সোভিয়েত ইউনিয়নের জনক লেনিনের একটি লাতিন দিকও ছিল। গ্যেটে ছিল তাঁর কাছে পূজনীয়। তাঁর শত্রুদের তিনি উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করতেন।
রাশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর সাহিত্যের প্রভাব ছিল। এর মধ্যেই ভ্লাদিমির ইলিয়াচ লেনিন বেড়ে উঠেছেন। জার শাসনের অধীনে প্রকাশ্য রাজনৈতিক লেখাজোখা প্রকাশ করা কঠিন ছিল। প্রাবন্ধিকদের ‘আরোগ্য লাভ’ না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকতে হতো; অন্যভাবে বলতে গেলে, যতক্ষণ পর্যন্ত জনসমক্ষে তাঁদের মতামত পরিত্যাগ না করা হতো, ততক্ষণ রেহাই ছিল না। তবে এসবের মধ্যেও উপন্যাস ও কবিতা কিছুটা নরম দৃষ্টিতে দেখা হতো, যদিও সব ক্ষেত্রে নয়।
স্বাভাবিকভাবেই মুখ্য সেন্সর ছিল জার। ‘জনগণের পিতা’ পুশকিনের কবিতা প্রকাশের আগে প্রথম নিকোলাস অনেক কবিতা না পড়ে ছাপতে দেননি। ফলে কিছু কবিতা নিষিদ্ধ হয়েছিল, কিছু বিলম্বিত করা হয়েছিল এবং সবচেয়ে আক্রমনাত্মক কবিতাগুলো ভয়ার্ত লেখক নিজে ধ্বংস করে দেন এই ভয়ে যে তাঁর বাড়িতে আক্রমণ হতে পারে। ইউজিন ওনেজিন-এর পুড়িয়ে ফেলা চরণগুলোয় কী ছিল, তা আমরা কখনোই জানতে পারব না।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/1.png)
এতত্সত্ত্বেও, ভিন্ন অর্থে রাজনীতি এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্য রাশিয়ার ফিকশনকে এমনভাবে বিহ্বল করেছিল, যা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশের বিচারে ছিল অতুলনীয়। রাজনৈতিক সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনা যতটুকু করা যেত, তাতে রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের জন্য বাছাই করার অনেক বিকল্প ছিল। তাঁরা শক্তিশালী সমালোচক ভিসারিয়ন বেলিনস্কি এবং নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগোলের মধ্যকার তিক্ত দ্বন্দ্ব গোগ্রাসে গিলতেন। গোগোলের ১৮৪২ সালের প্রখর বিদ্রূপাত্মক ডেড সোলস পুরো দেশকে চাঙা করেছিল। অজ্ঞরজ্ঞানহীনদেরও সশব্দে পড়ে শোনানো হতো।
যা হোক, সাফল্যই গোগোলের সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে একটি লেখায় তিনি দুর্গন্ধপীড়িত কৃষক ও অশিক্ষাকে প্রতিহত করা বিষয়ে লেখা প্রত্যাহার করেছিলেন। ডেড সোলস-এর দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বইয়ের অনেক কিছুই ভুল করে লেখা হয়েছে। এগুলো আসলে রাশিয়ায় ঘটছে না। প্রিয় পাঠক, আপনারা আমাকে সংশোধন করে দিন। এই বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না। আমি চাই আপনারা আমাকে সংশোধন করুন।’
ক্ষুব্ধ বেলনস্কি ১৮৪৭ সালে জনসমক্ষে গোগোলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বেলনস্কির ব্যাপকভাবে প্রচারিত ‘লেটার টু গোগোল’-এর গ্রহীতা দীর্ঘ নিদ্রাহীন রাত পার করেছিল:
রাশিয়ার জনগণ সম্পর্কে আমি খুব কমই জানি। আপনার বই আমাকে আতঙ্কিত করেছে, কারণ এই বই সরকার ও সেন্সরশিপের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, জনগণের ওপর নয়। সরকার আপনার বই (বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্বাচিত অনুচ্ছেদগুলো) হাজার হাজার কপি প্রকাশ করবে এবং খুবই কম দামে তা বিক্রি করবে বলে যখন সেন্ট পিটার্সবার্গে গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তখন আমার বন্ধুরা হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমি তাদের তখনই বলেছিলাম যে সবকিছু সত্ত্বেও এই বই সাফল্য পাবে না এবং খুব শিগগির তা বিস্মৃত হবে। বস্তুত, বই সম্পর্কে যেসব নিবন্ধ লেখা হয়েছে তা বইয়ের চেয়ে এখন বেশি স্মরণ করা হয়। হ্যাঁ, যদিও এখনো অপরিণত, তবুও রুশদের সত্যের ব্যাপারে একটি গভীর প্রবৃত্তি রয়েছে।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/10-820x510-1.jpg)
পরবর্তী সময়ে সমালোচকেরা আরও বেশি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করা শুরু করেছিল। কোনো ঔপন্যাসিক ও নাট্যকারের কাজকে তারা তত বেশি প্রভাবশালী মনে না করলে নিন্দা করতে দ্বিধা করত না।
লেনিন এ রকমই একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সংরক্ষণপ্রবণ ব্যক্তি এবং তাঁর এলাকার বিদ্যালয়গুলোর প্রধান পরিদর্শক। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। বাড়িতে রোববার বিকেল করে শেক্সপিয়ার, গ্যেটে, পুশকিনসহ অন্যদের সাহিত্য সশব্দে পড়া হতো। ইউলিয়ানভ পরিবারের (জার গোপন পুলিশের চোখে ধুলা দিতে ‘লেনিন’ নামটি ছদ্মনাম হিসেবে গ্রহণ করেছিল) জন্য উচ্চ সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা ছিল অসম্ভব।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসে লেনিন লাতিন ভাষার প্রেমে পড়ে যান। লেনিনের প্রধান শিক্ষকের অনেক উচ্চাশা ছিল যে তিনি একদিন ভাষাবিজ্ঞানী ও লাতিন ভাষার পণ্ডিত হবেন। তবে ইতিহাসের অভিলাষ ছিল ভিন্ন। কিন্তু লাতিনের প্রতি লেনিনের আসক্তি এবং ধ্রুপদির প্রতি অভিরুচি কখনোই তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ভার্জিল, ওভিড, হোরাস ও জুভেনাল তিনি উত্পত্তি ভাষায়ই পড়েছেন। রোমান সিনেটের ভাষণও তিনি পড়েছেন। দুই বছর নির্বাসনে থাকার সময়ে তিনি গ্যেটের সাহিত্য গোগ্রাসে গিলেছেন। ফস্ট তিনি বারবার পড়েছেন।
লেনিন এমন সময়ে তাঁর ধ্রুপদি জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করেছেন যখন ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব ধাবমান। সে বছরের এপ্রিল মাসে তিনি রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক অর্থোডক্সির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং এক গাদা চরমভাবাপন্ন তত্ত্ব দিয়ে রাশিয়ায় একটি সামাজিক বিপ্লবের ডাক দেন। লেনিনের নিজের বেশ ঘনিষ্ঠ কিছু কমরেড তাঁর নিন্দা করেন। ক্ষিপ্র প্রত্যাঘাতে লেনিন গ্যেটের শ্রেষ্ঠ কাজ মিফিস্টোফিলিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘হে বন্ধু, তত্ত্ব হলো ধূসর, কিন্তু সবুজ হলো জীবনের শাশ্বত বৃক্ষ।’
ধ্রুপদি রুশ সাহিত্য যে সব সময় রাজনীতির সঙ্গে অনুপ্রবিষ্ট ছিল তা অন্যদের চেয়ে লেনিন ভালো জানতেন। এমনকি সবচেয়ে ‘অরাজনৈতিক’ লেখকদের জন্যও দেশের অবস্থার ব্যাপারে ঘৃণা লুকানো কঠিন ছিল। ইভান গঞ্চারভের উপন্যাস অব্লোমভ এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। লেনিন এই উপন্যাসকে ভালোবাসতেন। এখানে বিষয়ী ভদ্র সম্প্রদায়ের নির্জীবতা, শ্রমবিমুখতা ও শূন্যতার চিত্র রয়েছে। এই বইয়ের সাফল্যের কারণে রুশ শব্দকোষে একটি নতুন শব্দ সংযুক্ত হয়: অব্লোমভিজম। স্বৈরতন্ত্রকে যে শ্রেণি এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, তাদের নেতিবাচক অর্থে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে লেনিন বলেছেন যে এই রোগ শুধু উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জার আমলাতন্ত্রের একটি বড় অংশকে অব্লোমভিজম আক্রান্ত করেছিল এবং আরও নিচের শ্রেণিতেও ধাবিত হয়েছিল। এমনকি বলশেভিক সদস্যরাও এই রোগ থেকে মুক্ত ছিল না। এই উদাহরণ থেকে দেখা যায় গঞ্চারভ যে দর্পণ উঁচিয়ে ধরেছিলেন তাতে সমাজের বহুলাংশই প্রতিফলিত হয়েছিল। লেনিন তাঁর তর্কে প্রায়ই বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করতেন রাশিয়ার কল্পকাহিনির সর্বদা অখুশি চরিত্র এবং মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করার মাধ্যমে।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/4-1.jpg)
শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পদ্ধতির ব্যাপারে লেখকদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। মতবিরোধ অবশ্য শুধু লেখকদের মধ্যেই না, অন্যদের মধ্যেও ছিল। প্রথম নিকোলাসের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বিরুদ্ধে ১৮২৫ সালে গড়ে ওঠা ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহকে পুশকিন সমর্থন করেছিলেন। গোগোল সামন্তবাদের অত্যাচারকে বিদ্রূপ করেছিলেন, যদিও পরে দ্রুত পিছু হটেন। তুর্গেনিভ জারদের সম্পর্কে সমালোচনামুখর ছিলেন, কিন্তু সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া ধ্বংসবাদীদের প্রচণ্ড রকম অপছন্দ করতেন। সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নৈরাজ্য-সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে দস্তয়েভস্কির প্রণয় ঠিক বিপরীত রূপে পরিণত হয়েছিল। রুশ স্বৈরতন্ত্রের প্রতি তলস্তয়ের আক্রমণে লেনিন খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অতীন্দ্রিয়বাদী খ্রিষ্টধর্ম ও শান্তিবাদে লেনিন নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। সে জন্য লেনিন প্রশ্ন করেন, কীভাবে এমন একজন প্রতিভাধর লেখক একই সঙ্গে বিপ্লবী আবার প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন? লেনিন আধা ডজন নিবন্ধের মাধ্যমে তলস্তয়ের কাজের মধ্যে বিদ্যমান গভীর স্ববিরোধিতা উন্মোচন করেছেন। লেনিন যে তলস্তয়কে চিত্রিত করেছেন, তিনি একটি স্বচ্ছ রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম ছিলেন—তাঁর উপন্যাসে কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষণ ও সামষ্টিক ক্ষোভ যেমন স্বীকৃত হয়েছে, তেমনি প্রকাশও পেয়েছে। কিন্তু তিনি রোগ প্রতিকারের কোনো পথ বাতলে দেননি। একটি সঠিক বিপ্লবী ভবিষ্যত্ বিবেচনা না করে তলস্তয় সান্ত্বনা খুঁজেছেন একটি সরল, খ্রিষ্টীয় অতীতের অবাস্তব ছায়ায়। ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ লিও তলস্তয়’-এ লেনিন লিখেছেন, ‘তলস্তয়ের মতামত ও মতাদর্শের মধ্যে অসংগতি কোনো দৈবিক ঘটনা নয়, সেগুলো উনিশ শতকের শেষভাগে রুশ জীবনের স্ববিরোধী অবস্থাই প্রকাশ করে।’ এভাবেই তলস্তয়ের স্ববিরোধিতা লেনিনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কার্যকর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
ইতিমধ্যে দস্তয়েভস্কির কাল্ট অব সাফারিং লেনিনকে বিরস করে ফেলেছে, যদিও দস্তয়েভস্কির লেখার ক্ষমতা ছিল অনস্বীকার্য। যা হোক, সাহিত্য বিষয়ে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়নি। বিপ্লবের ঠিক এক বছরের কম সময়ের মধ্যে, ১৯১৮ সালের ২ আগস্ট, সংবাদপত্র ইজতেভেস্তিয়া বেশ কিছু ব্যক্তির নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যাঁদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাঁদের নামের তালিকা ছিল এটা। সেখানে তলস্তয়ের পরেই দস্তয়েভস্কির নাম ছিল। সে বছরের নভেম্বরে প্রতীকীবাদী কবি ভিচেস্লাভ ইভানভের শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে মস্কো সোভিয়েতের প্রতিনিধি সেই স্মৃতিস্তম্ভ মস্কোয় উন্মোচন করে।
সম্ভবত নিকোলাই চেরনিশেভস্কি লেখক হিসেবে লেনিনের ওপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি একটি পুরো বিপ্লবী প্রজন্মের ওপরই প্রভাব রেখেছিলেন। চেরনিশেভস্কির বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক। এ ছাড়া তিনি একজন বস্তুবাদী দার্শনিক ও সমাজতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর কাল্পনিক উপন্যাস হোয়াট ইজ টু বি ডান? লিখেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের পিটার ও পল দুর্গে। এখানেই তাঁকে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। হোয়াট ইজ টু বি ডান? একটি নতুন প্রজন্মের বাইবেলে পরিণত হয়েছিল। কারাগার থেকে গোপনে লেখা হয়েছিল বলে এই উপন্যাসের বাড়তি আকর্ষণ ছিল। মার্ক্সের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বহু আগেই চেরনিশেভস্কির এই বই লেনিনকে রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থায় উত্সাহিত করেছিল (মার্ক্সের সঙ্গে চেরনিশেভস্কি চিঠি বিনিময় করেছেন)। সাবেক চরমপন্থী জনপ্রিয় লেখকের স্মরণে লেনিন তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মের নাম দিয়েছিলেন হোয়াট ইজ টু বি ডান?। তিনি ১৯০২ সালে বইটি লেখেন। একই সালে তা প্রকাশিত হয়েছিল।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/6.jpg)
চেরনিশেভস্কির উপন্যাসের ব্যাপক সাফল্যে প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিকেরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বিশেষ করে তুর্গেনেভ ভয়ংকরভাবে চেরনিশেভস্কির বইকে আক্রমণ করেছিলেন। উগ্র সমালোচক দব্রলিউবভ ও পিছারেভ এই পিত্তজ্বালার জবাব দিয়েছিলেন জ্বলন্ত বিছুটির আঘাতের মাধ্যমে (দব্রলিউবভকে ছাত্ররা সম্বোধন করতেন ‘আমাদের দিদেরোত’ বলে)। তুর্গেনেভ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। একটি উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে তিনি চেরনিশেভস্কির বিরোধিতা করতে গিয়ে চিত্কার করে বলেন, ‘তুমি একটা সাপ, আর ওই দব্রলিউবভ একটি র্যাটল সাপ।’
যে উপন্যাস বিষয়ে এত বিতর্ক সেটা কী রকম? গত ৫০ বছরে আমি প্রতিটি পাতা পড়ার জন্য তিনবার চেষ্টা করেছি। তিনটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এটা রুশ সাহিত্যের কোনো ধ্রুপদি নয়। এই উপন্যাস তার নিজের সময়ে ব্যাপ্ত ছিল এবং রুশ বুদ্ধিজীবী-মহলের সন্ত্রাস-পরবর্তী অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নিঃসন্দেহে এটা সব ক্ষেত্রেই খুব চরমভাবাপন্ন, বিশেষ করে লিঙ্গসমতা এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের জায়গায়। এ ছাড়া কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, শত্রুকে চিহ্নিত করা যায় এবং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বাঁচতে হয়, সে ব্যাপারেও এই উপন্যাস চরমভাবাপন্ন। চেরনিশেভস্কিকে প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন ভ্লাদিমির নাবোকভ, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেননি। নাবোকভ তাঁর শেষ রুশ উপন্যাস দ্য গিফট-এ ৫০ পাতা ব্যয় করেছিলেন চেরনিশেভস্কি এবং তাঁর পক্ষের ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে ‘খুব নিশ্চিতভাবেই সমসাময়িক উচ্চশ্রেণির লেখকদের মধ্যে নিম্নজাতের চেরনিশেভস্কির প্রতি শ্রেণিদাম্ভিকতার আভাস ছিল’ এবং ব্যক্তিগতভাবে ‘তলস্তয় ও তুর্গেনেভ তাকে “ছারপোকার গন্ধমাখা ভদ্রলোক” বলে ডাকতেন…এবং চেরনিশেভস্কিকে তাঁরা সব ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই করেছেন। তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আংশিক ছিল ঈর্ষা থেকে, কারণ তাঁদের নাক-উঁচু স্বভাব তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। চেরনিশেভস্কি জমিদারি তালুক ধ্বংস করতে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন এবং সেসব ভূমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে চাচ্ছিলেন। তাই গভীর বদ্ধমূল রাজনৈতিক শত্রুতাও একটা কারণ, বিশেষ করে তুর্গেনেভের ক্ষেত্রে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৭ সালের এই আন্তবিপ্লবের সময়ে লেনিন যখন নির্বাসনে ছিলেন, তখন তরুণ বলশেভিকরা তাঁকে দেখতে যেত। লেনিন সেসব তরুণের ওপর ক্ষুব্ধ হতেন যখন তারা চেরনিশেভস্কির বইকে বিদ্রূপ করে বলত যে এটা পড়ার উপযুক্ত নয়। লেনিন কড়া জবাবে বলতেন যে এই বইয়ের গভীরতা ও দূরদর্শিতা বোঝার মতো বয়স এদের হয়নি। তাদের উচিত বয়স ৪০ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। তখন তারা বুঝবে যে চেরনিশেভস্কির দর্শনের ভিত্তি খুবই সাদামাটা বিষয়: আমরা আদম-হাওয়া থেকে জন্ম নিইনি। আমরা বনমানুষের বংশধর; জীবন খুবই ছোট সময়ের জৈবিক প্রক্রিয়া, তাই সব মানুষের জন্য সুখ আনয়ন করা প্রয়োজন। যে পৃথিবী লোভ, ঘৃণা, যুদ্ধ, অহমিকা ও শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেখানে তা কখনোই সম্ভব নয়। সে জন্যই একটা সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন। যে সময়ে তরুণ বলশেভিকরা লেনিনের সঙ্গে সুইস পর্বতমালায় আরোহণ করছিল তখন তাদের বয়স ৪০ ছুঁই-ছুঁই ছিল, তবে বিপ্লব তত দিনে ঘটে গেছে। এখন যেসব ইতিহাসবিদ লেনিনের চিন্তার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন তাঁদেরই বেশি চেরনিশেভস্কি পড়তে হয়। বিজ্ঞ প্রগতিশীল দল খুশিমনে মায়াকোভস্কির প্রতি ঝুঁকেছে। কিন্তু লেনিন তা করেননি।
প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লেনিনের খুব গভীরে প্রোথিত ছিল। ফলে যেসব উত্তেজনাকর শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবকালে সৃষ্টি হয়েছিল তা লেনিনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। রাশিয়া বা অন্য কোথাও আধুনিকতাবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তাঁর জন্য কঠিন ছিল। শিল্পসম্মত প্রগতির পুরোধা বা আভানগার্দ, যেমন মায়াকোভস্কি ও অন্য কনস্ট্রাক্টিভিস্টদের কাজ লেনিনের কাছে রুচিসম্মত ছিল না।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/160105162256_russian_revolution_640x360_unk_nocredit.jpg)
কবি ও শিল্পীরা নিরর্থক তাঁকে বলেছিলেন যে পুশকিন ও লারমনটোভের ভক্ত হলেও তারা বিপ্লবী। তারা পুরোনো শিল্পকে মানতে নারাজ। তারা এমন ভিন্ন ও নতুন কিছু সৃষ্টি করছে যা বলশেভিজম ও বিপ্লবী যুগের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু লেনিন একদমই টলেননি। কবি-শিল্পীরা যা খুশি লিখতে-আঁকতে পারেন। কিন্তু তাকে কেন জোর করে সেসবের প্রশংসা করতে হবে? লেনিনের অনেক সহকর্মী নতুন আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। বুখারিন, লুনাচারস্কি, ক্রুপস্কায়া, কল্লোন্তাই এবং কিছুটা ট্রটস্কিও বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ নতুন দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। আভানগার্দের মধ্যেও দ্বন্দ্ব, দ্বিধা ও স্ববিরোধিতা ছিল। সরকারের মধ্যে আভানগার্দের সমর্থক ছিলেন আনাতোলি লুনাচারস্কি। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিষয়ক গণবিভাগে। এই বিভাগে লেনিনের স্ত্রী নাদিয়া ক্রুপস্কায়াও কাজ করতেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন কাগজের ঘাটতি ঘটায় তীব্র বাদানুবাদের জন্ম হয়। তাদের কি প্রচারণামূলক লিফলেট ছাপানো উচিত নাকি মায়াকোভস্কির নতুন কবিতা? লেনিন লিফলেট ছাপার পক্ষে ছিলেন। লুনাচারস্কি মনে করতেন মায়াকোভস্কির কবিতা অনেক বেশি কার্যকর হবে। শেষতক কবিতাই ছাপা হয়েছিল।
লেনিন ‘প্রলেতেরিয়ান সাহিত্য ও শিল্প’ ধারণার প্রতিও বিরূপ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে যে দেশে সংস্কৃতির অবস্থা এত নিম্নমানের, সেখানে যান্ত্রিক ও মৃত সূত্র দিয়ে বুর্জোয়া সংস্কৃতি এবং এর প্রাচীন পূর্বসূরির শিখর অতিক্রম করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্টকাট পদ্ধতি কাজ করবে না। লেনিনের মৃত্যুর পরের খারাপ সময়গুলোতে এটা এক্সক্রিমেন্টাল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদীরা’ তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করেছিলেন। সৃজনশীলতাকে অসার করে ফেলা হয়েছিল। প্রয়োজনের রাজ্য পেরিয়ে সবার জীবন যুক্তিবোধ দিয়ে গঠিত হবে—এমন এক মুক্তির রাজ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনো তৈরি হয়নি। সে অর্থে বললে, কোথাও তৈরি হয়নি।
অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্
সোভিয়েত ইউনিয়নের জনক লেনিনের একটি লাতিন দিকও ছিল। গ্যেটে ছিল তাঁর কাছে পূজনীয়। তাঁর শত্রুদের তিনি উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করতেন।
রাশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর সাহিত্যের প্রভাব ছিল। এর মধ্যেই ভ্লাদিমির ইলিয়াচ লেনিন বেড়ে উঠেছেন। জার শাসনের অধীনে প্রকাশ্য রাজনৈতিক লেখাজোখা প্রকাশ করা কঠিন ছিল। প্রাবন্ধিকদের ‘আরোগ্য লাভ’ না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকতে হতো; অন্যভাবে বলতে গেলে, যতক্ষণ পর্যন্ত জনসমক্ষে তাঁদের মতামত পরিত্যাগ না করা হতো, ততক্ষণ রেহাই ছিল না। তবে এসবের মধ্যেও উপন্যাস ও কবিতা কিছুটা নরম দৃষ্টিতে দেখা হতো, যদিও সব ক্ষেত্রে নয়।
স্বাভাবিকভাবেই মুখ্য সেন্সর ছিল জার। ‘জনগণের পিতা’ পুশকিনের কবিতা প্রকাশের আগে প্রথম নিকোলাস অনেক কবিতা না পড়ে ছাপতে দেননি। ফলে কিছু কবিতা নিষিদ্ধ হয়েছিল, কিছু বিলম্বিত করা হয়েছিল এবং সবচেয়ে আক্রমনাত্মক কবিতাগুলো ভয়ার্ত লেখক নিজে ধ্বংস করে দেন এই ভয়ে যে তাঁর বাড়িতে আক্রমণ হতে পারে। ইউজিন ওনেজিন-এর পুড়িয়ে ফেলা চরণগুলোয় কী ছিল, তা আমরা কখনোই জানতে পারব না।
এতত্সত্ত্বেও, ভিন্ন অর্থে রাজনীতি এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্য রাশিয়ার ফিকশনকে এমনভাবে বিহ্বল করেছিল, যা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশের বিচারে ছিল অতুলনীয়। রাজনৈতিক সাহিত্য ও সাহিত্য সমালোচনা যতটুকু করা যেত, তাতে রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের জন্য বাছাই করার অনেক বিকল্প ছিল। তাঁরা শক্তিশালী সমালোচক ভিসারিয়ন বেলিনস্কি এবং নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগোলের মধ্যকার তিক্ত দ্বন্দ্ব গোগ্রাসে গিলতেন। গোগোলের ১৮৪২ সালের প্রখর বিদ্রূপাত্মক ডেড সোলস পুরো দেশকে চাঙা করেছিল। অজ্ঞরজ্ঞানহীনদেরও সশব্দে পড়ে শোনানো হতো।
যা হোক, সাফল্যই গোগোলের সর্বনাশের কারণ হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে একটি লেখায় তিনি দুর্গন্ধপীড়িত কৃষক ও অশিক্ষাকে প্রতিহত করা বিষয়ে লেখা প্রত্যাহার করেছিলেন। ডেড সোলস-এর দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বইয়ের অনেক কিছুই ভুল করে লেখা হয়েছে। এগুলো আসলে রাশিয়ায় ঘটছে না। প্রিয় পাঠক, আপনারা আমাকে সংশোধন করে দিন। এই বিষয়টি এড়িয়ে যাবেন না। আমি চাই আপনারা আমাকে সংশোধন করুন।’
ক্ষুব্ধ বেলনস্কি ১৮৪৭ সালে জনসমক্ষে গোগোলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বেলনস্কির ব্যাপকভাবে প্রচারিত ‘লেটার টু গোগোল’-এর গ্রহীতা দীর্ঘ নিদ্রাহীন রাত পার করেছিল:
রাশিয়ার জনগণ সম্পর্কে আমি খুব কমই জানি। আপনার বই আমাকে আতঙ্কিত করেছে, কারণ এই বই সরকার ও সেন্সরশিপের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, জনগণের ওপর নয়। সরকার আপনার বই (বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্বাচিত অনুচ্ছেদগুলো) হাজার হাজার কপি প্রকাশ করবে এবং খুবই কম দামে তা বিক্রি করবে বলে যখন সেন্ট পিটার্সবার্গে গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তখন আমার বন্ধুরা হতাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমি তাদের তখনই বলেছিলাম যে সবকিছু সত্ত্বেও এই বই সাফল্য পাবে না এবং খুব শিগগির তা বিস্মৃত হবে। বস্তুত, বই সম্পর্কে যেসব নিবন্ধ লেখা হয়েছে তা বইয়ের চেয়ে এখন বেশি স্মরণ করা হয়। হ্যাঁ, যদিও এখনো অপরিণত, তবুও রুশদের সত্যের ব্যাপারে একটি গভীর প্রবৃত্তি রয়েছে।
![লেনিনের সাহিত্যপ্রেম ও রুশ বিপ্লব](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/lenin-1-1024x576.jpg)
পরবর্তী সময়ে সমালোচকেরা আরও বেশি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করা শুরু করেছিল। কোনো ঔপন্যাসিক ও নাট্যকারের কাজকে তারা তত বেশি প্রভাবশালী মনে না করলে নিন্দা করতে দ্বিধা করত না।
লেনিন এ রকমই একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সংরক্ষণপ্রবণ ব্যক্তি এবং তাঁর এলাকার বিদ্যালয়গুলোর প্রধান পরিদর্শক। তিনি একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। বাড়িতে রোববার বিকেল করে শেক্সপিয়ার, গ্যেটে, পুশকিনসহ অন্যদের সাহিত্য সশব্দে পড়া হতো। ইউলিয়ানভ পরিবারের (জার গোপন পুলিশের চোখে ধুলা দিতে ‘লেনিন’ নামটি ছদ্মনাম হিসেবে গ্রহণ করেছিল) জন্য উচ্চ সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা ছিল অসম্ভব।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসে লেনিন লাতিন ভাষার প্রেমে পড়ে যান। লেনিনের প্রধান শিক্ষকের অনেক উচ্চাশা ছিল যে তিনি একদিন ভাষাবিজ্ঞানী ও লাতিন ভাষার পণ্ডিত হবেন। তবে ইতিহাসের অভিলাষ ছিল ভিন্ন। কিন্তু লাতিনের প্রতি লেনিনের আসক্তি এবং ধ্রুপদির প্রতি অভিরুচি কখনোই তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ভার্জিল, ওভিড, হোরাস ও জুভেনাল তিনি উত্পত্তি ভাষায়ই পড়েছেন। রোমান সিনেটের ভাষণও তিনি পড়েছেন। দুই বছর নির্বাসনে থাকার সময়ে তিনি গ্যেটের সাহিত্য গোগ্রাসে গিলেছেন। ফস্ট তিনি বারবার পড়েছেন।
লেনিন এমন সময়ে তাঁর ধ্রুপদি জ্ঞানের সদ্ব্যবহার করেছেন যখন ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব ধাবমান। সে বছরের এপ্রিল মাসে তিনি রুশ সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক অর্থোডক্সির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং এক গাদা চরমভাবাপন্ন তত্ত্ব দিয়ে রাশিয়ায় একটি সামাজিক বিপ্লবের ডাক দেন। লেনিনের নিজের বেশ ঘনিষ্ঠ কিছু কমরেড তাঁর নিন্দা করেন। ক্ষিপ্র প্রত্যাঘাতে লেনিন গ্যেটের শ্রেষ্ঠ কাজ মিফিস্টোফিলিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘হে বন্ধু, তত্ত্ব হলো ধূসর, কিন্তু সবুজ হলো জীবনের শাশ্বত বৃক্ষ।’
ধ্রুপদি রুশ সাহিত্য যে সব সময় রাজনীতির সঙ্গে অনুপ্রবিষ্ট ছিল তা অন্যদের চেয়ে লেনিন ভালো জানতেন। এমনকি সবচেয়ে ‘অরাজনৈতিক’ লেখকদের জন্যও দেশের অবস্থার ব্যাপারে ঘৃণা লুকানো কঠিন ছিল। ইভান গঞ্চারভের উপন্যাস অব্লোমভ এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। লেনিন এই উপন্যাসকে ভালোবাসতেন। এখানে বিষয়ী ভদ্র সম্প্রদায়ের নির্জীবতা, শ্রমবিমুখতা ও শূন্যতার চিত্র রয়েছে। এই বইয়ের সাফল্যের কারণে রুশ শব্দকোষে একটি নতুন শব্দ সংযুক্ত হয়: অব্লোমভিজম। স্বৈরতন্ত্রকে যে শ্রেণি এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, তাদের নেতিবাচক অর্থে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে লেনিন বলেছেন যে এই রোগ শুধু উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জার আমলাতন্ত্রের একটি বড় অংশকে অব্লোমভিজম আক্রান্ত করেছিল এবং আরও নিচের শ্রেণিতেও ধাবিত হয়েছিল। এমনকি বলশেভিক সদস্যরাও এই রোগ থেকে মুক্ত ছিল না। এই উদাহরণ থেকে দেখা যায় গঞ্চারভ যে দর্পণ উঁচিয়ে ধরেছিলেন তাতে সমাজের বহুলাংশই প্রতিফলিত হয়েছিল। লেনিন তাঁর তর্কে প্রায়ই বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ করতেন রাশিয়ার কল্পকাহিনির সর্বদা অখুশি চরিত্র এবং মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করার মাধ্যমে।
শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পদ্ধতির ব্যাপারে লেখকদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। মতবিরোধ অবশ্য শুধু লেখকদের মধ্যেই না, অন্যদের মধ্যেও ছিল। প্রথম নিকোলাসের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বিরুদ্ধে ১৮২৫ সালে গড়ে ওঠা ডিসেম্ব্রিস্ট বিদ্রোহকে পুশকিন সমর্থন করেছিলেন। গোগোল সামন্তবাদের অত্যাচারকে বিদ্রূপ করেছিলেন, যদিও পরে দ্রুত পিছু হটেন। তুর্গেনিভ জারদের সম্পর্কে সমালোচনামুখর ছিলেন, কিন্তু সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া ধ্বংসবাদীদের প্রচণ্ড রকম অপছন্দ করতেন। সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নৈরাজ্য-সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে দস্তয়েভস্কির প্রণয় ঠিক বিপরীত রূপে পরিণত হয়েছিল। রুশ স্বৈরতন্ত্রের প্রতি তলস্তয়ের আক্রমণে লেনিন খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর অতীন্দ্রিয়বাদী খ্রিষ্টধর্ম ও শান্তিবাদে লেনিন নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। সে জন্য লেনিন প্রশ্ন করেন, কীভাবে এমন একজন প্রতিভাধর লেখক একই সঙ্গে বিপ্লবী আবার প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন? লেনিন আধা ডজন নিবন্ধের মাধ্যমে তলস্তয়ের কাজের মধ্যে বিদ্যমান গভীর স্ববিরোধিতা উন্মোচন করেছেন। লেনিন যে তলস্তয়কে চিত্রিত করেছেন, তিনি একটি স্বচ্ছ রোগ নির্ণয় করতে সক্ষম ছিলেন—তাঁর উপন্যাসে কৃষকদের অর্থনৈতিক শোষণ ও সামষ্টিক ক্ষোভ যেমন স্বীকৃত হয়েছে, তেমনি প্রকাশও পেয়েছে। কিন্তু তিনি রোগ প্রতিকারের কোনো পথ বাতলে দেননি। একটি সঠিক বিপ্লবী ভবিষ্যত্ বিবেচনা না করে তলস্তয় সান্ত্বনা খুঁজেছেন একটি সরল, খ্রিষ্টীয় অতীতের অবাস্তব ছায়ায়। ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ লিও তলস্তয়’-এ লেনিন লিখেছেন, ‘তলস্তয়ের মতামত ও মতাদর্শের মধ্যে অসংগতি কোনো দৈবিক ঘটনা নয়, সেগুলো উনিশ শতকের শেষভাগে রুশ জীবনের স্ববিরোধী অবস্থাই প্রকাশ করে।’ এভাবেই তলস্তয়ের স্ববিরোধিতা লেনিনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে কার্যকর পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।
ইতিমধ্যে দস্তয়েভস্কির কাল্ট অব সাফারিং লেনিনকে বিরস করে ফেলেছে, যদিও দস্তয়েভস্কির লেখার ক্ষমতা ছিল অনস্বীকার্য। যা হোক, সাহিত্য বিষয়ে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়নি। বিপ্লবের ঠিক এক বছরের কম সময়ের মধ্যে, ১৯১৮ সালের ২ আগস্ট, সংবাদপত্র ইজতেভেস্তিয়া বেশ কিছু ব্যক্তির নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে। যাঁদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাঁদের নামের তালিকা ছিল এটা। সেখানে তলস্তয়ের পরেই দস্তয়েভস্কির নাম ছিল। সে বছরের নভেম্বরে প্রতীকীবাদী কবি ভিচেস্লাভ ইভানভের শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে মস্কো সোভিয়েতের প্রতিনিধি সেই স্মৃতিস্তম্ভ মস্কোয় উন্মোচন করে।
![রুশ বিপ্লবের ১০০ বছর: কীভাবে দেখছে রাশিয়া](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/98640544_86cb6572-3aca-40d0-a518-5b5f09f00258.jpg)
সম্ভবত নিকোলাই চেরনিশেভস্কি লেখক হিসেবে লেনিনের ওপর সবচেয়ে গভীর প্রভাব রেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি একটি পুরো বিপ্লবী প্রজন্মের ওপরই প্রভাব রেখেছিলেন। চেরনিশেভস্কির বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক। এ ছাড়া তিনি একজন বস্তুবাদী দার্শনিক ও সমাজতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর কাল্পনিক উপন্যাস হোয়াট ইজ টু বি ডান? লিখেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের পিটার ও পল দুর্গে। এখানেই তাঁকে রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। হোয়াট ইজ টু বি ডান? একটি নতুন প্রজন্মের বাইবেলে পরিণত হয়েছিল। কারাগার থেকে গোপনে লেখা হয়েছিল বলে এই উপন্যাসের বাড়তি আকর্ষণ ছিল। মার্ক্সের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বহু আগেই চেরনিশেভস্কির এই বই লেনিনকে রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থায় উত্সাহিত করেছিল (মার্ক্সের সঙ্গে চেরনিশেভস্কি চিঠি বিনিময় করেছেন)। সাবেক চরমপন্থী জনপ্রিয় লেখকের স্মরণে লেনিন তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মের নাম দিয়েছিলেন হোয়াট ইজ টু বি ডান?। তিনি ১৯০২ সালে বইটি লেখেন। একই সালে তা প্রকাশিত হয়েছিল।
চেরনিশেভস্কির উপন্যাসের ব্যাপক সাফল্যে প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিকেরা যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বিশেষ করে তুর্গেনেভ ভয়ংকরভাবে চেরনিশেভস্কির বইকে আক্রমণ করেছিলেন। উগ্র সমালোচক দব্রলিউবভ ও পিছারেভ এই পিত্তজ্বালার জবাব দিয়েছিলেন জ্বলন্ত বিছুটির আঘাতের মাধ্যমে (দব্রলিউবভকে ছাত্ররা সম্বোধন করতেন ‘আমাদের দিদেরোত’ বলে)। তুর্গেনেভ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। একটি উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে তিনি চেরনিশেভস্কির বিরোধিতা করতে গিয়ে চিত্কার করে বলেন, ‘তুমি একটা সাপ, আর ওই দব্রলিউবভ একটি র্যাটল সাপ।’
যে উপন্যাস বিষয়ে এত বিতর্ক সেটা কী রকম? গত ৫০ বছরে আমি প্রতিটি পাতা পড়ার জন্য তিনবার চেষ্টা করেছি। তিনটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। এটা রুশ সাহিত্যের কোনো ধ্রুপদি নয়। এই উপন্যাস তার নিজের সময়ে ব্যাপ্ত ছিল এবং রুশ বুদ্ধিজীবী-মহলের সন্ত্রাস-পরবর্তী অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নিঃসন্দেহে এটা সব ক্ষেত্রেই খুব চরমভাবাপন্ন, বিশেষ করে লিঙ্গসমতা এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের জায়গায়। এ ছাড়া কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, শত্রুকে চিহ্নিত করা যায় এবং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বাঁচতে হয়, সে ব্যাপারেও এই উপন্যাস চরমভাবাপন্ন। চেরনিশেভস্কিকে প্রচণ্ড অপছন্দ করতেন ভ্লাদিমির নাবোকভ, কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেননি। নাবোকভ তাঁর শেষ রুশ উপন্যাস দ্য গিফট-এ ৫০ পাতা ব্যয় করেছিলেন চেরনিশেভস্কি এবং তাঁর পক্ষের ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গ করে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে ‘খুব নিশ্চিতভাবেই সমসাময়িক উচ্চশ্রেণির লেখকদের মধ্যে নিম্নজাতের চেরনিশেভস্কির প্রতি শ্রেণিদাম্ভিকতার আভাস ছিল’ এবং ব্যক্তিগতভাবে ‘তলস্তয় ও তুর্গেনেভ তাকে “ছারপোকার গন্ধমাখা ভদ্রলোক” বলে ডাকতেন…এবং চেরনিশেভস্কিকে তাঁরা সব ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই করেছেন। তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আংশিক ছিল ঈর্ষা থেকে, কারণ তাঁদের নাক-উঁচু স্বভাব তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। চেরনিশেভস্কি জমিদারি তালুক ধ্বংস করতে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন এবং সেসব ভূমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে চাচ্ছিলেন। তাই গভীর বদ্ধমূল রাজনৈতিক শত্রুতাও একটা কারণ, বিশেষ করে তুর্গেনেভের ক্ষেত্রে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৭ সালের এই আন্তবিপ্লবের সময়ে লেনিন যখন নির্বাসনে ছিলেন, তখন তরুণ বলশেভিকরা তাঁকে দেখতে যেত। লেনিন সেসব তরুণের ওপর ক্ষুব্ধ হতেন যখন তারা চেরনিশেভস্কির বইকে বিদ্রূপ করে বলত যে এটা পড়ার উপযুক্ত নয়। লেনিন কড়া জবাবে বলতেন যে এই বইয়ের গভীরতা ও দূরদর্শিতা বোঝার মতো বয়স এদের হয়নি। তাদের উচিত বয়স ৪০ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। তখন তারা বুঝবে যে চেরনিশেভস্কির দর্শনের ভিত্তি খুবই সাদামাটা বিষয়: আমরা আদম-হাওয়া থেকে জন্ম নিইনি। আমরা বনমানুষের বংশধর; জীবন খুবই ছোট সময়ের জৈবিক প্রক্রিয়া, তাই সব মানুষের জন্য সুখ আনয়ন করা প্রয়োজন। যে পৃথিবী লোভ, ঘৃণা, যুদ্ধ, অহমিকা ও শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেখানে তা কখনোই সম্ভব নয়। সে জন্যই একটা সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন। যে সময়ে তরুণ বলশেভিকরা লেনিনের সঙ্গে সুইস পর্বতমালায় আরোহণ করছিল তখন তাদের বয়স ৪০ ছুঁই-ছুঁই ছিল, তবে বিপ্লব তত দিনে ঘটে গেছে। এখন যেসব ইতিহাসবিদ লেনিনের চিন্তার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন তাঁদেরই বেশি চেরনিশেভস্কি পড়তে হয়। বিজ্ঞ প্রগতিশীল দল খুশিমনে মায়াকোভস্কির প্রতি ঝুঁকেছে। কিন্তু লেনিন তা করেননি।
প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ লেনিনের খুব গভীরে প্রোথিত ছিল। ফলে যেসব উত্তেজনাকর শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবের আগে এবং বিপ্লবকালে সৃষ্টি হয়েছিল তা লেনিনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। রাশিয়া বা অন্য কোথাও আধুনিকতাবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তাঁর জন্য কঠিন ছিল। শিল্পসম্মত প্রগতির পুরোধা বা আভানগার্দ, যেমন মায়াকোভস্কি ও অন্য কনস্ট্রাক্টিভিস্টদের কাজ লেনিনের কাছে রুচিসম্মত ছিল না।
![রুশ বিপ্লবের ১০০ বছর: কীভাবে দেখছে রাশিয়া](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/1-innner20171029034330.jpg)
কবি ও শিল্পীরা নিরর্থক তাঁকে বলেছিলেন যে পুশকিন ও লারমনটোভের ভক্ত হলেও তারা বিপ্লবী। তারা পুরোনো শিল্পকে মানতে নারাজ। তারা এমন ভিন্ন ও নতুন কিছু সৃষ্টি করছে যা বলশেভিজম ও বিপ্লবী যুগের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু লেনিন একদমই টলেননি। কবি-শিল্পীরা যা খুশি লিখতে-আঁকতে পারেন। কিন্তু তাকে কেন জোর করে সেসবের প্রশংসা করতে হবে? লেনিনের অনেক সহকর্মী নতুন আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। বুখারিন, লুনাচারস্কি, ক্রুপস্কায়া, কল্লোন্তাই এবং কিছুটা ট্রটস্কিও বুঝতে পেরেছিলেন যে বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ নতুন দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। আভানগার্দের মধ্যেও দ্বন্দ্ব, দ্বিধা ও স্ববিরোধিতা ছিল। সরকারের মধ্যে আভানগার্দের সমর্থক ছিলেন আনাতোলি লুনাচারস্কি। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিষয়ক গণবিভাগে। এই বিভাগে লেনিনের স্ত্রী নাদিয়া ক্রুপস্কায়াও কাজ করতেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন কাগজের ঘাটতি ঘটায় তীব্র বাদানুবাদের জন্ম হয়। তাদের কি প্রচারণামূলক লিফলেট ছাপানো উচিত নাকি মায়াকোভস্কির নতুন কবিতা? লেনিন লিফলেট ছাপার পক্ষে ছিলেন। লুনাচারস্কি মনে করতেন মায়াকোভস্কির কবিতা অনেক বেশি কার্যকর হবে। শেষতক কবিতাই ছাপা হয়েছিল।
লেনিন ‘প্রলেতেরিয়ান সাহিত্য ও শিল্প’ ধারণার প্রতিও বিরূপ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে যে দেশে সংস্কৃতির অবস্থা এত নিম্নমানের, সেখানে যান্ত্রিক ও মৃত সূত্র দিয়ে বুর্জোয়া সংস্কৃতি এবং এর প্রাচীন পূর্বসূরির শিখর অতিক্রম করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্টকাট পদ্ধতি কাজ করবে না। লেনিনের মৃত্যুর পরের খারাপ সময়গুলোতে এটা এক্সক্রিমেন্টাল ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদীরা’ তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করেছিলেন। সৃজনশীলতাকে অসার করে ফেলা হয়েছিল। প্রয়োজনের রাজ্য পেরিয়ে সবার জীবন যুক্তিবোধ দিয়ে গঠিত হবে—এমন এক মুক্তির রাজ্য সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনো তৈরি হয়নি। সে অর্থে বললে, কোথাও তৈরি হয়নি।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, প্রতিচিন্তা, বিবিসি, চার নম্বর প্লাটফর্ম,