বিহারে বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ: “তিনি নালন্দা বিহার ধ্বংস করেন এবং সেখানকার নিরীহ ভিক্ষুদের অকারণে হত্যা করেন। আর এর পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর তথ্য চালাচালি হয়।

এবিষয়ে গবেষক অনির্বাণ বন্দোপাধ্যায় প্রচলিত কিছু বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, বখতিয়ারের বিরুদ্ধে নালন্দা মহাবিহার তথা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার নিরঙ্কুশ অপবাদ বহুল প্রচারিত। কোন কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ১১০০ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজি ধ্বংস করেছেন। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও বখতিয়ারের এই আক্রমণের তারিখ জানিয়েছেন ১১০০ খ্রিস্টাব্দ।

অথচ স্যার উলসলি হেগ বলছেন, বখতিয়ার ওদন্তপুরী আক্রমণ করেছেন ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে। আর স্যার যদুনাথ সরকার এই আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ। সবচাইতে মজার বিষয় যে, বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করেন ১০ মে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে। স্যার যদুনাথ সরকার বখতিয়ারের বঙ্গ আক্রমণের সময়কাল বলছেন ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে বৌদ্ধদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে।

নালন্দা ধ্বংসে বখতিয়ার খলজি সত্য মিথ্যা
ছবি: nobojagaran.com

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে, ধ্বংস করা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দার ধারেকাছেই যাননি। শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর ‘অ্যান্টিকুইটি অফ চিটাগাঁও’ প্রবন্ধে লিখেছেন, বিক্রমশীলা ও ওদন্তপুরী বিহার দুটি ধ্বংস করা হয়েছিল ১২০২ খ্রিস্টাব্দে। এই তালিকায় নালন্দার উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিক মিনহাজের ‘তবকাত-ই-নাসিরী’গ্রন্থেও নালন্দার উল্লেখ নেই। ১২৩৪-৩৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, অর্থাৎ বখতিয়ারের (১২০৬ খ্রি: মৃত্যু) বিহার জয়ের ৩১ বছর পরও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু ছিল। সেসময়ে তিব্বত থেকে ধর্মস্বামী এসে নালন্দা বিহারকে চালু অবস্থাতেই দেখেছেন। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু পড়াশােনা করেছেন। অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, সবাই যখন বলেন নালন্দা ধ্বংস হয়েছে, তাহলে তা ধ্বংস হয়েছেই। কিন্তু তা ধ্বংস করলো কে?

 নালন্দা বিহার
ছবি: dailyhunt.in

অনেকে মনে করেন নালন্দা ধ্বংস আসলে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাত। বুদ্ধগয়া গয়া-দর্শন রাজগীর নালন্দাপাওয়াপুরী’ নামক এক পর্যটক সহায়ক পুস্তিকায় বলা হয়েছে, “পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ দার্শনিক ও প্রচারক কুমারভট্ট এবং শংকরাচার্যের প্রচেষ্টাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। বারো বৎসরব্যাপি সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা (ব্রাহ্মণরা) যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধবিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়। অন্য এক সুত্র তিব্বতীয় শাস্ত্র ‘পাগসাম ইয়ান জাং’-এ বলা হয়েছে, উগ্র হিন্দুরা নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছে। তবে ডি আর পাতিল মনে করেন নালন্দার গ্রন্থাগার পুড়িয়েছিল শৈব সম্প্রদায়ের মানুষরা। কিন্তু বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি তাঁর বাঙ্গলার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “নালন্দার লাইব্রেরি কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়।” তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে, “ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরি তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তা ধ্বংস হয়।

মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনাকতক তরুণ ভিক্ষু দুজন তীর্থিক ভিক্ষুর গায়ে নোংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ এবং নয়তলাযুক্ত রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।” বুদ্ধপ্রকাশ তাঁর ‘Aspects of Indian History and Civilisation’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন, “নালন্দায় অগ্নিসংযোগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী।”

ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল

ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর পাটলিপুত্র আক্রমণ করার সময়ই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়। যতদূর জানা যায়, সেই সংখ্যাটি মোটে তিনবার। প্রথমবার স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে) মিহিরকুলের নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হানদের দ্বারা। উল্লেখ্য, মিহিরকুলের নেতৃত্বে হানরা ছিল প্রচণ্ডরকমের বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। বৌদ্ধ ছাত্র ও ধর্মগুরুদের হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। স্কন্দগুপ্ত ও তার পরবর্তী বংশধরেরা একে পুনর্গঠন করেন।

 নালন্দা বিহার
ছবি: banglahub.com.bd

প্রায় দেড় শতাব্দী পরে তা আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। আর তা হয় বাংলার শাসক শশাঙ্কের দ্বারা। শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার অন্তর্গত গৌড়ের রাজা। তার রাজধানী ছিল আজকের মুর্শিদাবাদ। রাজা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রভাব বিস্তার করে। রাজা শশাঙ্কের সঙ্গে বুদ্ধের অনুরক্ত রাজা হর্ষবর্ধনের সবসময় শত্রুতা বিরাজমান ছিল এবং খুব একটি বড় যুদ্ধও হয়েছিল। রাজা শশাঙ্ক যখন মগধে প্রবেশ করেন তখন বৌদ্ধদের পবিত্র স্থানগুলিকে ধ্বংস করেন, খণ্ড-বিখণ্ড করেন বুদ্ধের ‘পদচিহ্ন। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত গভীরে যে তিনি বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও, বুদ্ধগয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করেন, যাতে এর আর কিছু অবশিষ্ট না থাকে। রাজাদের মধ্যে অন্তর্কলহ, শত্রুতা, হত্যা ও উপাসনালয় ধ্বংস সেসময় খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ছিল না। রাজা জাতবর্মা ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। জাতবৰ্মা সোমপুর বৌদ্ধবিহারটি অবরুদ্ধ ও লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন। ওই মহাবিহারের মঠাধ্যক্ষ করুণাশ্রী মিত্রকেও অগ্নিদগ্ধ করে খুন করেন। হিন্দুরাজা ভোজবর্মার বেলাবলিপিতে জাতবর্মা কর্তৃক
সোমপুরের মহাবিহার ধ্বংসের ইতিহাস উল্লেখ আছে।

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে মনে করেন, বখতিয়ার দুর্গ ভেবে বৌদ্ধভিক্ষুদের আবাসস্থল ওদন্তপুর মহাবিহার আক্রমণ করেন বিনা বাধায়। দুর্গ দখলের পর তিনি লক্ষ্য করেন দুর্গের বাসিন্দারা সকলেই মুণ্ডিতমস্তক। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানতে পারলেন, তাঁরা বৌদ্ধ আর দখলিকৃত দুর্গটি আসলে বৌদ্ধবিহার। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার দেখিয়েছেন, ওদন্তপুর বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। এ ছাড়া আরও অনেক গবেষক বলেছেন, ওদন্তপুর ধ্বংস হয় ১১৯১-৯৩ সময়কালে। অথচ সুখময় মুখােপাধ্যায় দেখিয়েছেন, বখতিয়ার বিহার বিজয় করেন ১২০৪ সালে।

বখতিয়ার খলজি
ছবি: amazonaws.com

ইতিহাসে মুসলমানদের হাতে বৌদ্ধদের হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার কোন রেকর্ড দেখা যায় না। বরং ৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে চীনে সম্রাট তাই উ বৌদ্ধদের উপর ব্যাপকভিত্তিক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি সেখানকার সব বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস এবং সব বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেন। এছাড়া ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে বার্মার বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্র পাগান ধ্বংস করে ফেলে চীনা সেনাবাহিনী। এই ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন আজও বিদ্যমান। অপরদিকে ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আগ্রাসনে হিন্দুদের প্রাণকেন্দ্র অযোধ্যা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ত্রয়োদশ শতকে কম্বোডিয়াতেও হিন্দুরা উচ্ছেদের শিকার হয় বৌদ্ধদের মাধ্যমে। হিন্দু দেবতার স্থলে প্রতিস্থাপিত হয় বুদ্ধমুর্তি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পরেও অশোক হিংসা ত্যাগ করেননি। তিনি পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার নির্দেশ দেন, যার ফলে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হন। এছাড়া জৈন ধর্মাবলম্বীদেরও তিনি হত্যা করেন বলেও কথিত রয়েছে।

রেফারেন্স:-
১। অনিরুদ্ধ রায়: মধ্যযুগের ভারতীয় শহর
২। দীনেশচন্দ্র সেন: বৃহৎ বঙ্গ
৩। ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান: বাংলাদেশের মুসলিম পুরাকীর্তি, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০১, ISBN 984 410 2057
৪। এম. এ. রহিম: বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫, ISBN 984-07-4678-1
৫। সৈয়দ লুৎফুল হক: বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি, অ্যাডর্ন পাবলিকেসন্স, ঢাকা, আগস্ট, ২০১৬, ISBN 978-984-20-0456-8
৬। সরদার আব্দুর রহমান: ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি, দিব্যপ্রকাশ প্রকাশনী

Related posts

ম্যারাথন রেস এর ইতিহাস

News Desk

১৪ ডিসেম্বর: নজিরবহীন হত্যাকাণ্ডের কৃষ্ণ প্রহর

News Desk

বাঙালির “কফি হাউসের সেই আড্ডার”আত্মগোপন কাহিনী

News Desk

Leave a Comment