সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের এই দিনে পাবনায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এরপর ২১ বছর বয়সে তিনি নাম লেখান চলচ্চিত্রে। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘শেষ কোথায়’। তবে এটি মুক্তি পায়নি। তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘সাত নম্বর কয়েদী’। একই বছর তাঁর অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়, যেখানে তাঁর নায়ক হন উত্তম কুমার। এর মাধ্যমেই সূচনা হয় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কালজয়ী জুটি উত্তম-সুচিত্রার। ৩০টির বেশি সিনেমায় তাঁরা জুটি বেঁধে কাজ করেছিলেন। সুচিত্রা সেনের জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক তাঁর নন্দিত পাঁচটি চলচ্চিত্র সম্পর্কে।
সাড়ে চুয়াত্তর: ১৯৫৩ সালে নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চলচ্চিত্রটি রুপালি পর্দায় সুচিত্রা সেনের দ্বিতীয় সিনেমা। চলচ্চিত্রটির কাহিনিকার ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। এই চলচ্চিত্রে মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। মুক্তির পরপরই চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে দারুণ হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রটি। বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য এনে দেয় এটি। এর মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্রে শুরু হয় উত্তম-সুচিত্রা জুটির ২০ বছরের রাজত্ব। উত্তম-সুচিত্রা ছাড়াও চলচ্চিত্রটির মুখ্য চরিত্রে আরও অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী। এ ছাড়া ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও সনৎ সিংহ–এই পাঁচজন সমসাময়িক গায়কও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
দেবদাস: ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দেবদাস’ ছিল সুচিত্রা অভিনীত প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র। বিমল রায়ের পরিচালনায় এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার (দেবদাস), সুচিত্রা (পারু) ও বৈজয়ন্তিমালা (চন্দ্রমুখী)। ছবিটির সংগীত পরিচালনায় ছিলেন শচীন দেব বর্মণ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ধ্রুপদি উপন্যাস দেবদাসের পার্বতী জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সুচিত্রার মধ্যে। পারু চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান। ২০০৫ সালে ইন্ডিয়া টাইমস মুভিজ সেরা ২৫ অবশ্যই দর্শনীয় বলিউড চলচ্চিত্র তালিকায় চলচ্চিত্রটি জায়গা করে নেয়।
সাত পাকে বাঁধা: অজয় কর পরিচালিত ১৯৬৩ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘সাত পাকে বাঁধা’। সুচিত্রা সেনের বিপরীতে এতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অর্চনা চরিত্রে অনন্য অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। এই চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস অর্জন করেন তিনি। ভারতীয় অভিনেত্রীদের মধ্যে সুচিত্রাই প্রথম এই সম্মান পান।
উত্তর ফাল্গুনী: উত্তম কুমার প্রযোজিত চলচ্চিত্র ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ১৯৬৩ সালেই মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটিতে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। অসিত সেন পরিচালিত চলচ্চিত্রটিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিকাশ রায়। শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায় এটি। ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি রিমেক হয় ‘মমতা’ নামে। মনীষ চরিত্রে অশোক কুমার এবং ইন্দ্রনীল চরিত্রে ধর্মেন্দ্র অভিনয় করেন। হিন্দি রিমেকেরও পরিচালক অসিত সেন। ১৯৬৬ সালে ‘মমতা’র জন্য সেরা অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান সুচিত্রা। এ ছাড়া চলচ্চিত্রটি ‘কাবিয়া তালাইবি’ নামে তামিলে এবং ‘পুষ্পাঞ্জলি’ নামে মালায়লামে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।
গৃহদাহ: উত্তম কুমার প্রযোজিত ও সুবোধ মিত্র পরিচালিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালে। এই ছবিতেও উত্তম কুমারের বিপরীতে অসাধারণ অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। ছবিটির গল্পে ব্রাহ্ম মেয়ে অচলা অর্থাৎ সুচিত্রা সেনের হাত থেকে বন্ধু উত্তম কুমারকে বাঁচাতে এসে উল্টো নিজেই তার প্রেমে পড়ে যায় সুরেশ; কিন্তু মহিমকেই বিয়ে করে গ্রামে চলে যায় অচলা। সামান্য ঘটনায় তাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। সুযোগটি নেয় সুরেশ। অচলাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে কলকাতায়। শুরু হয় ত্রিমুখী টানাপোড়ন। এই চলচ্চিত্র শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গৃহদাহ’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। এই চলচ্চিত্রে মুখ্য চরিত্রে উত্তম-সুচিত্রা ছাড়াও আরও অভিনয় করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ কুমার।
এই পাঁচটি চলচ্চিত্র ছাড়াও সুচিত্রা সেন অভিনীত উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো ‘সপ্তপদী’, ‘হারানো সুর’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘বিপাশা’ ইত্যাদি। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত করে। এরপর ২০০৫ সালে তাঁকে ভূষিত করা হয় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে। সাফল্যময় অভিনয়জীবনের ২৫ বছর পার করার পর ১৯৭৮ সালে হঠাৎ অন্তরালে চলে যান সুচিত্রা সেন। লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে ব্রতী হন রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায়। ওই অবস্থায়ই ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে মারা যান মহানায়িকা।