বই: যেখানে রোদেরা ঘুমায়
লেখক: শরীফুল হাসান
প্রকাশক: চিরকুট
মুদ্রিত মূল্য: ৪০০/=
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩০৪
প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী
![শরীফুল হাসান](https://www.bangladiary.com/wp-content/uploads/2021/04/sharif-hasan.jpg)
মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কিন্তু এই বদল ঘটে কয়বার? রুপুর শিক্ষক বাবা মারা যাওয়ার পর তার চেনা পৃথিবী বদলে গিয়েছিল। এরপর কৈশোরে বড় ভাইকে অপদস্থ হতে দেখে আরেকবার রূপান্তর ঘটে তার। সাধারণ এক ছেলে ইফতেখার উদ্দীন থেকে হয়ে উঠে রুপু ভাই ওরফে রুপু গুন্ডা। ভাইয়ের নামের দাপটে চলে বিপুও। শুধু এসব স্পর্শ করে না অপুকে। আদর্শ বড় সন্তান হিসেবে সে থাকে তার নিজের জগত নিয়ে। নব্বই দশক। একটা স্বপ্নময় সময়। চারদিকে একটা নেশা ধরানো ঘোর লাগা আবহাওয়া, ভাবালুতা। রাজনীতির হাওয়া বদল, শিল্প আর প্রযুক্তির অগ্রগতি সব মিলিয়ে নতুন একটা গন্ধ বাতাসে। সেই সময়ের স্বপ্নে ঘেরা জগতের ভেতরেই রয়ে গেছে একটা গাঢ় অন্ধকার কোণ। যেখানে রুপু গুন্ডার হাতে অবৈধ সাম্রাজ্যের কলকাঠি। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল সে নিজেও আরেকজনের হাতের পুতুল। শিক্ষিত পাপী জামাল খন্দকার নিজের আখের গোছায় রুপুদের ব্যবহার করে। সমাজে তাদের পরিচয় জনদরদী নেতা। আর রুপুরা হয় সন্ত্রাসী।
ভালো মন্দের এক অদ্ভুত মিশেল এই রুপু। জামাল খন্দকার আর মানিক মিয়ার কাছে সে মানব অস্ত্র। শাহানের চোখে মূর্তিমান মৃত্যু। জামাল খন্দকারের ছত্রছায়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও নিজের এলাকার মানুষ তাকে চোখে হারায়। বন্ধু মিলন আর শফিকের কাছে সে বন্ধু অন্তঃপ্রাণ। আবার অনির মনে সে জায়গা করে নেয় সযতনে। ভালো মানুষ আসলে কাকে বলে? নাকি ভালো মন্দ পুরো বিষয়টাই আপেক্ষিক? সুন্দর একটা পারিবারিক বন্ধনের খোঁজে আর হৃদয়ের বোঝাপড়ায় ব্যাকুল নিবিড় আশ্রয় খোঁজে নেশার জগতে। ক্লাস বাদ দিয়ে সঙ্গী হয় বখাটে আর উঠতি মাস্তানদের। ডায়েরিতে জমে অদ্ভুত সব কবিতা। ভাবনার গভীরতায় বোঝা যায় হয়ত সে কবি হলেও হতে পারত! অনিন্দিতার জগত বাবা আর পড়ালেখা নিয়ে। বান্ধবী কেবল দু’জন। সাতে পাঁচে না থাকা মেয়েটা একসময় জড়িয়ে যায় অদ্ভুত পাকচক্রে। বাবার সাথে জামাল খন্দকারের বন্ধুত্বের মূল্য চোকাতে তাকে গুণতে হয় চরম মাশুল। নব্বই দশকের স্বপ্নময় সময়ের এক টুকরো গল্প উঠে এসেছে ‘যেখানে রোদেরা ঘুমায়’ বইটিতে। মফস্বলে বেড়ে ওঠা এক অদম্য কিশোরের অপরাধ জগতের শীর্ষে ওঠার গল্পকে ছাপিয়ে গেছে একটা সাধারণ ছেলের ভেতরের ছোট ছোট স্বপ্নের গল্প। যে জগতে মায়া, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুর স্থান নেই। যেখানে রোদেরা ঘুমায়, দিন শেষে জোছনা নেমে আসে।
মোটরসাইকেল দাপিয়ে বেড়ানো রুপু পুরোটা সময় জুড়ে মাথায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কখনও গুন্ডা, কখনও বাধ্য ছেলে, কখনও বন্ধু, কখনও দায়িত্বশীল বড় ভাই আবার কখনও প্রেমিক হয়ে। কেন যেন কিছুতেই তাকে খারাপ ভাবা যাচ্ছিল না। নেতিবাচক একটা চরিত্র হয়েও একটা অন্যরকম মায়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পুরোটা গল্পে ক্ষমতা আর রাজনীতির খেলায় মত্ত কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের নোংরা চেহারা বারবার দেখা গেলেও সব ছাপিয়ে বারবার একটা মায়া জড়ানো ঘোর লাগা সময়ই উঠে আসছিল বারবার। পারিবারিক টানাপোড়ন, বন্ধুত্ব বনাম ভালোবাসা, অব্যক্ত হাহাকার, অবহেলা আর অব্যক্ত অনুভূতিরা বারবার হানা দিচ্ছিল অজান্তেই। নব্বই দশকের কিছুটা ছোঁয়া পেয়েছি আমার ছেলেবেলাতে। তাই বইটা পড়ার সময় নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল সব চেনা চরিত্র, চেনা দৃশ্যপট। উন্নয়নের হাওয়া চারদিকে, সেই সাথে চাপা অস্বস্তি। রাজনীতি বনাম সমাজসেবা। স্বার্থ বনাম নিঃশর্ত ভালোবাসা।
বইটার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছি এক হারানো সময়, এক অদ্ভুত ভালো লাগা। শুরুতে শেষটা বোঝায় উপায় নেই, আবার বোঝার পর মনকে বোঝানোর উপায় জানা নেই। পুরোটা ভ্রমণই মুগ্ধতায় জড়ানো। থামার কোনো অবকাশ নেই। চিন্তার গভীরতা নেই। শুধু অনুভূত হবে একটা চাপা বেদনা আর বিশুদ্ধ কিছু আবেগ। ঘোর লাগা সেই সময়টাকে ছুঁতে চাইলে ‘যেখানে রোদেরা ঘুমায়’-এর সাথে যাত্রা শুরু হোক আপনার। চিরকুটের পরিবেশনা বরাবরের মতই সুন্দর। প্রচ্ছদটা বেশ। তবে মুদ্রণ প্রমাদের ব্যাপারে নজরদারি প্রয়োজন।