“গুপ্তচর এক রাজকন্যা”কে খুঁজতে গিয়ে, নিজেকেই বলতে হলো, “কেন তারে এতদিন জানিনি সখা, দেখিনি সখা !!!”
“তুফানি এক সমুদ্রে এক মৎসকন্যা ভাসিয়েছেল তার জাহাজ
সমুদ্রের গভীরে সে যত যায়
দামাল ঢেউ তার চারপাশে আনন্দে পাক খায়।
কারণ, তার জাহাজে জ্বলছিল এক পিদিম
যার মিঠে রোশনাই পড়ত যার চোখে
উল্লাসে তার হৃদয় উঠত মেতে এক পলকে। ”
নুরউন্নিসা ইনায়েত খান (১৪ বছর)
দি ল্যাম্প অফ জয়
নূর-উন-নিসা ইনায়েত খান (১ জানুয়ারী ১৯১১ – ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪)
যিনি নোরা ইনায়াত-খান এবং নোরা বাকের নামে পরিচিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর ছিলেন যিনি স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (এসওই) -তে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একজন এসওই এজেন্ট হিসাবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসী প্রতিরোধের সহায়তায় ইউকে থেকে অধিষ্ঠিত ফ্রান্সে প্রেরিত প্রথম মহিলা বেতার অপারেটর হয়েছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতার পরে তাকে বন্দী করা হয়েছিল এবং দাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। ইউনাইটেড কিংডমের সর্বোচ্চ বেসামরিক সাজসজ্জা, এসওইতে তাঁর পরিষেবার জন্য তিনি মরণোত্তর জর্জ ক্রসকে ভূষিত করেছিলেন।
একজন এসওই এজেন্ট হিসাবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসী প্রতিরোধের সহায়তায় ইউকে থেকে অধিষ্ঠিত ফ্রান্সে প্রেরিত প্রথম মহিলা বেতার অপারেটর হয়েছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতার পরে ইনায়াত খানকে বন্দী করা হয়েছিল এবং দাচাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। ইউনাইটেড কিংডমের সর্বোচ্চ বেসামরিক সাজসজ্জা, এসওইতে তাঁর পরিষেবার জন্য তিনি মরণোত্তর জর্জ ক্রসকে ভূষিত হয়েছিলেন।
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। জার্মানির দাখাউ বন্দীশিবির। সেদিন তখনও ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। হত্যা করার জন্য ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিকলবন্দী চার নারীকে। ঘাতকের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একে একে তিনজন। এবার চতুর্থজনের পালা। একজন ঘাতক প্রথমে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করল তাঁকে। আহত বন্দিনী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ঘাতক তার শক্ত মিলিটারি বুটের ক্রমাগত লাথি দিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলল। তারপর মুমূর্ষ অবস্থায়ই তাঁকে জোর করে হাঁটু গেড়ে বসানো হল। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই নিশ্চিত মৃত্যু। তবুও সেই নারী ভেঙ্গে পড়েননি কিংবা মৃত্যুভয়ে কাতর হননি মোটেও। বরং ঘাতক যখন গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করেছে তাঁর মাথা বরাবর, ‘লিবার্তে (স্বাধীনতা)’ বলে তিনি জীবনের অন্তিম শব্দটি উচ্চারণ করলেন দ্রোহে, দৃঢ়তায়। এভাবেই মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন সেই অকুতোভয় নারী। তিনি নূর ইনায়েৎ খান – শান্ত, লাজুক ‘রাজকন্যা’ থেকে দুঃসাহসী গুপ্তচরে পরিণত হওয়া এক অসামান্যা ভারতীয় নারী।
প্রাথমিক জীবন
তিনি জন্মেছিলেন মহীশুরের কিংবদন্তীতুল্য শাসক টিপু সুলতানের রাজবংশে। তাই জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন একজন ‘প্রিন্সেস’। তাঁর পিতা ছিলেন টিপু সুলতানের প্র-প্রপৌত্র প্রিন্স হযরত ইনায়েৎ খান–একজন সুফিসাধক ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর মাতা ছিলেন একজন আমেরিকান, অরা রে বেকার ওরফে আমিনা বেগম। নূর-উন-নিসা ইনায়েত খানের জন্ম হয় রাশিয়ার মস্কোতে, ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
নূরের জন্মের পর পরই তাঁর পরিবার রাশিয়া থেকে ইংল্যান্ডে চলে যায় এবং লন্ডন শহরে বসবাস শুরু করে। এ সময় ছোট্ট নূরকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বদেশের স্বাধীনতাকামী প্রিন্স ইনায়েত খান একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী ও মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে ১৯২০ সালে ফ্রান্সে চলে যান এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে ‘ফজল মঞ্জিল’ নামক একটি বাড়িতে ওঠেন। ইউরোপে জন্ম এবং বসবাস হলেও নূর বেড়ে ওঠেন তাঁর পিতার অহিংস সুফি আদর্শ, ভারতীয় সংস্কৃতি ও রক্ষণশীল পারিবারিক আবহকে ধারণ করে। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতে তালিম নেন। তিনি প্যারিসের একটি কনজার্ভেটরীতে সঙ্গীত এবং সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু মনস্তত্ত্বে শিক্ষালাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই নূর ছিলেন শান্ত, লাজুক, স্বাপ্নিক ও ভাবুক প্রকৃতির।
১৯২৭ সালে নূরের পিতার আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর মাতা আমিনা বেগম স্বামীশোকে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ফলে গোটা পরিবারের দায়িত্ব বর্তায় নূরের ওপর। এসময় তিনি প্যারিসে বিভিন্ন শিশু সাময়িকীতে লেখালেখি এবং রেডিওতে শিশুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। পরে তাঁর লেখা একটি শিশুতোষ বইও প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ সালে বাচ্চাদের জন্য তার লেখা প্রথম বই “Twenty Jataka Tales” প্রকাশিত হয়। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আগ্রাসনকারী জার্মান বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে নূরের পরিবার প্যারিসে থাকা আর নিরাপদ মনে করল না। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ১৯৪০ সালের জুন মাসে আবার তারা ইংল্যান্ডে ফিরে আসে। কিন্তু ইংল্যান্ডের আকাশেও তখন যুদ্ধের ঘনঘটা। জার্মান বাহিনীর নির্বিচার আগ্রাসন এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা দেখে নূর ও তারঁ ভাই বিলায়েৎ খান নিস্পৃহ না থেকে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন–যদিও তা ছিল তাঁদের প্রয়াত পিতার অহিংস সুফি আদর্শের পরিপন্থী।
স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ
এই এসওই সদস্যদেরই একজন ছিলেন নূর ইনায়াত খান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বছরেই (১৯১৪) জন্ম তার, তৎকালীন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মস্কোতে। তবে বাবার দিক থেকে নূরের গায়ে বইছিল ভারতের রক্ত। তার বাবা ইনায়াত রেহ্মাত খান ছিলেন উত্তর ভারতের প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল মিউজিশিয়ান, যিনি হায়দারাবাদের নিজামের কাছ থেকে ‘তানসেন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নূরের জন্মের বছরেই সপরিবারে ইংল্যান্ডে গিয়ে এক সুফি সংঘও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
ইনায়াত রেহ্মাত খানের মা খাতিজাবি ছিলেন ‘ভারতের বিটোফেন’ খ্যাত ওস্তাদ মাওলা বক্স খানের কন্যা। ওদিকে মাওলা বক্সের স্ত্রী কাসিম বিবি আবার ছিলেন ইতিহাসের বিখ্যাত বীর যোদ্ধা মহিশূরের শাসনকর্তা টিপু সুলতানের নাতনী। ফলে আমাদের আজকের আলোচনা যে নূর ইনায়াত খানকে নিয়ে, তার গায়ে যে বিপ্লবের রক্ত বইছে, সেটা তার বংশ পরিচয়ই বলে দেয়।
১৯৪০ সালের ১৯ নভেম্বর নূর ব্রিটিশ উইমেন্স অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্স (WAAF)-এ যোগ দেন এবং রেডিও অপারেটর হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে রাজকীয় বিমানবাহিনীর বম্বার ট্রেনিং স্কুলে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানকার কাজ তাঁর কাছে একঘেয়ে লাগায় তিনি কমিশন্ড পদবির জন্য আবেদন করেন। ফরাসি ভাষার ওপর তাঁর দক্ষতার কারণে পরবর্তীতে তাঁকে চার্চিলের বিশেষ গুপ্তচর সংস্থা, স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ (SOE)-এর ‘এফ’ (ফ্রান্স) সেকশনে ভর্তি করা হয়।
এরপর গুপ্তচর হওয়ার জন্য নূরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণের সময় তিনি নোরা বেকার নাম নেন। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণে তাঁর ফলাফল তেমন সন্তোষজনক ছিল না, বরং গুপ্তচর হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ ফিল্ড এসাইনমেন্টের জন্য তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশিক্ষকদের দ্বিধা ছিল। বিশেষ করে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে ভয় পেতেন। এমনকি, প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে একটি ‘মক ইন্টারোগেশন’ বা সাজানো জেরার সময় তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন! তিনি গুপ্তচর প্রশিক্ষণ পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। তবে ফরাসি ভাষা ভাল জানার কারণে এবং রেডিও অপারেটর হিসেবে দক্ষতার জন্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে প্যারিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারিসে পাঠানোর আগে কর্তৃপক্ষ নূরকে জানায়, কাজটি অত্যন্ত বিপদজনক এবং শত্রুর হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। এসব জেনেও তিনি প্যারিসে গুপ্তচর হিসেবে যেতে রাজি হন। তিনি হলেন শত্রু-অধিকৃত ফ্রান্সে গমনকারী প্রথম ব্রিটিশ নারী গুপ্তচর।
অবশেষে ১৯৪৩ সালের ১৬ জুন তারিখ রাতে নূর তাঁর সাংকেতিক নাম ‘মেডেলিন’, অপারেটর কলসাইন ‘নার্স’ এবং ভুয়া পাসপোর্টে ‘জ্য মারি রেগ্নিয়ার’ ছদ্ম পরিচয় নিয়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। নূরের এই গোপন মিশন সম্পর্কে তাঁর পরিবারও জানত না। ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর একটি বিমান তাঁকে উত্তর ফ্রান্সের একটি অবতরণ-স্থানে রাতের অন্ধকারে, গোপনে নামিয়ে দেয়। প্যারিসে এসে নূর ‘প্রসপার নেটওয়ার্ক’ নামক ব্রিটিশ গুপ্তচর দলে যোগ দেন–যারা জার্মানদের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধ-সংগ্রামের পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ততদিনে জার্মান গোয়েন্দারা প্রসপার নেটওয়ার্কের খোঁজ পেয়ে গেছে। পরবর্তী দেড়মাসের মধ্যে নূর ছাড়া এই দলের দলনেতাসহ প্রায় সবাই জার্মান গেস্টাপো বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং এর ফলে প্যারিসে ব্রিটিশ গোয়েন্দা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নূরকে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তিনি ছাড়া প্যারিসে আর কোন যোগাযোগের মাধ্যম না থাকায় চরম বিপদাপন্ন জেনেও নূর ফিরে যেতে রাজি হননি।
জার্মান-অধিকৃত এলাকায় যেখানে একজন গুপ্তচর রেডিও অপারেটরের গড় ‘আয়ুষ্কাল’ ছিল মাত্র ছয় সপ্তাহ, ফিল্ড অপারেশনের জন্য ‘আনফিট’ নূর একাই সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রায় অসম্ভব কাজে নেমে পড়লেন। এর মধ্যে জার্মানরা তাঁর দৈহিক বর্ণনা ও গোপন নাম জেনে ফেলল এবং তাঁকে ধরার জন্য গোটা প্যারিসজুড়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করল। ধরা না পড়ার জন্য নূর প্যারিসে একের পর এক অবস্থান পাল্টাতে লাগলেন। তিনি বারবার নিজের নাম, বেশভূষা, চুলের রঙ ও স্টাইল পরিবর্তন করে জার্মানদের ধোঁকা দিয়ে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। ফরাসি ভাষা খুব ভালভাবে রপ্ত থাকায় তিনি নিজেকে ফরাসি নাগরিক প্রমাণ করে জার্মান চেকপোস্ট অতিক্রম করাসহ বিভিন্ন বিপদজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন। একসময়ের ভীতু নূর তখন দুঃসাহসী মেডেলিন।
নূর সবসময় ১৫ কেজি ওজনের গুরুত্বপূর্ণ রেডিও সেটটি সঙ্গে বহন করতেন। একদিন তিনি প্রায় ধরা পড়তে যাচ্ছিলেন। জার্মান গেস্টাপো তাঁকে তাঁর রেডিও সেটসহ চ্যালেঞ্জ করলে তিনি এটিকে সিনেমা প্রোজেক্টর হিসেবে চালিয়ে দিয়ে পার পেয়ে যান। এভাবে দূঃসাহস আর বুদ্ধির জোরে ধরা পড়ার চরম বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে এবং তাঁর সম্পর্কে প্রশিক্ষকদের মূল্যায়ন ভুল প্রমাণ করে তিনি একাই ছয়জন রেডিও অপারেটরের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্য তাঁর সহায় থাকেনি। তবে নিজের কোন ভুলে নয়, বরং এক পরিচিতজনের অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতায় প্রায় সাড়ে তিনমাস পর তিনি ধরা পড়েন- তাও ঠিক ব্রিটেনে ফিরে আসার এক দিন আগে… ভাবা যায়! নুর ধরা পরেন যখন এক ফরাসি প্রাক্তন বিমান চালক হেনরি ডেরিকোর্ট জার্মান বাহিনীর প্রচন্ড টর্চারে নুরের কথা ফাঁস করে দেন। যখন ফিল্ডে প্রায় সব অপারেটরা ধরা পরেছে আর নয়ত ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছে, নুর তখন একাই ফিল্ডে, দূর্দান্ত সাহসীকতার সাথে তাঁর কাজ একাই চালিয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ার পর প্রায় দু’বার নূর চেষ্টা করে পালাবার কিন্তু ভাগ্য আর সাথ দেয় নি। নিয়তি শেষ অবধি তাঁকে টেনে নিয়ে যায় সেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই সেদিন, ১৩ অক্টোবর ১৯৪৩, কাজ শেষে নূর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে দেখেন সশস্ত্র গেস্টাপো তাঁকে ধরার জন্য ওঁত পেতে রয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য তাঁকে একটি পিস্তল দেওয়া হলেও অহিংস-নীতিবাদী নূর কখনই সেটি সাথে রাখতেন না। তাই ধরা পড়ার সময় খালি হাতে একাকী লড়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। কিন্তু তাই বলে তিনি বিনা যুদ্ধে ধরা দেননি। বরং গ্রেফতারের সময় তাঁর দুর্ধর্ষ আচরণের কারণে জার্মানরা তাঁকে ‘অতি-বিপদজনক বন্দী’ আখ্যা দেয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, ধরা পড়ার আগে নূর সবশেষ যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেটি ছিল প্যারিসে গেস্টাপোর সদরদপ্তর থেকে মাত্র দু’শ গজ দূরে!
ধরা পড়ার পর তাঁকে গেস্টাপো সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাঁর ওপর নেমে আসে কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের ভয়ংকর খড়্গ। কিন্তু অকথ্য নির্যাতনের জন্য ইতিহাস-কুখ্যাত জার্মান এসএস গেস্টাপো তাঁর কাছ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনি। নির্যাতনের সীমাহীন যন্ত্রণা তিনি মুখ বুঁজে সয়েছেন, তবুও নিজের নাম ‘নোরা বেকার’ ছাড়া আর কোন তথ্য দেননি। পরবর্তীতে যুদ্ধশেষে আত্মসমর্পণকারী ও নূরকে জিজ্ঞাসাবাদকারী জার্মান গোয়েন্দা অফিসারও স্বীকার করেছিল, তারা নূরের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারেনি, বরং তিনি একজন সুদক্ষ গুপ্তচরের মত ক্রমাগত ভুল তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছেন।
কারাজীবন
প্রায় একমাস নূরকে প্যারিসে বন্দী করে রাখা হয় এবং এর মধ্যেই তিনি দুইবার পালানোর চেষ্টা করেন। যেদিন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, সেদিনই তিনি বাথরুমের জানালা গলে, জলের পাইপ বেয়ে প্রথমবার পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। তারপর ২৫ নভেম্বর ১৯৪৩ তারিখে তিনি আরও দুইজন বন্দী গুপ্তচর সহকর্মীকে নিয়ে বন্দীশালার ছাদ উঠে পালান। কিন্তু কপাল খারাপ! তখনই বিমান-হামলার সাইরেন বেজে ওঠায় বন্দীশালার প্রহরীরা নিয়মানুযায়ী বন্দীর সংখ্যা গুনতে গিয়ে পালানোর ঘটনা টের পেয়ে যায় এবং বেশি দূর যাওয়ার আগেই নূর আবারও ধরা পড়েন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হল, বন্দী অবস্থায়ও জার্মানরা তাঁকে দিয়ে ইংল্যান্ডে স্বাভাবিক বেতার-বার্তা পাঠানোর অভিনয় চালিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং এরকম একটি বার্তায় তিনি তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরা পড়ার পূর্ব-নির্ধারিত সংকেত পাঠান। কিন্তু বার্তায় উল্লেখিত তাঁর গ্রেফতার হওয়ার সেই সংকেতটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে যায়। নূরের ধরা পড়ার বিষয়টি তারা তখনও বুঝতে পারেনি।
নূর বারবার পালানোর চেষ্টা করায়, ‘তিনি আর পালাবেন না’–এই মর্মে তাঁর কাছে থেকে জার্মান গোয়েন্দারা লিখিত মুচলেকা নিতে চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। এরপর জার্মানরা তাঁকে আর প্যারিসে রাখা নিরাপদ মনে করেনি। ২৭ নভেম্বর ১৯৪৩ তারিখে তারা তাঁকে প্রথম বন্দী গুপ্তচর হিসেবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে জার্মানিতে স্থানান্তর করে একটি কারাগারে রাখে। পরে তাঁকে অন্য একটি দুর্ভেদ্য, নিরাপদ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ‘বিপজ্জনক ও অসহযোগী কয়েদি’ বিবেচনা করে তাঁকে মূল কারাগার থেকে দূরে একটি বিচ্ছিন্ন, নির্জন সেলে রাখা হয় এবং তাঁর হাতে পায়ে লোহার বেড়ি ও কোমরে শিকল পরানো হয়। তিনি তখন এমন এক কয়েদি–বিস্মৃতি ও মৃত্যুই যার একমাত্র পরিণতি।
পরের দশটি মাস কারাগারে অবর্ণনীয়, অমানুষিক, অসহ্য নির্যাতনের এক জীবন কাটান নূর। কিন্তু কোন কিছুই তাঁকে মচকাতে পারেনি। সব কষ্ট, সব যন্ত্রণা তিনি সহ্য করে গেছেন দিনের পর দিন। শেষ পর্যন্ত জার্মানদের কাছে নতি স্বীকার করেননি। বন্দিনী নুরের মানসিকতা তুবড়ে দিতে পারেনি জার্মানরা। রবার্ট ডাউলেন, গিলবার্ট র্নম্যানের মতো পোড়খাওয়া এজন্টেরা যেখানে অত্যাচার সইতে পারেন নি, সেখানে নিগ্রহ- অত্যাচারের মুখে নুর ছিলেন অবিচল। মনে মনে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার তারিফ করেন জার্মানরাও। বরং এত চেষ্টা করেও তারা কোনদিন তাঁর আসল নামটা পর্যন্ত জানতে পারেনি–অন্যান্য তথ্য তো দূরের কথা। দাখাউ ক্যাম্পে নির্জন সেলে প্রচন্ড মানসিক এবং শারিরিক নির্যাতন এবং পরে বর্বরতম মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত সত্ত্বেও স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা তাকেঁ বিন্দুমাত্র ভেঙ্গে পড়তে দেয়নি। ১৯৪৪ সালে মৃত্যুদন্ডের দুমাস আগেও আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে নিজের খাবার পাত্রে আচঁড় কেটে লিখে দেন ‘‘ভিভ ল্য কাত্র জুইয়ে’(৪ জুলাই দীর্ঘজীবি হোক)। আর ১৪ জুলাই ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসে লেখেন ‘ভিভ ল্য ফ্রঁস লিব্রে’ অর্থাৎ স্বাধীন ফ্রান্স দীর্ঘজীবি হোক। এ আচঁড় কাটা পাত্র অন্যান্য বন্দিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার উদ্দীপনা এবং এক সময় তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে।
অবশেষে ১৯৪৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে নূর ও ও সাথে আরও তিনজন SOE এজেন্ট ইয়োলান্ড বিকম্যান, এলিয়ান প্লিউম্যান ও মেডেলিন ডামার্মেন্ট কে দাখাউ কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে ঐ ক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরা একজন বন্দী প্রকাশ করেন হত্যার আগে নুরকে উইলহেম রুপার্ট নামক এক উচ্চপদস্থ SS- অফিসার (পরবর্তীতে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়) সারা রাত নির্মম ভাবে প্রহার করে। পরের দিন ভোরে জার্মানরা ওই তিনজন বন্দিনীসহ তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পর সাথে সাথে তাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। অসম সাহস, অনন্য কর্তব্যনিষ্ঠা আর সীমাহীন যাতনার এক জীবনের অবসান হয় এভাবেই। মিত্রবাহিনীর হয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। দাখাউয়ের কালান্তক দহন চুল্লির মধ্যে মিশে রয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের চিতাভস্ম। মৃত্যুর এই বেদির কাছেই নুরকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে এক সাধারণ অথচ নয়নাভিরাম বাগান। নিজের আত্মবলিদানের ফলাফল দেখে যেতে পারেন নি নুর। তবে নিঃসন্দেহে তিনি চেয়েছিলেন, পরবর্তী প্রজন্ম এক স্বাধীন পৃথিবীকে পাবে। দাখাউয়ের সেই বাগান স্বাধীন পৃথিবীর প্রতি নুরের অমর উপহারের সাক্ষ্য বহন করছে।
সম্মান ও পুরস্কার
নূরের অবদানের মরণোত্তর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক বীরত্বপদক ‘জর্জ ক্রস’ (George Cross) সম্মান পান। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মাত্র চারজন নারী এই সম্মান পেয়েছেন। সেই বছরই ফরাসি সরকার তাঁকে ‘ক্রস অব ওয়ার’ (Croix de Guerre) সম্মানে ভূষিত করেছিল। তাঁর সম্মানে লন্ডনের গর্ডন স্কোয়ার গার্ডেনে ৮ নভেম্বর ২০১২ সালে নূরের একটি আবক্ষ মুর্তি উন্মোচিত করা হয়।
আজও প্রতি বছর ১৪ জুলাই ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসে ফরাসি সামরিক বাদক দল প্যারিসের ‘ফজল মঞ্জিলের’ সামনে নূরকে সম্মান জানায়। মহীশুরের রাজা টিপু সুলতানের বংশধর, ‘প্রিন্সেস’ নূর ইনায়েৎ খান ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে জার্মান আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, যুদ্ধশেষে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তা আর হয়নি।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, রোয়ার মিডিয়া