমসাময়িককালে এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি। বেশ সুনামের সাথে আজাদে কয়েক বছর চাকরী করবার পর সততা ও সত্যের সাথে আপোষহীনতার এক অনুপম নিদর্শন রাখতে গিয়ে আজাদে কর্মচ্যুত হন সিরাজুদ্দিন হোসেন। সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের স্মৃতিচারণেঃ

“‘চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অংশ নিয়েছিল। প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মতে অমিল দেখা গেল। জানুয়ারির শুরুতেই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাচ্ছে। একটি ব্যাপারে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শেরে বাংলা। রটে গেল, শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়েছেন। মুসলিম লীগ শিবিরে তখন দারুণ আনন্দ। ‘আজাদ’-এর সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ বিরোধী শক্তির নাজুক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিলেন। তিনি সেখানকার অন্যতম রিপোর্টার সন্তোষ বসাককে ডেকে যুক্তফ্রন্ট ভাঙনের সংবাদ মুসলিম লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে করার নির্দেশ দিলেন। সারাদিন ঘুরে এমন এক রিপোর্ট করলেন যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। মওলানা সায়েব রিপোর্টটি অনুমোদন করে ওপরে লিখে দিলেন ‘যাবে’। রাতের শিফটে যিনি প্রধান, তাঁর উপর দায়িত্ব বর্তালো রিপোর্টটির উপযুক্ত ব্যবহার করার।
‘আজাদ’-এ সেদিন রাতের শিফটের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। তখন তিনি আজাদের যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক। তাঁর নির্দেশ ও পরিচালনায় রাতের খবর নিয়ন্ত্রিত হয়। রাত দশটার দিকে রাতের শিফট পরিচালনা করতে যেতেন তিনি, ফিরতেন ভোর রাতে। সেদিনও ফাইল দেখতে দেখতে লক্ষ্য করলেন, একটা স্পাইকে ছোট্ট একটা খবর। শেরে বাংলা বলেছেন, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাবার প্রচারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি যুক্তফ্রন্ট থেকে পদত্যাগ করেননি।
সিরাজুদ্দীন হোসেন সত্ সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে শেরে বাংলার বিবৃতিটাই ছেপে দিলেন। সন্তোষ বসাকের রিপোর্টটি ছাপলেন না। পরদিন অফিসে এসে তিনি ছোট্ট একটি খাম পেলেন। সেখানে লেখা আছে, ‘আপনার চাকরির আর প্রয়োজন নাই’।

আজাদ থেকে বেরিয়ে সিরাজুদ্দিন যোগ দেন ইত্তেফাকে, সূচনা হয় সাংবাদিকতার জগতে এক নতুন অধ্যায়ের। সাংবাদিক জগতের আরেক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অসাধারণ দূরদৃষ্টি আর সিরাজুদ্দীন হোসেনের দুর্দান্ত টিমওয়ার্ক ‘ইত্তেফাক’কে অল্পদিনের মধ্যেই একটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে পরিণত করে, বাঙ্গালী মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। এর বাইরেও ষাটের দশকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান সিরাজুদ্দিন। সে সময়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছেলেধরা সমস্যা আশংকাজনকভাবে বাড়ছিল। পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সতর্কবাণী ছাপা হচ্ছিল যে একটা সংঘবদ্ধ চক্র আছে বাচ্চাদের অপহরণের পেছনে।

কিন্তু পুলিশ কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই স্বীকার করছিল না সংঘবদ্ধ কোন চক্রের অপতৎপরতার কথা। আইজি নিজেই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন যে অপহরণের এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ফলে এটিকে রীতিমত এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নামলেন সিরাজুদ্দিন, তার দুর্দান্ত অনুসন্ধানে উঠে এলো তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও, ত্রিশাল ও ভালুকা- এই তিন থানার বিরাট সীমান্ত অঞ্চলের দুর্গম গোচারণ ভূমি এলাকা জুড়ে পরিচালিত এক দুর্ধষ অপহরণ চক্রের অপতৎপরতা। শিশু অপহরণকারীদের এই স্বর্গরাজ্য আবিষ্কৃত হলো সিরাজুদ্দীন হোসেনের উদ্যোগে। সত্তরেরও বেশি শিশুকে উদ্ধার করা হলো। আইপিআই (ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট)-এর ক্রোড়পত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেন ও উদ্ধারকৃত শিশুদের নিয়ে ছাপা হলো প্রতিবেদন। এ জন্য তিনি ম্যাগসেসে মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

তার এই অসমসাহস এবং অসাধারণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চলেছে একাত্তরেও, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসেও সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন অদম্য। একাত্তরের আগেই তার চমৎকার প্রত্যুত্বপন্নমতিতায় এক সুদূরপ্রসারী অর্জন সাধিত হয়। পাকিস্তানী সরকারের রক্তচক্ষু এবং বাধার দেয়াল উপেক্ষা করে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বেতারের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সারাদেশে। অথচ পাকিস্তানীদের প্রবল বাধার মুখে এই ভাষণটি বেতারের সম্প্রচারের সম্ভবনা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল প্রবলভাবে। সিরাজুদ্দিনের সময়উপযোগী উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রেডিও ব্রডকাস্টের মাধ্যমে পৌঁছে যায় দেশব্যাপী। একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণটি বেতারে প্রচারের দাবি কী করে উঠল, তা সাংবাদিক আমির হোসেনের বয়ানে শোনা যাক-

“২রা মার্চের কথা। রাতের মতো কাজ শেষ করে বাসায় ফিরবার আগে সিরাজ ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, চলে যাচ্ছি, সব কাজ শেষ। সিরাজ ভাই একটা নিউজের কপি দেখছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, সাংবাদিকদের কাজ আবার শেষ হয় কী করে? লেখা শেষ হয়ে থাকলে বসে পত্রিকা পড়। ঘরে ফেরার তাড়া কিসের?

আমি বললাম, তাড়া নেই কিছুই। আজকের মতো যা লেখার ছিল শেষ করেছি। তাই যেতে চাইছিলাম।

সিরাজ ভাই চায়ের অর্ডার দিয়ে বললেন, চা খা। ক্লান্তি আর ঘুম দুটোই পালাবে।

চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।

হাতের কপিটা দেখা শেষ করে সিরাজ ভাই বললেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে যে ভাষণ দেবেন, সেটা রেডিওতে প্রচারিত হলে সারাদেশের মানুষ শুনতে পেত। মিটিং-এ তো লোক আসবে বড়জোর ৮-১০ লাখ। পত্রিকা পড়বে ধর তার কয়েকগুণ। কিন্তু বাকিরা? সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ৭ কোটিই শুনতে পাবে না, জানতেও পারবে না তিনি কী বললেন। অথচ ভাষণটা রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা হলে মুহূর্তের মধ্যে তা ঘরে ঘরে পেঁৗছে যাবে।

আমি বললাম, কিন্তু সেটা হবে কী করে?

সিরাজ ভাই বললেন, হতে পারে। দেখ না চেষ্টা করে। চা খেয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ধর। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা রেডিওতে প্রচারের দাবি জানিয়ে একটি বিবৃতি ছেপে দিই। দেখা যাক কিছু হয় কি না। বিবৃতিটা তুই-ই লিখে ফেল, শুধু কনসেপ্ট নিয়েনে।

তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। চা খেতে খেতেই টেলিফোন করতে শুরু করলাম। তাজউদ্দিন সাহেব থেকে শুরু করে যাকেই ডায়াল করি, হয় ঘুমে না হয় বাইরে। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কোনো নেতাকেই পেলাম না। বললাম, কাউকেই তো পাচ্ছি না, কাল চেষ্টা করে দেখব?

সিরাজ ভাই বললেন, সময় চলে যাচ্ছে। দেরি করা ঠিক হবে না। কি করা যায়, বলত?

আমি বললাম, বিবৃতিটা তোফায়েল আহমদের নামে হলে যদি চলে, ছেপে দিই। কাল তাঁকে সব খুলে বললেই হবে।

সিরাজ ভাই রাজি হলেন। আমি তখনকার যুবনেতা তোফায়েল আহমদের নামে বিবৃতি তৈরি করে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি সম্বলিত সেই বিবৃতি পরদিন ‘ইত্তেফাক’-এ ছাপা হলো।

সেদিনই বিকেলে তোফায়েল আহমদের সঙ্গে দেখা করি আওয়ামী লীগ অফিসে। আমাকে দেখেই তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারছি বিবৃতিটা আপনিই ছেপে দিয়েছেন। সারাদিন বিভিন্ন পত্রিকার লোকজন অনুযোগ করছে, বিবৃতিটা শুধু ইত্তেফাকে পাঠালেন কেন? শেষে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, তাই তার পক্ষে সব পত্রিকায় পাঠানো সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু অফিসেই ছিলেন। তোফায়েল আহমদের সঙ্গে তাঁর রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন, আমির, তোর বিরুদ্ধে তোফায়েলের নালিশ আছে। তার অনুমতি ছাড়া তুই নাকি তার নাম জাল করে বিবৃতি ছেপেছিস ‘ইত্তেফাক’-এ।

আমি বললাম, যা করেছি গুড ফেইথে করেছি এবং সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে করেছি। সুতরাং এই নালিশে আমি ঘাবড়াইনি।

বঙ্গবন্ধু বললেন, খুব ভালো করেছিস। এটা আরো আগেই করা উচিত ছিল। ওরা হয়তো খেয়াল করেনি। সিরাজ এসব ব্যাপারে খুব সজাগ। এজন্যই তো আমি ওর ওপর এত ভরসা করি। তোফায়েলের বিবৃতিটা তোরা ভালোই ছেপেছিস। আজ এ ব্যাপারে তাজউদ্দিনের বিবৃতি যাচ্ছে পত্রিকায়।

পরদিন পত্রিকায় তাজউদ্দিন আহমদের বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের দাবি ক্রমশ এমনই জোরালো হয়ে ওঠে যে, কর্তৃপক্ষ এ দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। ৭ মার্চ রেসকোর্স থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সম্পূর্ণ প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরকারি উচ্চ মহলের নির্দেশে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে শুরু করলে দেখা যায় রেডিওতে তা প্রচার হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এই আশংকা করেই বেতারে তাঁর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। কর্তৃপক্ষ ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হওয়ার ঘটনাটি ছিল অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যপূর্ণ। কিন্তু সেই রাতে সিরাজুদ্দীন হোসেন ঐভাবে দৃশ্যত সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে ইত্তেফাকে তোফায়েল আহমদের নামে উল্লিখিত বিবৃতিটি প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে বঙ্গবন্ধৃর ৭ মার্চের ভাষণটি আদৌ রেডিওতে প্রচারিত হতো কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে।’ (আমির হোসেন, ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই/স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, ২৯৭-২৯৯ পৃষ্ঠা)

একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া ইত্তেফাক অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু সিরাজুদ্দিন দমে যাননি, আবার ইত্তেফাক অফিস চালু হলে অবরুদ্ধ শহরে হায়েনার নাগপাশের ভেতরেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। এপ্রিলের মাঝমাঝি সময়ে ইত্তেফাক সাংবাদিক শফিকুল কবির সীমান্ত পাড়ি দিতে চাইলে তাকে সীমান্তের ওপারে গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ বা জিনিস পাঠাবার কাজে ব্যবহার করতেন সিরাজুদ্দিন। আগরতলার কংগ্রেস ভবন পর্যন্ত তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল শফিকুল কবীরের। তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

তার দুর্দান্ত অনুসিন্ধানী সাংবাদিকতা বজায় ছিল পুরো একাত্তর জুড়েই। কারা কারা দালাল হিসেবে পাকিস্তানী সেনাদের প্রশ্রয়ে লুটপাট এবং রাহাজানি চালিয়েছে সেটার বিস্তারিত বিবরণ টুকে রেখেছিলেন তিনি। কি ধরনের ডিটেইলসে সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তার একটি নমুনা পাওয়া যায় সাংবাদিক শফিকুল কবীরের ‘সিরাজ ভাইয়ের শেষ কথা’ নামের স্মৃতিচারণে-

সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ৩০ নভেম্বর, মঙ্গলবার। ‘ইত্তেফাক’-এ তার জন্য বসে অপেক্ষা করছি। বাইরের কি কাজ সেরে তিনি অফিস এলেন সাড়ে বারোটার দিকে। অফিস কক্ষে প্রথমেই রাইটিং প্যাড টেনে নিয়ে খুব দ্রুত কিছু লিখতে লাগলেন। মাত্র একটি স্লিপ লেখার পরই অফিস কক্ষে অন্যান্য লোকজন ঢুকে গেল। তিনি লেখা বন্ধ করলেন। লেখা স্লিপটি সতর্কভাবে গুঁজে দিলেন আমার হাতে। কিছুক্ষণ পর লোকজনের ভিড় কমলে তিনি বললেন, ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই তথ্যগুলো আমি পেয়েছি। তোকে আরও কিছু জোগাড় করে দেব। এগুলো ওপারে পাচার করার ব্যবস্থা করতে হবে।’ সিরাজ ভাইয়ের লেখা সেই স্লিপটি এখনো সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছি। তার হুবহু অনুলিপি তুলে ধরছি।

ঈমানের বরকতে

১. মন্ত্রী আবুল কাশেম-ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়ের মালিক, বর্তমান নাম কাশেম টেক্সটাইল মিলস।

২. মওলানা আমিনুল ইসলাম-সদরঘাটের বিখ্যাত ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরী ও যাবতীয় সম্পত্তির মালিক। এপ্রিলের প্রথমভাগে লাইব্রেরী লুট করিয়ে ১০ টাকা মণ দরে বই বিক্রি করেন। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাও ওই একই দরে বিক্রি হয়। সম্প্রতি নিজ নামে অ্যালট করিয়ে দখলীদার।

৩. মওলানা আবদুল মান্নান-মদন মোহন মন্দির ভবনের বর্তমান মালিক।

সংক্ষেপে সিরাজ ভাই লিখলেও এখানে অস্পষ্ট কিছু নেই। পাক সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ফন্দি-ফিকির করে দালাল কোম্পানি কীভাবে মানুষের ধন-সম্পদ লুন্ঠন ও আত্মসাত্ করত, এইটি তার একটি নমুনা মাত্র।

একাত্তর জুড়ে কলম হাতে তার অসামান্য কর্মতৎপরতা চোখ এড়ায়নি পাকিস্তানী সেনা এবং জামায়াতে ইসলামীর আলবদর জল্লাদদের। ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানীদের বর্বরতম জেনোসাইড এবং অপরাধের আলোচনা করতে তিনি, যা তখনকার সময়ের হিসেবে ছিল আত্মঘাতী। ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’ নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট।’ এ সময় জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ ‘অতএব ঠগ বাছিও না’ নামে একটি উপ সম্পাদকীয় লিখে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু এসব হুমকি সিরাজুদ্দিনের কলমকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সকল বাধা উপেক্ষা করে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সংবাদ পরিবেশন করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে।

ফলে যেটা অবধারিত, সেটাই ঘটলো। বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জঘন্যতম বর্বরতার ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরের ১১ তারিখে তাকে শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর জল্লাদেরা। ৩রা নভেম্বর, ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দিন হোসেন সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। দুজনেই যথাক্রমে লন্ডন ও নিউইয়র্কে এখন বিশাল মুসলিম নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ, গণ্যমান্য ব্যাক্তি! যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দাতা যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা সরকার নিরাপদে রেখেছে তাদের।

অসমসাহসী সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দিন তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। তার কীর্তি ও দর্শন যদি আমাদের চর্চার বিষয়বস্তু হয়, চলার পথের পাথেয় হয়, তবেই তার পুণ্যময় স্মৃতির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা যাবে। যত দ্রুত সম্ভব চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর করতে হবে। শহীদদের তাজা রক্তের কাছে এটা আমাদের জাতির দায়।

তথ্যসূত্রঃ

১। জাহীদ রেজা নূর ( শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের সন্তান)
২। সিরাজ ভাইয়ের শেষ কথা’ -শফিকুল কবির
৩। ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই/স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন- আমির হোসেন

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Source link

Related posts

লেবাননের হোটেলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুরহস্য

News Desk

ভাটির কিংবদন্তি বাউলসম্রাট আবদুল করিম

News Desk

ভারতে ক্লাস থেকে মুঘল ইসলামিক সাম্রাজ্যের অধ্যায়গুলি সরানো হয়েছে

News Desk

Leave a Comment