একই সঙ্গে বড় একটা ভুলও ধরিয়ে দিলেন তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্যের একটি সাড়াজাগানো তত্ত্বের। ৩৬ বছর পর। আর এ ভাবেই, ‘এক ঢিলে দুই পাখি মেরে’ গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছেন বারাসতের সেই ছেলে- ‘যাকে কেউ চেনে না’!
২০১৪-র মার্চে তুমুল হই চই পড়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। রটে গিয়েছিল, ১৪০০ কোটি বছর আগে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহা-বিস্ফোরণের পর পরই যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল, এই প্রথম তার খোঁজ মিলেছে দক্ষিণ মেরুর আকাশে। ১০০ বছর আগে তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু, কিছুতেই তার অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। তাই ২০১৪-য় ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর তুমুল হই চই শুরু হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে। পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে। ‘ইউরেকা’! ‘ইউরেকা’!
সেই সময়েই সন্দেহটা প্রথম জাগল তাঁর মনে। অঙ্কের জটিল সমীকরণের হিসেবটিসেব কষে তাঁর মনে হল- ‘ভুল হয়ে গিয়েছে, বিলকুল!’ ‘বাইসেপ-টু’র পরীক্ষা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন আর তা নিয়ে যে বিশ্বজুড়ে খুব আলোড়ন হচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও একটা বড়সড় ভুল রয়ে গিয়েছে। মহাকাশে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পাঠানো ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করছে যে গবেষকদল, তার লিড সায়েন্টিস্ট বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক জঁ-ল্যু পুজেকে সেই বড়সড় গরমিলের খবরটা জানালেন তিনি। শুনে তো খুব খুশি অধ্যাপক পুজে! বললেন, ‘ক্যারি অন!’
তার কয়েক মাসের মধ্যেই বারাসতের ছেলে যা করলেন, গোটা বিশ্ব এখন তারই সাবাশি দিয়ে বলছে, ‘ইউরেকা’! ‘ইউরেকা’! কারণ, সেই ভুলটা ধরা পড়েছিল বলেই সঠিক ভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার সম্ভব হল। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ১০০ বছর পর আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সার্বিক ভাবে প্রমাণিত হল। আর তা প্রমাণিত হল একেবারেই নির্ভুল ভাবে। কোনও ভুল পর্যবেক্ষণ বা তার কোনও ভুল বিশ্লেষণের ভরসায় আমাদের নির্ভর করতে হল না আইনস্টাইনের তত্ত্বের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। সত্যি-সত্যিই ‘মান’ বাঁচল আইনস্টাইনের!
বারাসতের সেই ছেলে তুহিন ঘোষ এখন গোটা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম। প্রাক্তন সেনা-কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের পুত্র তুহিনের জন্ম আর কলেজ জীবনটা কেটেছে বারাসতেই। বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজের স্নাতক তুহিন স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করতে যান খড়্গপুরের আইআইটি-তে। ২০০৬ সালে ডক্টরেট করতে যান পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে। সেখান থেকে ২০১২-য় ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস সুদে, পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রি নিতে। তুহিন তাঁর দ্বিতীয় পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রিটি করছেন এখন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে।
যার জন্য এখন বিশ্বজুড়ে তুহিনের নামে ‘ধন্যি ধন্যি’, তাঁকে সেই কাজটা করার ইন্ধনটা জোগাল কে? বলা ভাল, তাঁকে উৎসাহিত করল কোন ঘটনা?
সেটা জানার জন্য আমাদের কয়েকটা জিনিস বুঝে নিতে হবে।
১৪০০ কোটি বছর আগে সেই মহা-বিস্ফোরণের চার কোটি বছর পরে এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম দেখা মিলল আলোর। এল ফোটন কণা। তৈরি হল কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি। এখনও পর্যন্ত আমাদের দৌড় ওই সময় পর্যন্তই। মানে, ১৪০০ কোটি বছর আগে ‘বিগ ব্যাং’য়ের সময় ঠিক কী কী হয়েছিল, তা জানা ও বোঝার জন্য, ‘বিগ ব্যাং’-এর চার কোটি বছর পর যে সিএমবি তৈরি হয়েছিল, তার ওপরেই আমাদের নির্ভর করতে হয়। তার চেয়ে আরও পিছনের সময়ে আমরা পৌছতে পারি না।
সিএমবি-টা কী জিনিস?
আগে যখন অ্যান্টেনা বসিয়ে টিভি চালানো হত, তখন আমরা হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় টিভি স্ক্রিনে যে ঝিরঝিরে ছবি আর তার শব্দ শুনতে পেতাম, সেটাই সিএমবি। ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের পর প্রথম আলো। দৃশ্যমান আলো ছাড়াও যার আরও তিনটি দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ রয়েছে।
এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির জন্য অত বড় বিস্ফোরণ হল, আর তার কোনও চিহ্ন থাকবে না, তা কি হয়! একটা পুকুরে সামান্য একটা ঢিল ফেললেই তো যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, তা উত্তরোত্তর আরও বড় বড় বৃত্ত তৈরি করে পুকুরের পাড়ে পৌঁছে যায়। আর সেটাও চলে অনেক ক্ষণ ধরে।
‘বিগ ব্যাং’-এর পর পরই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল। পুকুরে ঢিল ফেললে যেমন সঙ্গে সঙ্গেই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনই। কিন্তু, মজাটা হল এখানেই, সিএমবি-টা তৈরি না হলে কখনওই সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব আমরা টের পেতাম না। অনেকটা যেন আমাদের বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা অগণ্য ধূলিকণার মতো। যা সব সময় আমাদের চার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গায়ে এসে পড়ছে। কিন্তু, কতটা ধুলো চার পাশে, তা আমরা বুঝতেই পারছি না। চশমাটা খুলে যেই টেবিলে রাখলেন, অমনি তার কাচে প্রচুর ধুলোবালি এসে জমল। তখনই কিছুটা আঁচ পাওয়া গেল, কতটা ধুলোবালি রয়েছে আমাদের চার পাশে। সিএমবি যেন সেই ‘চশমার কাচ’! আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যেন বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা অগণ্য ধুলোবালি!
বিগ ব্যাং’-এর সেই মহা-বিস্ফোরণের পর যে তরঙ্গের জন্ম হয়েছিল, ১৪০০ কোটি বছর পরেও, এখনও তা ছড়াচ্ছে প্রসারমান ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই তরঙ্গ মিশে রয়েছে ওই সিএমবি-তেই। বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা ধুলোবালির মতোই। সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গেরই হদিশ পাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছিল ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায়, দক্ষিণ মেরুতে। গোটা আকাশের মাত্র এক শতাংশের ওপর টানা পাঁচ বছর ধরে কড়া নজর রেখে।
কিন্তু সেই তরঙ্গ যে রয়েছে, তা কী ভাবে বোঝা যেতে পারে?
তা বোঝা যায় সিএমবি-তে আলোক-কণা বা ফোটনের নাচানাচি দেখে। ফোটন এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে। সিএমবি-তে ওপরে উঠছে। নীচে নামছে। কিন্তু ওই ফোটন কণাগুলোকে কে নাচাচ্ছে? কে দোলাচ্ছে? নদীতে বান এলে পাড়ের কাছে যদি তাতে একটা বড় আর ভারী কাঠের পাটাতন ভাসিয়ে দেওয়া হয়, দেখা যাবে, তা ঢেউয়ের তালে তালে উঠছে, নামছে। এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে। জলের তরঙ্গই সেটা করাচ্ছে। ঠিক তেমনই সিএমবি-তে ফোটন কণাগুলোকে দোলাচ্ছে, নাড়াচ্ছে ওই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। সেই ভাবেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ফোটন কণাদের ওই নড়াচড়াটা যে সিগন্যালে ধরা পড়ে, তাকে বলা হয়, ‘বি-মোড সিগন্যাল’।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তুহিন বলছেন, ‘সেই পরীক্ষায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যে সিগন্যাল পেয়েছিলেন, তার ভিত্তিতেই বলেছিলেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের সরাসরি প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সেই সিগন্যালের মধ্যে যে মিশে থাকতে পারে এই গ্যালাক্সির ধূলিকণা থেকে ঠিকরে আসা আলোক-তরঙ্গও, আর সেটা যে মোটেই নস্যির মতো উড়িয়ে দেওয়ার নয়, অত্যুৎসাহে সেই কথাটাই খেয়ালে ছিল না ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায় জড়িত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। সেই ভুলটাই আমার নজরে পড়েছিল।
তার মানেটা হল, এই গ্যালাক্সির যাবতীয় ধূলিকণাকে ‘ধুলো’ ভেবে উড়িয়ে দিয়েই বড়সড় ভুলটা করে বসেছিলেন ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায় জড়িত বিজ্ঞানীরা!
কিন্তু, তারা কি এত নগণ্য হতে পারে? বিভিন্ন নক্ষত্রের জন্ম, মৃত্যু আর তাদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় যে বিপুল পরিমাণে ধূলিকণার জন্ম হয় গ্যালাক্সিতে, তা যেমন আলোকে শুষে নিতে পারে, তেমনই পারে তাকে প্রতিফলিত করতে। পারে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতেও। সেই ধূলিকণাকে অতটা নগণ্য মনে করলে তো হিসেবে গরমিল হবেই। তা গ্যালাক্সির সর্বত্রই রয়েছে। অন্য গ্যালাক্সিগুলোতেও রয়েছে। আর তা রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। আকারে খুব ছোট হলেও কি সেই ধুলোকে অবহেলা করা উচিত?
তুহিনের কথায়, ‘‘তা ছাড়া মহাকাশ থেকে গোটা আকাশকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহ। আর দক্ষিণ মেরু থেকে শুধুই আকাশের এক শতাংশ দেখা হয়েছিল ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায়। তাই হিসেবের গরমিলটা তো থাকবেই। আরও একটা ভুল ছিল ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায়। মাপা হয়েছিল শুধুই একটা ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গ। কিন্তু, আরও দু’টি ফ্রিকোয়েন্সি রয়েছে। ২২০ গিগাহার্ৎজ আর ৯৫ গিগাহার্ৎজ। ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষায় ওই দু’টি ফ্রিকোয়েন্সির খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি। যা নিয়েছিল ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহ। মহাকাশে। তাই ‘প্ল্যাঙ্ক’ উপগ্রহের পাঠানো হিসেবের সঙ্গে হিসেব মেলাতে পারেনি ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষার ফলাফল।’’
তুহিনের কেরামতি সেখানেই। তিনিই সবার আগে সকলের নজরে এনেছিলেন সেই গরমিল। তাঁর সেই পেপারের শিরোনাম ছিল-‘প্ল্যাঙ্ক ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্টস-২২: ফ্রিকোয়েন্সি ডিপেন্ডেন্স অফ থার্মাল এমিশন ফ্রম গ্যালাক্টিক ডাস্ট ইন ইনটেনসিটি অ্যান্ড পোলারাইজেশন’।
তুহিনের ব্যাখ্যায়, ‘‘এখানে একটা অর্কেস্ট্রার উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে। কোনও কনসার্ট হলে অর্কেস্ট্রা শুনতে গিয়ে কি আমি আপনি সব সময় বুঝে উঠতে পারি গিটার, ড্রাম আর স্যাক্সোফোন কম বেশি জোরে বাজছে কি না? মনে হয়, সবক’টাই বাজছে সমান জোরে।কিন্তু তা বাজছে না। কারও সুরটা চড়া। কারও সুর বাঁধা রয়েছে খাদে। আসলে আমরা অর্কেস্ট্রার ‘অ্যামালগামেশানে’ সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। গ্যালাক্সির ধুলোবালিও তেমনই তিনটি ফ্রিকোয়েন্সিতে তিনটি ‘সুরে গান গায়’! কখনও তার সুর থাকে চড়া। কখনও বা তা নামানো থাকে খাদে। সিএমবি কিন্তু সবক’টি ফ্রিকোয়েন্সিতেই ‘গান গায়’ একই সুরে! ‘বাইসেপ-টু’র গবেষকরা একটি ফ্রিকোয়েন্সিতেই পরীক্ষা চালিয়েছিলেন বলে তাঁদের কানে সুরের ভিন্নতা ধরা পড়েনি। সিএমবি ছেকে তাঁরা যে বি-মোড সিগন্যালটা পেয়েছিলেন, তাকেই তাঁরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছিলেন। আর সেটাই তাঁরা ভুল করেছিলেন।’’
তুহিন আরও চমকে দিয়েছেন ১৯৮০ সালে অ্যান্ড্রু লিন্ডে ও অ্যালান গথের দেওয়া ‘থিওরি অফ ইনফ্লেশনে’রও বড় একটা ভুল ধরে। প্রমাণ করে দিয়েছেন, আদিমতম মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে যতটা দুর্বল হতে পারে বলে ভাবা হয়েছিল (r=.2), তা তার চেয়েও দুর্বল হতে পারে। ৩৬ বছর পর দুনিয়ার তাবৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসকে এ ভাবেই সজোরে নাড়া দিতে পেরেছেন তুহিন। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্যের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বকে নিয়ে নতুন ভাবে ভাবনা-চিন্তা শুরু করার উৎসাহটা উস্কে দিতে পেরেছেন।
এই গ্যালাক্সিতে প্রচুর পরিমাণে জমে থাকা ধূলিকণাকে নস্যির মতো উড়িয়ে দিয়ে হিসেব কষাটা যে উচিত হয়নি ‘বাইসেপ-টু’ পরীক্ষার গবেষকদের, তা সকলের নজরে এনে যেন তুহিনও প্রমাণ করে দিলেন, এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে বারাসতের সন্তানই বা কম কীসে!
সূত্র: বিকাশ পিডিয়া, আনন্দ বাজার