ইংরেজ সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করে। সেই মুহূর্তে সেখানেই উপস্থিত ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ’রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর সদস্যা নীরা আর্য। জয়রঞ্জনকে তিনি দ্বিতীয় সুযোগ দেননি। চোখের পলকে শ্রীকান্তর পেটে বেয়নেট চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। শুধু এটুকুই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখানে একটা অভাবনীয় চমক আছে। যাঁকে তিনি সেদিন হত্যা করেছিলেন, সেই শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন ছিলেন নীরা আর্যের স্বামী। হ্যাঁ। নেতাজি এবং স্বদেশের প্রতি এতটাই নিষ্ঠ ছিলেন তিনি যে ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বনকারী নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। অভিভূত নেতাজি নীরাকে অভিহিত করেছিলেন ‘নাগিনী’ নামে। আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানী নীরা আজও অমর হয়ে আছেন তাঁর এই অসামান্য কীর্তির জন্য।
নীরা আর্য ১৯০২ সালের ৫ মার্চ ভারতের তৎকালীন ইউনাইটেড প্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার খেকড়া শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা শেঠ ছজুমল ছিলেন সে সময়ের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তাঁর ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। তাই নীরার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল কলকাতায়। নীরা হিন্দি, ইংরেজি, বাংলার পাশাপাশি আরও অনেক ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, সাহসী ও প্রবল আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন একজন মহিলা। অথচ তাঁর বিয়ে হয় সিআইডি ইন্সপেক্টর শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে।
স্বামীর সঙ্গে মতাদর্শগত কোনও মিল ছিল না নীরার। শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস ছিলেন ইংরেজ-ভক্ত অফিসার। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর পিছনে নজরদারির দায়িত্ব দিয়েছিল। সুযোগ পেলে নেতাজিকে হত্যা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু শ্রীকান্তর চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন তাঁর স্ত্রী।
নেতাজি নীরাকে ফৌজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তার ভাই বসন্ত কুমারও আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন। গুপ্তচর হিসেবে ব্রিটিশ বাহিনির প্রচুর গোপন খবর নীরা সংগ্রহ করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা তাঁকে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর হিসেবে গণ্য করেন। ফৌজে নিজের কাজ বিষয়ে নীরা আত্মজীবনীতে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন – “আমাদের কাজ ছিল কান খোলা রাখা,সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা, তারপরে নেতাজির কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। কখনও কখনও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিও বহন করতে হত। যখন মেয়েদের গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল, আমাদের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, ধরা পড়লে নিজেরাই নিজেদের গুলি করতে হবে। একটি মেয়ে তা করতে পারেনি এবং ইংরেজরা তাকে জীবন্ত গ্রেপ্তার করেছিল। এতে আমাদের সংগঠনের সমূহ ক্ষতি হবে বুঝে আমি এবং রাজামণি স্থির করেছিলাম যে, আমরা আমাদের সঙ্গীকে যে কোনও ভাবে মুক্ত করব। আমরা নপুংসক নর্তকীর পোশাক পরে যেখানে আমাদের সঙ্গী দুর্গাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে পৌঁছেছিলাম। আমরা অফিসারদের মাদক খাওয়ালাম এবং আমাদের সঙ্গীকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলাম। কিন্তু পালাবার পথে পাহারাযরত এক সেনা আমাদের দিকে গুলি চালায়। তাতে রাজামণির ডান পা গুলি বিদ্ধ হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কোনওক্রমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এদিকে ধড়পাকড় শুরু হলে আমি এবং দুর্গা একটা লম্বা গাছের উপরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল, যে কারণে আমাদের ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তিন দিন ধরে গাছের উপরেই থাকতে হয়েছিল। তিন দিন পরে আমরা সাহস করে সুকৌশলে সঙ্গীদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ঘাঁটিতে ফিরে আসি। রাজামণির সাহসিকতায় নেতাজি খুশী হয়ে তাকে আইএনএর রানি ঝাঁসি ব্রিগেডে লেফটেন্যান্ট এবং আমাকে অধিনায়ক করেছিলেন।”
আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণের পরে, সমস্ত বন্দী সৈন্যকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে স্বামী হত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জেলে বন্দীদশায় তাঁকে অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে মুক্তি পেয়ে তিনি বাকি জীবনটা ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। কোনও সরকারি সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি। হায়দরাবাদের ফলকনমার একটি কুঁড়েঘরে বাস করতেন। বার্ধক্যজর্জর অবস্থায় চারমিনারের কাছে ওসমানিয়া হাসপাতালে ১৯৯৮ সালের ২৬ শে জুলাই, রবিবার তিনি অসহায়, নিঃস্ব অবস্থায় প্রয়াত হন। যতটা প্রচার বা সম্মান প্রাপ্য, ততটা পাননি ভারতের এই বীরাঙ্গনা। তবে লোককবিদের মুখে মুখে ‘নীরা নাগিনী’-কে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গান। পরে তাঁর নামে একটি জাতীয় পুরস্কার চালু করা হয়েছে। তাঁর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে।
সূত্র: বাংলা আমার প্রাণ