১৩ আগষ্ট, ১৯৬১ সালের কথা। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ঘুমন্ত জার্মানবাসীদের জাগিয়ে তুলছে। দূরে কোথাও মোরগ চেঁচিয়ে সুপ্রভাত জানাচ্ছে। রোদের আলো জানালার পর্দা ভেদ করে তিনতলার শোয়ার্জনেগার পরিবারের লোকজনদের সকাল হবার খবর দিচ্ছে। কর্তাব্যক্তিই সেই শুভেচ্ছা গ্রহণ করে উঠে জানালার পর্দা সরালো। লোকটার মনে হলো, সে যেন স্বপ্নের ঘোরে আছে এখনো। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলে ফের তাকালো। নাহ কোনোভাবেই নিজের চোখজোড়াকে বিশ্বাস হচ্ছে না। জানালার কাছে দাঁড়িয়েই জোর গলায় নিজের স্ত্রীকে ডাকলো। কর্তাব্যক্তির এহেন ডাকাডাকিতে পরিবারের সবার ঘুম ভাঙলো।
শুধু শোয়ার্জনেগার পরিবার নয়; বরং গোটা বিশ্ব যেন সেই পর্দার কাছে এসে দাঁড়ালো। আর দেখতে পেল, জার্মান দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মাঝে রাতের অন্ধকারেই গড়ে উঠেছে কাঁটাতারের এক দেয়াল। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্তের মধ্যকার এই দাম্ভিকতায় কতশত পরিবার হয়ে গেল বিচ্ছিন্ন। ভাই হারালো বোন, পিতা হারালো সন্তান, স্ত্রী হারালো তাঁর স্বামী; এমনকি নবজাতক শিশু হারালো তাঁর মা। ইতিহাসে এই দম্ভের দেয়াল বার্লিন প্রাচীর নামেই প্রসিদ্ধ। আজকের আয়োজনটা এই দেয়ালের উত্থান থেকে শুরু করে পতনের গল্প নিয়েই সাজানো।
![বার্লিন দেয়ালঃ জার্মানির উত্থান পতনের প্রতীক](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/Haneke-East-Germany-Gay-300x203.jpg)
পরিচিতি
বার্লিন প্রাচীর (জার্মান: Berliner Mauer,ছিলো একটি সুরক্ষিত কংক্রিটের অন্তরায়, যা ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আক্ষরিক ও মতাদর্শগতভাবে বার্লিন শহরকে বিভক্ত করেছিল। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (জিডিআর, পূর্ব জার্মানি) কর্তৃক এই প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়।
১৩ আগস্ট ১৯৬১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে[২] পূর্ব জার্মান কর্মকর্তাদের নির্দেশে এটি ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত, প্রাচীরটি (ভৌগলিকভাবে) সুদীর্ঘ ২৮ বছর ধরে পার্শ্ববর্তী পূর্ব জার্মানি থেকে পূর্ব বার্লিন সহ, পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে সীমানা প্রাচীর হিসেবে অবস্থান করছিল। প্রাচীরটির পতন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৩ জুন ১৯৯০ থেকে শুরু করে ১৯৯২ সালের মধ্যে সমাপ্ত হয়েছিল।[১][৩] সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ সময়কালে প্রাচীর টপকে পশ্চিম বার্লিন যাবার চেষ্টাকালে ১২৫ জন প্রাণ হারান। বেসরকারী হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় ২০০। সদ্য প্রকাশিত দলিলে দেখা যায় কমিউনিস্ট সরকার পক্ষত্যাগকারীদের গুলি করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল। যদিও পূর্ব জার্মান সরকার সবসময় এটা অস্বীকার করে আসছিল।
কয়েক সপ্তাহের জনঅসন্তোষের পর ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ পূর্ব জার্মান সরকার পশ্চিম বার্লিনে যাবার অনুমতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। হাজার হাজার উৎসুক জনতা প্রাচীর টপকে পশ্চিম পাশে যেতে থাকে। পশ্চিম প্রান্তে উৎসবমুখর পরিবেশে তাদের স্বাগত জানানো হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে স্যুভেনির সংগ্রাহকরা প্রাচীরটির কিছু অংশ ভেঙে ফেলে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো প্রাচীর সরিয়ে নেয়া হয়। বার্লিন প্রাচীর খুলে দেয়ার ঘটনা দুই জার্মানির পুনঃএকত্রীকরণের পথ প্রশস্ত করে দেয়, যার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ে ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর।
![বার্লিনের বিভাজন](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/https___cdn.cnn_.com_cnnnext_dam_assets_191031134034-3-berlin-wall-30th-anniversary-1536x1115-1-300x218.jpg)
বার্লিনের বিভাজন
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হওয়া মাত্রই জার্মানির অঞ্চলগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ নিয়ে ইয়াল্টা এবং পটসডামে মিত্র শান্তি সম্মেলন আয়োজিত হয়। সেই আলোচনায় মিত্রবাহিনী পক্ষ থেকে পরাজিত দেশকে মিত্র দখল অঞ্চল নামে চারটি আলাদা ভাগে বিভক্ত করা হয়। দেশটির পূর্বাঞ্চল চলে যায় বৃহত্তর রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে; পশ্চিম অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন এবং (এমনকি) ফ্রান্সের কাছে ছিল।
যদিও মূল কেন্দ্র বা রাজধানী বার্লিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশেই পড়েছিল (এটি পূর্ব ও পশ্চিম দখল অঞ্চলগুলির সীমানা থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল); তবুও ইয়াল্টা এবং পটসডাম চুক্তি অনুসারে শহরটাকেও একইভাবে ভাগ করা হয়েছিল। তাই সোভিয়েতরা নিজেদের আওতায় পূর্বের অর্ধেক নিয়েছিল; আর পশ্চিমের বাকি অর্ধেক অন্যান্য মিত্র শক্তির দখলে। ১৯৪৫ সালের জুন মাস থেকেই বার্লিনের এই চার-পথ দখল ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।
১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (জিডিআর, বা পূর্ব জার্মানি) কমিউনিস্ট সরকার কাঁটাতার এবং কংক্রিটের সমন্বয়ে এক দেয়াল নির্মাণ করে। প্রাথমিক অবস্থায় তারা এই দেয়ালকে অ্যান্টিফ্যাস্টিস্টটুসার শ্যুটজওয়াল নামে অভিহিত করে। জার্মান এই শব্দের একটা ইংরেজি সংস্করণও তখন প্রচলিত ছিল, অ্যান্টিফ্যস্টিস্ট বাল্কওয়ার্ক নামে। বাংলাতে এর অর্থ দাঁড়ায় – ফ্যাসিবাদী থেকে আত্মরক্ষার উপায়/বাঁধ। এই দেয়াল বা প্রাচীর বার্লিনকে পূর্ব এবং পশ্চিম বার্লিন নামে বিভক্ত করেছিল।
এই বার্লিন প্রাচীরের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমা “ফ্যাস্টিস্ট” দের পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পতন হতে রক্ষা করার জন্য। তবে এটি মূলত পূর্ব থেকে পশ্চিমে স্বদলদ্রোহিতার উদ্দেশ্য পালনে কার্যকরী হয়ে উঠেছিল। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর, বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটে। কিন্তু আজো বার্লিন প্রাচীর কোল্ড ওয়্যার বা স্নায়ু যুদ্ধ এর এক স্থায়ী আর শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
![অবরোধ এবং সংকট](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/https___cdn.cnn_.com_cnnnext_dam_assets_191031134033-2-berlin-wall-30th-anniversary-1536x1236-1-300x241.jpg)
অবরোধ এবং সংকট
পুঁজিবাদী পশ্চিম জার্মানির অস্তিত্ব প্রকটরূপে উল্লেখযোগ্য আর আর মাথাব্যথার কারণ ছিল সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির নেতাদের কাছে। এমনকি সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন যে, “যেন সোভিয়েতের গলায় কোনো কাঁটা আটকে আছে।” সেজন্যই রাশিয়ানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং ফ্রান্সকে শহর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করে। এরই সুবাদে ১৯৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পশ্চিম বার্লিন অবরোধ করে রাখে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম মিত্ররা যেন অনাহার-অর্ধাহারে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
পিটু হটার পরিবর্তে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র বাহিনী শহরের সেক্টরগুলোতে কার্গো বিমানের সাহায্যে খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা শুরু করে। এই অবরোধ ইতিহাসে বার্লিন এয়ারলিফট নামে পরিচিত। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী ছিল এই অবরোধ। অবরোধ চলাকালীন সময়ে ২.৩ মিলিয়ন টন খাবার, জ্বালানী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পন্য/বস্তু পশ্চিম জার্মানিতে সরবরাহ করা হয়েছিল। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অবরোধ তুলে নেয়।
প্রায় এক দশক আপেক্ষিকভাবে সবকিছু শান্ত থাকার পর, ১৯৫৮ সাল হতে চাপা উত্তেজনাটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। পরবর্তী তিন বছরের জন্য সবকিছু বদলে যায়। শুরুতে স্পেস রেস বা মহাকাশ যাত্রা তে সোভিয়েতদের উপগ্রহ স্পুটনিক-১ সফল হলে তারা বিশ্ব দরবারে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। এবং একইসঙ্গে মিত্র বাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দেবায় ব্যাপক উৎসাহিত হয়।
![মিত্র বাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দেবায় ব্যাপক উৎসাহিত](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/article-plane2-300x199.jpg)
কিন্তু বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সোভিয়েতরা আবার একইসঙ্গে ভীষণভাবে লজ্জিত আর বিব্রত হয়। কেননা, পূর্ব থেকে পশ্চিম অভিমুখে শরনার্থীদের ঢল অবিরাম ধারায় প্রবাহিত হতেই থাকলো। অবরোধ শেষ হবার পর থেকে প্রায় ৩ মিলিয়ন পূর্বের শরনার্থী পশ্চিমে পাড়ি জমিয়েছিল; যাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল তরুণ, দক্ষ কর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী।
এমনকি এইসব শরনার্থীদের তর্জন-গর্জন কিংবা নানা রকমের হুমকি দিয়ে আটকাতে সম্ভব হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন। উপরন্তু, শরনার্থীদের পক্ষ নিয়ে সোভিয়েতদের প্রতিরোধ করেছিল মিত্র বাহিনী। শীর্ষ বৈঠক, সম্মেলন, গোলটেবিল বৈঠকসহ সবকিছুই চলছিল সমাধান ছাড়া। আর অপরদিকে শরনার্থীদের ঢল অব্যাহতই রইলো। ১৯৬১ সালের জুন মাসে, প্রায় ১৯ হাজার মানুষ জিডিআর বা পূর্ব জার্মানি ছেড়ে পশ্চিম জার্মানি চলে যায়।
পরের মাসে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পালিয়ে চলে যায় পশ্চিমের বার্লিনে। আগস্ট মাসের প্রথম ১১ দিনে প্রায় ১৬ হাজার পূর্ব জার্মানবাসী সীমান্ত পেড়িয়ে পশ্চিমের বার্লিনে প্রবেশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ আগস্ট প্রায় আড়াই হাজার মানুষ তাদেরকে অনুসরন করে ছেড়ে যায় পূর্ব জার্মানি। এটাই ছিল পূর্ব জার্মানি ছেড়ে যাওয়া শরনার্থীদের সবচাইতে বড় ঢল একদিনের হিসেবে।
![দেয়াল নির্মাণ](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/17465533_303-300x169.jpg)
দেয়াল নির্মাণ
১২ আগস্ট রাতেই সোভিয়েত প্রধান ক্রুশ্চেভ পূর্ব জার্মান সরকারকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে দেশান্তরিদের প্রবাহ রুখে দেয়ার অনুমতি দেয়। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানেই পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক নির্মাণকর্মীদের যৌথ কর্মোদ্যোগে অস্থায়ীভাবে কাঁটাতারের বেড়া এবং ঘন কংক্রিটের দেয়াল গড়ে ফেলা হয়। গড়ে উঠে বার্লিন প্রাচীর – যা একটি শহরকে দুইভাভে বিভক্ত করে দেয়।
এই প্রাচীর নির্মাণের আগে বার্লিনাররা (বার্লিনের বাসিন্দাদের উপাধি – বার্লিনার) শহরের দুই দিকেই নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারত: কাজেকর্মে, কেনাকাটা, থিয়েটার বা সিনেমা হলে মুভি দেখার জন্যেও তারা পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনের সীমান্ত অতিক্রম করতে পারতো। এমনকি ট্রেন এবং পাতালরেলও যাত্রীসহ মালামালও বহন করতে পারতো।
কিন্তু দেয়াল নির্মাণের পর, পূর্ব থেকে পশ্চিম জার্মানি যাওয়া বলতে গেলে প্রায় অসম্ভবই হয়ে পড়েছিল। কেননা, শুরুতে তিনটা চেকপোস্টে যথাযথ কারণ দর্শানো পূর্বক একজন বার্লিনার অন্যদিকে যাতায়াতের অনুমতি পেত। হেল্মস্টেটে ছিল চেকপয়েন্ট আলফা, ড্রাইলেন্ডেনে ছিল চেকপয়েন্ট ব্র্যাভো এবং বার্লিনের মধ্যভাগ ফ্রিডিকস্টাসে ছিল চার্লি চেকপয়েন্ট। এমনকি, জিডিআর বা পূর্ব জার্মানির দেয়ালঘেষে সর্বমোট ১২টি চেকপোস্ট নির্মান করা হয়েছিল।
প্রতিটি চেকপয়েন্টে পূর্ব জার্মান সৈন্যরা, কূটনৈতিক এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের প্রবেশ এবং ছাড়ার অনুমতি দেয়ার পূর্বে ব্যাপকভাবে তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ এবং এমনকি টেস্টও করতো। বিশেষ পরিস্থিতি ব্যতিরেকে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানদের সীমানা পেরিয়ে আসার অনুমতি খুব কমই দেয়া হতো।
![বার্লিন প্রাচীর (১৯৬১-১৯৮৯)](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/HVpSkunwu0TvlxJ6_Belin-Wall-1684x842-1-300x150.jpg)
বার্লিন প্রাচীর (১৯৬১-১৯৮৯)
বার্লিন প্রাচীর নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশান্তরিদের অব্যাহত ধারা বন্ধ হয়ে যায়। এবং বার্লিনে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তাও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি এক সংবাদ সম্মেলনে বলে যে,
একটি প্রাচীর অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চাইতেও বেশী ধ্বংসাত্মক আর জাহান্নামের সমতুল্য।
বার্লিন প্রাচীর নির্মাণের প্রায় দুই বছর পর রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি ব্রাডেনবার্গ গেটের কাছেই পশ্চিম জার্মানির সিটি হলের বাইরে জড়ো হওয়া প্রায় এক লাখ বিশ হাজারেরও অধিক জনগণের সামনে বক্তৃতা দেন; যা তাঁর রাষ্ট্রপতি জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে বিবেচিত করা হয়। কেনেডির এই ভাষণ একটি বিশেষ বাক্যের জন্য জনগণের মনে আজো স্মরণে রয়েছে,
![আমি একজন বার্লিনিয়ার/বার্লিনের বাসিন্দা।](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/415926-300x226.jpg)
আমি একজন বার্লিনিয়ার/বার্লিনের বাসিন্দা।
সব মিলিয়ে বার্লিন প্রাচীর অতিক্রম করতে গিয়ে প্রায় ১৭১ জন মানুষ নিহত হয়েছিল। তবে পূর্ব জার্মানি থেকে পালিয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু ছিল না। ১৯৬১ সাল থেকে ৮৯ এ প্রাচীর পতন হবার আগ অবধি ৫ হাজারেরও বেশি পূর্ব জার্মানবাসী পালিয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে ৬০০ জন সীমান্তরক্ষীও ছিল। প্রাচীর সংলগ্ন জানালা দিয়ে লাফিয়ে, কাঁটাতারের উপর দিয়ে চড়ে, প্যারাসুট বা বিশালাকৃতির বেলুনে চড়ে, নর্দমার মধ্য দিয়ে এবং প্রাচীরের অরক্ষিত অংশের মধ্য দিয়ে দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে পালাতে হতো তাদের।
![বার্লিন প্রাচীরের পতন](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/xxberlin-wall-archive-articleLarge-300x200.jpg)
বার্লিন প্রাচীরের পতন
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর হতে পুরো ইউরোপ জুড়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ কমতে আসতে শুরু করলে, পূর্ব বার্লিনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র পশ্চিমাদের সাথে তাঁর শহরের সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে একটি ঘোষণা দেন। তাঁর ঘোষনায় উল্লেখ করা হয় যে, সেদিন মধ্যরাত হতে জিডিআর তথা পূর্ব জার্মানির বাসিন্দারা অবাধে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য মুক্ত ঘোষিত।
ঘোষনাটি সম্প্রচার হওয়া মাত্রই পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির লোকজন বার্লিন প্রাচীরের কাছে জড়ো হয় এবং এই প্রাচীর ধরে ঝাঁকুনি দিতে শুরু করে উৎসুক জনতা। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে বিয়ার আর শ্যাম্পেইন পান করে উল্লাসে। আর চেঁচিয়ে বলতে থাকে, টর আউফ। যার অর্থ দরজা খুলো বা দরজা খুলে দাও। মধ্যরাতেই জনতা বন্যার মতো অবারিত ধারায় চেকপয়েন্টগুলো অতিক্রম করতে শুরু করে।
সেই সপ্তাহান্তে পূর্ব বার্লিনের প্রায় ২ মিলিয়ন লোক পশ্চিম বার্লিনে গিয়েছিল প্রাচীর পতনের উৎসব উদযাপন করতে। এক সাংবাদিক তাঁর আর্টিকেলে লিখেছিল, বিশ্ব ইতিহাসের বৃহত্তম স্ট্রিট পার্টি/সড়ক উৎসব। লোকেরা শুধু উৎসবই উদযাপন করেনি; বরং বিশাল আকারের হাতুড়ি তুলে দলে দলে প্রাচীর ভাঙ্গার কাজও করেছে। বিশাল আকারের চাঙ্গড় ভেঙ্গে প্রাচীরের গায়ে গর্ত করে উল্লাসে ফেটে পড়তো উৎসুক জনতা। তাদেরকে মাউয়াস্পেক্তা বলে অভিহিত করা হতো।
জার্মান এই শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে প্রাচীরের কাঠঠোকরা। পরে অবশ্য প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ ক্রেন আর বুলডোজারের সাহায্যে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রাচীর দ্রুতই গুঁড়িয়ে যায়। আর ১৯৪৫ সালের পর প্রথমবারের মতো বার্লিন একত্রিত হয় আবারও। এক বার্লিনার তাঁর আবেগ প্রকাশে স্প্রে দিয়ে অবশিষ্ট বার্লিন প্রাচীরে লিখেছিল,
কেবল আজকের দিনেই, সত্যিকারের যুদ্ধের সমাপ্তি হলো।
![কীভাবে দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলা হয়](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/141106235642__berlin_wall_640x360_afp_nocredit-300x169.jpg)
কীভাবে দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলা হয়
ঘটনাটি ছিল ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর। এর পাঁচ দিন আগে থেকে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দেয়ালের পূর্ব দিকে জড়ো হয়েছিল, যে দেয়ালটি পশ্চিম জার্মানি থেকে কম্যুনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানিকে আলাদা করে রেখেছিল। সীমান্তের কড়াকড়ি তুলে দিয়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দাদের ভ্রমণ সহজ করে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন পূর্ব জার্মানির নেতারা। তবে সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেয়ার কোন উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। এসব ছিল ছোট পরিবর্তন । কিন্তু যেভাবে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়, তার পরিণতি হয়েছিল ব্যাপক। ব্যাপক উন্নয়ন সম্পর্কে ব্রায়ান হ্যানরাহানের প্রতিবেদনের কারণে বার্লিন দেয়ালের দ্রুত পতন শুরু হয়। নতুন আইনের বিস্তারিত ঘোষণা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় গুন্টার স্কোহবোস্কিকে। কিন্তু নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনের আগে তার সেই ঘোষণা পড়ার সময় ছিল না। তিনি যখন প্রথমবারের মতো ঘোষণাগুলো পড়তে শুরু করেন তখন সাংবাদিকরা হতবাক হয়ে যান।
তিনি ঘোষণা করেন , ”দেশের বাইরে ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য এখন থেকে আর কোন পূর্বশর্ত প্রযোজ্য হবে না, ”।
বিস্মিত সাংবাদিকরা আরো বিস্তারিত জানার জন্য তখন হৈচৈ শুরু করেছেন। হাতের নোটগুলো উল্টাতে উল্টাতে মি. স্কোহবোস্কি জানালেন, তিনি যতটা জানেন, তাতে অবিলম্বে এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে যাচ্ছে। আসলে পরদিন থেকে ওই ব্যবস্থা চালু করার কথা ছিল, যেখানে ভিসার জন্য আবেদনের বিস্তারিত বলা হবে।
কিন্তু খবরটি দ্রুত টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়ে এবং পূর্ব জার্মানির বাসিন্দারা বিপুল সংখ্যায় সীমান্তে জড়ো হতে শুরু করেন।
ওই সন্ধ্যায় সীমান্তের দায়িত্বে থাকা একজন প্রহরী হারাল্ড জাগের ২০০৯ সালে ডার স্পিগেল পত্রিকাকে বলেছেন যে, তিনি বিহ্বলতার সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনটি দেখছিলেন এবং এরপরে দেখতে পেলেন যে, মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। মি. জাগের আতঙ্কিত হয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করলেন। কিন্তু তারা সীমান্তের গেট খুলে দেয়া অথবা জনতাকে ঠেকিয়ে রাখতে গুলি করা- কোন নির্দেশই দিলেন না। হাতেগোনা কয়েকজন প্রহরীকে নিয়ে শতশত বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাতে অবশ্য শক্তি প্রয়োগ করেও কোন কাজ হতো না।
”ধাক্কাধাক্কি করতে গিয়ে বা সেখানে কোন আতংক ছড়িয়ে পড়লে গুলি চালানো ছাড়াই মানুষজন আহত অথবা নিহত হতে পারতো,” তিনি ডের স্পিগেলকে বলেছেন।
”এ কারণে আমি আমার লোকজনকে আদেশ দিলাম, ব্যারিয়ারটি খুলে দাও।”
আনন্দ আর কান্না করতে করতে হাজার হাজার মানুষ সেখান দিয়ে ছুটে গেলেন, যে দৃশ্য দেখে সারা পৃথিবীর মানুষের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অনেকে বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেট বেয়ে ওপরে ওঠেন, হাতুড়ি আর কুঠার দিয়ে দেয়ালটি ভাঙ্গতে শুরু করেন। bএর মাধ্যমে যেন উত্তাল একটি বছর শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিল।
![বিপ্লবী স্রোত](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/109558404_f6fe3075-5ecd-42ef-a0a0-f084c1f54e29-300x169.jpg)
বিপ্লবী স্রোত
বছরের আন্দোলন এবং ধর্মঘটের ফলে ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি দেশটিতে নিষিদ্ধ সলিডারিটি ট্রেড ইউনিয়নকে আইনি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ওই সলিডারিটি ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় সরকার এবং সেই বছরের গ্রীষ্মে আংশিক মুক্ত নির্বাচনে তারা পার্লামেন্টে বেশ কিছু আসন দখল করে। যদিও কোটার কারণে কম্যুনিস্টরা বেশ কিছু আসন ধরে রেখেছে, কিন্তু যেখানেই দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই আসন দখল করে নিয়েছে ইউনিয়ন। সে বছর মার্চে হাঙ্গেরিতেও গণতন্ত্রের দাবিতে বিশাল সমাবেশ হয়। দীর্ঘদিনের লৌহ শাসন শেষে প্রথমবারের মতো মে মাসে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে থাকা হাঙ্গেরির ১৫০ মাইল লম্বা কাঁটাতারের বেড়া ছিঁড়ে ফেলা হয়। এর আগে হাঙ্গেরিতে ১৯৫৬ সালের বিপ্লবের চেষ্টা নিষ্ঠুরভাবে দমন করে সোভিয়েত, কিন্তু এবারের আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে।
পূর্ব জার্মানির বাসিন্দারা কঠোর নিয়মকানুন ছাড়া শুধু প্রতিবেশী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় ভ্রমণ করতে পারতেন। সেখানে গিয়ে শত মানুষ পশ্চিম জার্মানির দূতাবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন এবং ট্রেনে করে পশ্চিম জার্মানিতে চলে যেতেন। এই স্রোত সামলাতে অক্টোবর নাগাদ চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় পূর্ব জার্মানি। কিন্তু ততক্ষণে পূর্ব জার্মানির ভেতরেই বিপ্লব ছড়িয়ে পড়েছে।
![বার্লিন প্রাচীরের পতন কেবলই](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/berlin-wall1-640x505-1-300x237.jpg)
বার্লিন প্রাচীরের পতন কেবলই দুই জার্মানির এক হওয়ার গল্প নয়। এই দেয়াল ছিল স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বিবাদমান দুই পক্ষের বিভাজনের প্রতীক, যার এক পাশে ছিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, আর অপরপাশে একদলীয় সমাজতন্ত্র। বার্লিন দেয়ালের পতনকে ধরা হয় পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের চিহ্ন হিসেবে। তবে একত্রীকরণের পর পূর্ব জার্মানির নাগরিকরা রাতারাতি জীবনমানের যে উন্নতির আশা করেছিল তা এখনও পূরণ হয়নি। পূর্ব জার্মানির অধিকাংশ নাগরিক রাষ্ট্রীয় চাকরি ও কল্যাণকর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে নতুন রাষ্ট্রে মানবেতর জীবনযাপনের মুখোমুখি হয়। দুই জার্মানির নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের যে বৈষম্য বিভক্তির সময় তৈরি হয়েছিল, তার সমাধান আজও হয়নি। বার্লিন প্রাচীর পতনের প্রায় এক বছর পর, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯০ সালে ৩ অক্টোবর পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলন হয়। বর্তমানে বার্লিন প্রাচীরের একটি অংশ এখনো অরক্ষিতভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। আর বার্লিন প্রাচীর পতনের দিনটাতে জার্মানরা প্রাচীরের অংশে আলো জ্বালিয়ে জানান দেয়, এই জায়গাটা একসময় অন্ধকারে ডুবে ছিল। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মিল হলে পতন হয় এক দম্ভের দেয়ালের। সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদে মধ্যকার বিবাদের অবসান ঘটে। বার্লিন প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজো ইতিহাসে স্নায়ু যুদ্ধের এক স্থায়ী প্রতীক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বার্লিন প্রাচীর।
সূত্র: বিবিসি, জীবন্ত জীবন, উইকিপিডিয়া