বিংশ শতাব্দীর ঘৃণ্যতম ঘটনা ভিয়েতনাম যুদ্ধ। আগামী ৩০ এপ্রিল হবে এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪৫ বছর পুর্তি। এ পৃথিবীতে যতগুলো বর্বরোচিত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সবগুলোর পিছনে তাকালে দেখা যায়, তারমধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত এই যুদ্ধটি এশিয়ায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় সংঘাত মানা হয়।

অ্যালান ভিক্টর ওপেনহেইম যুদ্ধের চমৎকার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধ হলো দুই বা ততোধিক শক্তির মধ্যকার পারস্পরিক বিবাদ। এখানে এক পক্ষ অপরপক্ষকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পরাভূত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। ঘটনাচক্রে বিজয় পতাকা যার হাতে আসে, শান্তি এবং সহযোগিতার নামে সে তখন বিজেতার ওপর চাপিয়ে দেয় মনগড়া কতগুলো শর্ত; যা আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে উত্তর ভিয়েতনামের আচরণে দেখতে পেয়েছি। বিজয়ীর দেওয়া শর্তের মধ্যে থাকে কতগুলো বাধ্যবাধকাতা, এমনকি নিষ্ঠুরতার সুস্পষ্ট ছাপ।’

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিবৃত্ত
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, roar.media

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিবৃত্ত:
প্রাথমিকভাবে যুদ্ধটি ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম আর উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে। মাঝখান থেকে আমেরিকা যুক্ত হয়। আমেরিকার হস্তক্ষেপ করার মূল কারণ ছিল- তারা সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া সাম্যবাদী শাসন অথবা কমিউনিজমকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে দেবে না। উত্তর ভিয়েতনাম যখন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় পুঁজিবাদী দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাথে গৃহযুদ্ধে জড়ায়, দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করতে আমেরিকা যুদ্ধে অংশ নেয়।

তাদের অংশগ্রহণের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে যায়, গতিপথ পরিবর্তন করে এবং ভয়াবহ রূপ নেয়। আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে ১৯৬৫ সালে সেখানে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু এর ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, তাতে শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারে না এবং বিশ বছরের ভয়ংকর যুদ্ধে ১৯৭৫ সালে দুই ভিয়েতনাম একত্র হয়। ভিয়েতনাম দেশটি ছোট্ট হলেও দেশটিকে কয়েকটি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বারবার নিষ্পেষিত হতে হয়েছে। একের পর এক পরাশক্তিকে পরাজিত করে সর্বশেষ ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দুই যুগ ধরে বয়ে গেছে রক্তের স্রোতধারা। একাধারে ২১টি বছর ধরে পৃথিবী সাক্ষী হয়ে ছিল এই অবিরত প্রাণক্ষয়ের।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিবৃত্ত:
ছবি : quoracdn.net

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল যে, যদি উভয় ভিয়েতনাম মিলিত হয়ে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হবে। কেননা, ভিয়েতনাম ছিলো চীনের প্রতিবেশী এবং চীনের প্রভাব ছিলো খুব বেশী। ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে বা স্পিল অভার হবে। এবং এই সূত্রে ওই অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবে এবং একই সাথে সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। যদি এই অঞ্চলে বৃহৎ সমাজতাত্ত্বিক ব্লক গড়ে উঠে, তবে তা যুক্তরাষ্ট্র নিজের হুমকি মনে করবে।

এই ভাবনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারকে সহায়তা দেয়। যদিও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষদের একটি বিশাল অংশ সমাজতান্ত্রিক (সমাজতাত্ত্বিক সমাজ হলো যেখানে অর্থনৈতিক কার্যাবলী থাকে সরকারের হাতে) শাসন ব্যবস্থার প্রতি অনুরক্ত ছিল। দক্ষিণ সরকার সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষের উপর নিপীড়নমূলক আচরণ শুরু করে। এরই প্রতিবাদে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আন্দোলন শুরু হয়, এবং শুরু হয় যুদ্ধ!

ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ
ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ছবি : kolkata24x7

ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে টানা ২১টি বছর ধরে পৃথিবী সাক্ষী হয়েছিল এক অবিরত প্রাণক্ষয়ের। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগর তীরের এক বিস্তীর্ণ জনপদে বয়ে গিয়েছিল অবিরাম এ রক্তের স্রোতধারা। সেই রক্তপাতের দুটো পক্ষ ছিল; এক পক্ষ মুক্তি চায়, অন্য পক্ষ চায় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে গলা টিপে ধরতে। ইতিহাস সাক্ষী, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সে যুদ্ধে জয় হয়েছিল মুক্তিকামী মানুষেরই। অনাগত কাল ধরে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নে প্রেরণা যোগানোর ইতিহাস তৈরি করা সেই জনপদের নাম ভিয়েতনাম।

ভিয়েতনামের যুদ্ধের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। একের পর এক অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে এ অঞ্চলের মানুষ। ‘দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত সর্বশেষ যুদ্ধ, যেটি ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ বলেই সর্বাধিক পরিচিত, এ লেখাটি মূলত সেটি নিয়েই। তবে এ যুদ্ধের পটভূমি বোঝার জন্য এর আগের প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচীন অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তের দেশ ভিয়েতনাম উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ভিয়েতনাম আক্রমণ করে এর কর্তৃত্ব নিলেও ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসন তখনও সমাপ্ত হয়নি। তখন জাপান আর ফ্রান্স ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এ অঞ্চলে শাসন চালিয়ে যেতে থাকে। চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবাদপ্রতীম নেতৃত্ব হো চি মিন ১৯৪১ সালের মে মাসে গঠন করেন ‘ভিয়েত মিন’, যার অর্থ হলো ‘ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংঘ’। জাপান ও ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্যই এই সংগঠন গড়ে তোলেন আংকেল হো।

ভিয়েতনামের স্বাধীনতা সংঘ
ছবি : ghotona.com

১৯৪৩ সালের শেষ দিকে জাপানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে ভিয়েত মিন, এর নেতৃত্বে ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসের এক দুর্ধর্ষ সমরনায়ক জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপ। ১৯৪৫ সালের মার্চে জাপান ভিয়েতনামী বাও দাইকে রাজা বানিয়ে ভিয়েতনামকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করে। জাপান ও ফ্রান্সের ক্রমাগত শোষণের ফলস্বরূপ ১৯৪৪-৪৫ সালে ভিয়েতনামে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, যাতে প্রায় ৪ থেকে ২০ লক্ষ মানুষ কেবল অনাহারেই মৃত্যুবরণ করে। এ দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে, বাড়তে থাকে ভিয়েত মিনের সদস্য সংখ্যা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, জাপান ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। জাপানের আত্মসমর্পণ যখন আসন্ন, সে সময় আগস্টের ১৪ তারিখে ভিয়েত মিন গোটা ভিয়েতনাম জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নেয়া শুরু করে। ইতিহাসে ‘আগস্ট বিপ্লব’ নামে পরিচিত এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বরে হো চি মিন হ্যানয় শহরে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভিয়েতনামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম’ (ডিআরভি)। বাও দাই ক্ষমতাচ্যুত হয়, ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয় হো চি মিনকে।

অন্তত ২০ দিন এই নতুন সরকার ছিল গোটা ভিয়েতনামে দায়িত্বরত একমাত্র সরকার। সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে ভিয়েতনামের দক্ষিণের শহর সায়গন থেকে এই নতুন সরকারকে উৎখাত করে ফরাসি বাহিনী। ভিয়েতনামের উত্তর ও কেন্দ্র তখনও ভিয়েত মিনের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। গোটা ভিয়েতনামের উপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া ফ্রান্স উৎখাত হওয়া রাজা বাও দাইয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ফ্রান্সের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ফ্রান্স বাও দাইকে প্রধান করে ১৯৪৯ সালের জুনে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে কেন্দ্র করে নতুন সরকার ঘোষণা করে। সায়গনকে এর নতুন রাজধানী ঘোষণা দেয়া হয়। এদিকে ভিয়েত মিন বাহিনী পুরনো ঔপনিবেশিক প্রভুদের এ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে।

এদিকে ভিয়েত মিন বাহিনী পুরনো ঔপনিবেশিক প্রভুদের এ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে
ছবি : banglainfotube.com

চীনে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনা বিপ্লবের সাফল্য তখন দ্বারপ্রান্তে। ১৯৪৯ এর শেষ দিকে যুদ্ধে চীনের সহায়তা লাভ করে ভিয়েত মিন বাহিনী। সোভিয়েত ইউনিয়নও দাঁড়ায় তাদের পাশে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে থাকে বাও দাইয়ের অধীনের সেনাবাহিনীকে। ১৯৫০ সালে চীন, সোভিয়েত ইউনয়ন সহ অন্যান্য কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন দেশগুলো উত্তর ভিয়েতনাম কেন্দ্রিক ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম (ডিআরভি)’কে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ কমিউনিস্ট বিরোধী দেশগুলো স্বীকৃতি দেয় বাও দাইয়ের সরকারের অধীনে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে। দীর্ঘ যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯৫৪ সালের মে মাসে দিয়েন বিয়েন ফু-তে ভিয়েত মিন বাহিনী আর ফ্রান্সের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর লড়াই সংঘটিত হয়। জেনারেল ভো নগুয়েন গিয়াপের নেতৃত্বে চূড়ান্ত আঘাত করে ভিয়েত মিন বাহিনী। তাতে পরাজিত হয় ফরাসিরা, জয় হয় স্বাধীন ভিয়েতনামের স্বপ্নবাজ যোদ্ধাদের। শেষ হয় প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের ধারণা ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমগ্র এশিয়াতে সাম্যবাদের জোয়ার বইবে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের মত কমিউনিস্ট বিদ্বেষী রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই আইজেনহাওয়ার দক্ষিণ ভিয়েতনামে নতুন সরকার গঠন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি জেনেভা চুক্তি অমান্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৫ সালে চরম কমিউনিজম বিরোধী নেতা দিন দিয়েম নোকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের গদিতে বসিয়ে দেয়। সেই সরকারকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। অন্যদিকে মার্কিনদের শত্রু রাশিয়া ও চীন হো চি মিন সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিতে থাকে। আর বিশ্ব অপেক্ষা করতে থাকে এক রক্তক্ষয়ী কালো অধ্যায়ের।

কিন্তু ভিয়েতনামবাসীর যুদ্ধ-জীবনের সে এক বিরতি মাত্র। তাদের অদৃষ্টে আরেকটি দীর্ঘ সমরের ক্ষেত্রই প্রস্তুত হচ্ছিল কেবল। প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফরাসিরা বিদায় নেবার পরও ঐক্যের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো না, পূরণ হলো না একক ভিয়েতনাম তৈরির লক্ষ্য। বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ফরাসি সরকারের সাথে ভিয়েত মিন এমন এক চুক্তি করতে বাধ্য হলো, যাতে ফ্রান্সের শাসন অবসান হলো ঠিকই, কিন্তু গোটা দেশকে এক করে সাম্যবাদের ধ্বজা ওড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হলো না।

কিন্তু গোটা দেশকে এক করে সাম্যবাদের ধ্বজা ওড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হলো না
ছবি : bbc.com

১৯৫৪ সালের ২১ জুলাই জেনেভায় সম্পন্ন হওয়া এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ফরাসিরা তাদের দীর্ঘ শাসন-শোষণের পাততাড়ি গুটিয়ে নিল ভিয়েতনাম থেকে, আর ভিয়েতনাম আনুষ্ঠানিকভাবে দু’ভাগে ভাগ হলো। এ বিভাজনকে বলা হলো সাময়িক; উত্তর ভিয়েতনামের নেতৃত্বে থাকলেন হো চি মিন, দক্ষিণ ভিয়েতনামে বাও দাই। ঠিক হলো, ১৯৫৬ সালে দুই অংশ মিলিয়ে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুই ভিয়েতনাম আবার এক হবে। ‘সেভেনটিন্থ প্যারালাল’ বলে যে সীমানা রেখা দিয়ে উত্তর আর দক্ষিণ ভিয়েতনামকে ভাগ করা হয়েছিল, গোটা ভিয়েত জাতির নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সেটা বিলুপ্ত করা হবে- এমনটাই আশা করল ভিয়েত মিন। আর তখন পুরো জাতির সামনে ভিয়েত মিনের যে তুমুল জনপ্রিয়তা, তাতে নিশ্চিতভাবেই এই নির্বাচনে জয়ী হতে চলেছিল তারা। কিন্তু ভিয়েতনামের মানুষের সেই বলিষ্ঠ ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে দাঁড়াল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর সহায়ক ভূমিকা নিল ভিয়েতনামেরই একজন। তার নাম দিন দিয়েম নো।

দক্ষিণ ভিয়েতনামে শুরু হলো দিন দিয়েন নোর অমানুষিক নির্যাতন। যারাই তার বিরোধিতা করে তাদেরকেই কমিউনিস্ট বলে ধরে নিয়ে অত্যাচার করত। এভাবে দিয়েম নোর অত্যাচারে প্রায় ১ লক্ষ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারালো। তখন বাধ্য হয়েই ১৯৫৭ সালে ভিয়েতনামের জনগণ দিয়েমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে ভিয়েতনামের সকল জনগণ মার্কিন মদদপুষ্ট দিয়েম নোর হঠকারিতা বুঝতে পারল।

দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিন দিয়েম নো শুরু করল এক নির্মম অত্যাচার। উত্তর ভিয়েতনাম থেকে তার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা হচ্ছে এমন প্রোপাগান্ডা ছড়াতে লাগল সে। যারাই উত্তরের ভিয়েত মিন বাহিনীকে সমর্থন করত কিংবা মিলিত সার্বভৌম ভিয়েতনামের দাবিকে সমর্থন করত বলে মনে হতো, তাদেরকে দিন দিয়েম সরকার কমিউনিস্ট বলে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাতে লাগল। সিআইএর সহযোগিতা নিয়ে খুঁজে খুঁজে দিন দিয়েম নো প্রায় ১ লক্ষ ঐক্যপন্থী ভিয়েতনামীকে গ্রেফতার করল, তাদের অনেকেই নির্মম অত্যাচারের শিকার হলো, অনেকেই বরণ করল মৃত্যু।

তাদের অনেকেই নির্মম অত্যাচারের শিকার হলো, অনেকেই বরণ করল মৃত্যু
ছবি : jagonews24.com

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬০ সালে দুই ভিয়েতনাম একসাথে মিলিত হয়ে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট (এনএলএফ) গঠন করে। এটা দেখে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কায় পড়ে যায়। ভাবে, এখন আর ভিয়েতনামিদের কাজে লাগানো যাবে না। তাদেরকেই মাঠে নামতে হবে।

১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতা সরবরাহ করবে। যেকোন মূল্যেই হোক কমিউনিজম ধ্বংস করতে হবে। ভিয়েতনামে ভিড়তে লাগলো একের পর এক সুসজ্জিত যুদ্ধ জাহাজ। নেমে আসল ভিয়েতনামের জন্য আশনি সংকেত।

সেই সময়টায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ু যুদ্ধ তুঙ্গে। তাই রাশিয়া এনএলএফকে সব ধরণের সহায়তা দিতে থাকে। সেই সাথে চীনও। ১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিন দিয়েম নো সরকারের পতন ঘটে। ১৯৬৪ সালে টংকিং উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপর উত্তর ভিয়েতনাম বোমাবর্ষণ করে। সাথে সাথে ওয়াশিংটনও উত্তর ভিয়েতনামকে যে কোন উপায়ে ধ্বংসের নির্দেশ দেয়। হিংস্র জিঘাংসা আরও ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। মারা পড়তে থাকে হাজারো সৈন্য, সাধারণ জনগণ।

আরও ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। মারা পড়তে থাকে হাজারো সৈন্য, সাধারণ জনগণ
ছবি : jugantor.com

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য ভিয়েতনামে প্রেরণ করে। যুদ্ধ প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে চলে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র আরও সৈন্য পাঠিয়ে প্রায় ৫ লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাহিনী গঠন করে। কিন্তু তারপরও ভিয়েতনামের গ্রামীন পাহাড়ি অঞ্চলে অতটা কাঁবু করতে পারে নি। অন্যদিকে উত্তর ভিয়েতনাম দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে দিনে দুপুরে হামলা চালাত।

এক অন্যায় যুদ্ধে প্রবল সমর্থন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিও মিলিত হলো দক্ষিণ ভিয়েতনামের ঐক্যবিরোধীদের সাথে। আর সেই মিলনের শক্তি এতটাই বেশি ছিল যে, কেবল মার্কিন সমর্থনের কারণেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী টিকে থাকতে পারছিল এনএলএফ এর সামনে। এ কারণেই এ দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধকে ভিয়েতনামী ভাষায় বলা হয় ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ’।

যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিশ্ব অসন্তোষ
যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিশ্ব অসন্তোষ, ছবি : eferrit.com

যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিশ্ব অসন্তোষ :

১৯৬৮ সালে নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুদ্ধের নৃশংসতা আরও বেড়ে গেল। মার্কিনরা চিন্তা করল সবুজ ভিয়েতনামকে যদি মরুভূমি বানিয়ে ফেলা যায় তাহলে শত্রুর মোকাবেলা করাটা সহজ হবে। তাই তারা নিক্ষেপ করতে লাগল একের পর এক বিভিন্ন হারবিসাইড বোমা, রাসায়নিক বিস্ফোরক যা দ্বারা সমস্ত গাছকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। মার্কিন সেনারা ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় আট কোটি লিটারেরও বেশি বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য বর্ষণ করে যার ফলে ভিয়েতনামের পরিবেশ চরম ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ বোমা সাড়া পৃথিবী জুড়ে ব্যবহৃত হয়েছিলো তার চারগুণের বেশি বোমা ছোট ভিয়েতনামের বুকে বর্ষিত হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্র ডাই অক্সিন এজেন্ট নামের জৈব রাসায়নিক মরণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলো যার ফলে আজও ভিয়েতনামে মানসিক ভারসাম্যহীন, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে নাপাম বোমা ব্যবহার করে এক নৃশংস গণহত্যা চালায়। ধারনা করা হয়, এই সময় প্রায় পাঁচ শত লোক নিহত হয়।

ভিয়েতনামও থেমে থাকেনি। তারাও একের পর এক মার্কিন সেনাদের ঘায়েল করছিলো। সংবাদকর্মীদের সাহায্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল এ যুদ্ধের খবর আর বাড়ছিলো বিশ্ব অসন্তোষ। খোদ আমেরিকাতেই এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তুমুল জনমত গড়ে উঠতে থাকলো। তারা তাদের সৈন্যদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাইলো। বিশ্ব অসন্তোষের চাপে যুক্তরাষ্ট্র উভয় সঙ্কটে পড়ে যায়। উপায় না দেখে তারা আলোচনায় বসতে চাইলো।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি :
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, ছবি : ndupress.ndu.edu

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি :

এ যুদ্ধে প্রায় ৩২ লক্ষ ভিয়েতনামি ও প্রায় ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা প্রাণ হারায়। এতে প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশি মার্কিন সেনা আহত হয়েছিল। প্রায় পাঁচ হাজার হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়েছিল। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভিয়েতনামের ৪৫ শতাংশ কৃষি জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এখনও ভিয়েতনামের মাটিতে যে পরিমাণ বোমা আছে তা নষ্ট হতে আরও ৫০০ বছর লেগে যাবে।

এত বছর পরেও ভিয়েতনামের ঘরে ঘরে জন্মাতে দেখা যায় বিকলাঙ্গ শিশু। কেউ কেউ আবার মানসিক বিকারগ্রস্ত। এখনও কিছু কিছু জমি চাষের অনুপযোগী। কিছু জীনগত রোগ এখনও ভিয়েতনামিরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াচ্ছে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪৪ বছর পরে আজও ভিয়েতনামিরা ভুলতে পারে নি যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতাকে। কালের গহ্বরে হয়ত কোনদিন ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা তলিয়ে যাবে। কিন্তু ইতিহাস ঠিক মনে রাখবে এর কথা। ভিয়েতনামের শান্তিকামী মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠবে যুদ্ধের বীভৎসতার কথা মনে করে।

তথ্যসূত্র : উইকিপেডিয়া, বিবিসি, পিপল’স মুসিয়াম অফ ভিয়েতনাম

Related posts

নালন্দা ধ্বংসে খতিয়ার খলজি, সত্য মিথ্যা

News Desk

নিমতলী ট্রাজেডি: যে রাতে আগুনরূপী মৃত্যু নেমেছিল

News Desk

লালবাগ কেল্লা: তিন শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক স্থাপত্য

News Desk

Leave a Comment