Image default
ইতিহাস

বাবার লাশ ফেলে পালাতে হয়েছিল যে মঙ্গলকে

রহমান রা’আদ

ভদ্রলোকের নাম মুজিবুর রহমান মঙ্গল। প্রৌঢ়, চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে, কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার বারোঘোরিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা তিনি, গ্রামের নাম বিদ্যানগর। একাত্তরে তার বয়স ছিল ছয় থেকে সাত। তিন ভাই-তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। স্কুলে যাওয়ার কথা মনে করতে পারেন মঙ্গল,  ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়তেন। বাবা ছিলেন কৃষক, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়, তার নাম ছিল শহীদ আবদুল বারিক।

সময়টা ছিল শীতের ঠিক আগে, কার্তিক মাস। রমজান মাস। মঙ্গল বয়সে ছোট হলেও রোজা রেখেছিলেন সেদিন। সদলবলে রাজাকারদের একটা দল তাদের বাড়িতে ঢুকল, নেতৃত্বে ছিল দুই কুখ্যাত রাজাকার ভাই, নাসিরউদ্দিন এবং শামসুদ্দিন। মঙ্গলের এখনো স্পষ্ট স্মরণে আছে যে ,তাদের বাড়ির সামনে যে দো-চালা ঘরটা ছিল, ওরা সেখানে ঢুকে তার মায়ের হাতে একটা কোরআন শরীফ ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল, তোর ছেলে কই?”

মঙ্গলের বড় ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বেশ অনেক আগেই তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, স্বভাবতই তার কোনো খোঁজ জানার কথা নয় মঙ্গলের মায়ের। কিন্তু নাসিরউদ্দিন-শামসুদ্দিন খোঁজ খবর নিয়েই এসেছে আজ। মা জানালেন, তিনি তার ছেলের খোঁজ জানেন না। ওরা হুমকি দিয়ে বলল, ছেলের খবর না দিলে এখনই বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। মঙ্গল মনে করতে পারলেন ওদের হাতে থাকা ম্যাচের নামও, ঘোড়া মার্কা ম্যাচ। এমন এক অবস্থায় মঙ্গল হঠাৎই ধরা পড়ে গেলেন ওদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেকে হন্যে হয়ে খুঁজছে ওরা, তার সন্ধান বের করতে এবার ছোট্ট মঙ্গলকে পাশের সুপারি গাছের সঙ্গে বাঁধল। উদ্দেশ্য, যদি বড় ছেলের খোঁজ জানা না যায়, তবে ছোট ছেলে মঙ্গলের উপর চলবে অত্যাচার। খবর পেয়ে ইতোমধ্যেই ছুটে এসেছেন আবদুল বারিক। বারিকের নানাবাড়ির পাশেই নাসিরউদ্দিনের বাড়ি ছিল, সুতরাং সেই সূত্রে তিনি নাসিরউদ্দিনকে চিনতেন। তার রাজাকারীর খবরও সর্বজনবিদিত। ছেলেকে সুপারি গাছে বাঁধা অবস্থায় দেখে ক্ষুব্ধ বারিক নাসিরউদ্দিনকে প্রশ্ন করলেন, “আমার ছেলেকে কেন বেঁধেছিস?”

জবাবে রাজাকারেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল আবদুল বারিকের উপর। মার খেয়ে পড়ে গেলেন বারিক, কিছুক্ষণ পর মঙ্গলের চোখের সামনে তার বাবাকে গুলি করল রাজাকারেরা। তারা অন্যদিকে ব্যস্ত থাকার মধ্যেই কোথা থেকে যেন মঙ্গলের আরেক ভাই ছুটে এসে সুপারি গাছের বাঁধা ভাইকে মুক্ত করেছে, দুর্ভাগা মঙ্গল বাবার লাশ ধরে কাঁদবার সুযোগও পেল না। প্রাণ হাতে দুই ভাই তখনি দৌড়ে পালাতে থাকল যতদূরে পারে।

পেছনে ভেসে আসছে ক্রমাগত গুলির শব্দ। রাজাকারেরা ইতিমধ্যেই পরিবারের অন্য সদস্যদের উপরেও হামলা চালিয়েছে, নির্বিচারে হত্যা করছে। পরিবারের বড় ছেলে অর্থাৎ মঙ্গলের বড় চাচার স্ত্রী কমলা খাতুনের চোখের সামনে তার শ্বশুর এবং স্বামীকে গুলি করে মারল রাজাকারেরা। এরপর কমলার কোল থেকে তার ছোট্ট বাচ্চাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল, প্রাণ বাঁচাতে বাকিদের মতো রাজাকারদের হাত থেকে কোনোক্রমে পালালেন কমলা, বাচ্চার দিকে ফিরে তাকাবার বা আহাজারি করবার সামান্য সুযোগ বা ভাগ্য হয়নি তার। সেই সন্তানকে আর কখনো খুঁজে পাননি, বাকিদের বাচ্চাদের যেভাবে খালে ছুঁড়ে ফেলে বা আছাড় দিয়ে হত্যা করেছে রাজাকারেরা, তার সন্তানের পরিণতিও হয়তো সেরকম কিছুই হয়েছিল।

মঙ্গল সেদিন দূরবর্তী তার এক ফুফুর বাড়িতে রাত কাটালেন। কিন্তু পরদিনই মন মানল না আর, নিজের গ্রামে ফিরে এলেন। বাবার লাশটা তো ওভাবেই ফেলে এসেছেন, কবর দিতে হবে। গিয়ে প্রথমে কাউকেই খুঁজে পেলেন না তিনি, শূন্য বাড়ি।

গতকালের হামলার পর পালিয়ে গেছে সবাই। ধীরে ধীরে সবাইকে খুঁজে বের করে এরপর বাবার লাশ খুঁজে বের করার পালা। দাদার এবং পরিবারের আরো কয়েকজনের লাশ খুঁজে পেলেও অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরেও পাওয়া যাচ্ছিল না মঙ্গলের বাবার লাশ, অবশেষে পেছনে খাল থেকে বাবার লাশ খুঁজে পেলেন তিনি। গুলিতে ঝাঁজরা ক্ষতবিক্ষত লাশ, মাছে বা শেয়ালে ঠুকরে খেয়েছে বিভিন্ন অংশ। সঙ্গে আরেক ঘরে পাওয়া গেল আরও কয়েকজনের মৃতদেহ।

কবর দেওয়ার মতো লোক নেই, তবুও যতজনকে পাওয়া গেল তাদের নিয়েই লাশগুলোর সৎকার করে কবর দিতে আনা হলো গোরস্থানে। কিন্তু দুর্ভাগা, মঙ্গলের বিপদ তখনো শেষ হয়নি। রাজাকারেরা আবার হামলা চালালো, নির্বিচারে গোলাগুলির মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে গোরস্থানে লাশ রেখেই সবাই আবার পালালেন। মঙ্গলের চাচা বললেন, “ভায়েরে মাটি দিতে আইছি, এহন যদি তার জন্য মরতে হয়, মরলাম। ভয় পাই না আর।”

আজ এতো বছর পরেও চোখের সামনে গুলিতে নিহত বাবার কথা বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মঙ্গল। চোখের সামনে স্বামী, শ্বশুরকে গুলি খেয়ে মরতে দেখা, মুহূর্তের মধ্যে বুকের সন্তানকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা কমলা খাতুনের চোখ অবশ্য শুকনো, কণ্ঠ নিঃস্পৃহ। সময়ের করালগ্রাস স্তব্ধ করে দিয়েছে বোধহয় মানুষটিকে। স্বজনহারার শোক চিরতরে পাথর করে দিয়ে গেছে এমন কত কমলা খাতুনকে, অকৃতজ্ঞ এই জাতির সে হিসেব রাখবার সময় কই?

স্বজনহারা প্রত্যক্ষদর্শী: মুজিবুর রহমান মঙ্গল, কমলা খাতুন
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: গবেষক ও লেখক হাসান মুরশেদ (1971 Archive)
মূল সাক্ষাৎকারের তথ্যসূত্র: https://bit.ly/3GHk0jF 

সারাবাংলা/আইই

Source link

Related posts

গল্পটা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের

News Desk

গণিতবিদশারদ আতাউল হাকিমের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক

News Desk

কালো হরিণ চোখের হাবশী জাতির ইতিবৃত্ত

News Desk

Leave a Comment