এরিক রুথ & উইন্সটন গ্রুমের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৯৪ সালে “ফরেস্ট গাম্প” চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। ৬৭ তম অস্কারে ১৪ টি বিভাগে মনোনয়ন এবং ‘সেরা অভিনেতা’ সহ ৬টি বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয়। চলচ্চিত্রটির গল্প, নির্মান, অভিনয় সবকিছুই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক ‘রবার্ট জেমেকিস’। আর, এই মুভির টম হ্যাংকসকে নিয়ে কি বলি বলুন তো? তারথেকে চলুন ফরেস্ট গাম্পের সাথে বেঞ্চ শেয়ার করি।
আজকের প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি চলচ্চিত্র ‘ফরেস্ট গাম্প’ | আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের জীবনে নেওয়া সিদ্ধান্তরাই যে আমাদের জীবনের গতিপথ ঠিক করে দেয়, তার চমৎকার নিদর্শন এই ছবিটি |
যদি দর্শক মনোযোগ সহকারে ছবিটি দেখে থাকেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে ‘ফরেস্ট গাম্প’ শুধুমাত্র ফরেস্টের কাহিনী নয়; ফরেস্ট এই ছবির গল্পের সূত্রধার ও মুখ্য চরিত্র হলেও আসলে এটা দুজন মানুষের জীবনের কাহিনী: ফরেস্ট ও জেনি |
একদিকে ফরেস্ট জন্ম থেকেই জীবনে প্রবল প্রতিকুলতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবার বিজয়ী হিসেবে উত্তীর্ণ হয় কেবলমাত্র নিজের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া নীতিগত শিক্ষা ও মূল্যবোধের জোরে | প্রথম দর্শনে যে ছেলেটাকে দেখে হাবা-গোবা,ন্যাদোস আর মা-ন্যাওটা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না সেই ফরেস্ট তার মায়ের যত্ন-ভালবাসায় বড় হয়ে শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যই লাভ করে না বরং সেই সাথে প্রশংসনীয় মূল্যবোধেরও অধিকারী হয়; কয়েকটি উদাহরণ— জেনিকে সর্বদা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করা, তাকে বিনা প্রতিবাদে চলে যেতে দেওয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সঙ্গীসাথীদের ফেলে পালাতে অস্বীকার করা, মৃত বন্ধুকে দেওয়া কথা রক্ষা করা |
ফরেস্টের মত নিজের মায়ের প্রতি কোনো ছেলে আজ ভক্তি দেখালে আমরা অনেকেই নাক সিঁটকিয়ে তাকে ‘আলালের দুলাল’, ‘মামা’জ বয়’, ‘মায়ের আঁচল-ধরা’ ইত্যাদি বিশেষণে সুসজ্জিত করব | ‘ফরেস্ট গাম্প’ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় একজন যত্নশীল মায়ের সুশিক্ষা কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে |
মায়ের সাথে যুদ্ধ-ফেরত ফরেস্ট
ফরেস্টের মা যে কোনো আধুনিকা মহিলা এমনও নয়; পুরো উল্টোই বরং | মহিলার জীবন সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরনির্ভর, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনপ্রান্তে যা খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য | নিজের ছেলেকেও তিনি অনুরূপ শিক্ষা প্রদান করেছেন, কিন্তু তার জন্য আমরা কি তাকে একবারও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখি? না, কারণ মা হিসেবে তিনি অনন্য; প্রতিটা ছেলে একজন মা হিসেবে যাকে চাইতে পারে, ভালবাসতে পারে তিনি তাই |
উল্টোদিকে জেনি ছোটবেলায় ফরেস্টের মত শারীরিক ও মানসিক প্রতিকুলতার সম্মুখীন না হলেও সে না তো পেয়েছে মায়ের আদর, না পেয়েছে বাবার ভালবাসা | যে বাবা তাকে একটা সুন্দর জীবনের দিকে চালনা করতে পারত সে বদলে তার উপর চালিয়েছে যৌন নিপীড়ন | যার প্রভাব পড়েছে জেনির পরবর্তী জীবনে |
যখন ‘ফরেস্ট গাম্প’ প্রথমবার দেখেছিলাম মনে হয়েছিল ফরেস্ট খুব ভাগ্যবান যে জেনির মত একজনকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছে ও ভালোবেসেছে; পরে যখন আবার ছবিটা দেখি, বুঝতে পারি যে ভুল ভেবেছিলাম | ভাগ্যবান ফরেস্ট নয়, ছিল জেনিই |
ফরেস্টের একটা আশ্চর্য গুণ হলো সে কাউকে জাজ করে না, যার ফলে তার সাথে কোনো অন্যায় হলেও সে রাগ বা ক্ষোভ পুষে রাখে না | জেনি তাকে বারবার ছেড়ে চলে যাওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি ফরেস্টের ভালবাসা একবিন্দু কমে না | কিন্তু ফরেস্টের এই চারিত্রিক গুণ জেনির ক্ষেত্রে হিতে-বিপরীত হয়ে তাকে আরো ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় |
ফরেস্টকে ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে জেনি
জেনির জীবন বস্তুত একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের সমষ্টি; ভাগ্য তাকে বারবার ফরেস্টের কাছাকাছি এনে দিলেও সে তাকে নিয়ে সুখে সংসার করার কথা একবারও ভাবে না | উল্টে হিপিদের সংস্পর্শে এসে মাদকদ্রব্যের আসক্তি ও বেশ্যাবৃত্তির জালে জড়িয়ে পড়ে |
নিজের ও ফরেস্টের প্রতি অনেক অন্যায় ও আত্মহননের ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে জেনির চৈতন্যোদয় হয় ও সে ফরেস্টের কাছে ফিরে আসে, কিন্তু ফরেস্টকে বিয়ে করতে রাজি হয় না | অজ্ঞাত কারণবশত সে ফরেস্টকে আরো একবার ছেড়ে যায় যার ফলস্বরূপ ফরেস্ট পিতা হওয়ার মুহূর্তের আনন্দলাভ থেকে বঞ্চিত হয় |
জেনির গোটা জীবনটাই তার অসুস্থ শৈশবের স্বাক্ষর; একদিকে দিকভ্রান্ত হয়ে সে নিজে যেমন ভুগেছে সারা জীবন, অন্যদিকে তেমনই ফরেস্টের মত একজন চরিত্রবান ও বিশ্বস্ত প্রেমিককে সে মূল্য দিতে পারেনি |
ফরেস্ট গাম্প ছবির কয়েকটি সংলাপ যা আপনাকে বিমোহিত করে তুলবে
“হ্যালো আ’য়াম ফরেস্ট, ফরেস্ট গাম্প! চকলেট খাবে? আমার মা সবসময় বলতো, জীবনটা একটা চকলেট বক্স এর মতো, ভেতরে কী আছে জানতেই পারবে না!”
বাস স্টপের বেঞ্চে বসে ফরেস্ট তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করলো…
পাশে বসা মেয়েটা অবাক হয়ে তাকালো বোকাবোকা মানুষটার দিকে— পাগল নয়তো? ফের ম্যাগাজিনে নাক ডুবিয়ে দিলো সে। কিন্তু বেঞ্চে বসা ফরেস্টের সেদিকে খেয়াল কোথায়! সে আপনমনে বলে চলেছে তার গল্প।
ফরেস্ট গাম্প— মাত্র ৭৫ আইকিউ সম্পন্ন একজন পরিষ্কার স্লেটের মত মানুষ- ভদ্র, সদয়; কিন্তু ক্ষীণ বুদ্ধি সম্পন্ন। ঠিকমতো হাঁটতে পারতো না বলে লেগ ব্রেস পড়তে হতো। মা ছাড়া আর কোনো বন্ধু ছিল না তার। তার মা তাকে সবসময় শেখাতো,
“প্রত্যেকের জীবনই ভাগ্যের সুতোয় গাঁথা”।
সে তার জীবনের কাহিনী বলে চলেছে। অদ্ভুত সে কাহিনী। প্রেমে পড়ার কাহিনী, বন্ধুত্বের কাহিনী, ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাহিনী, মাছ ধরার কাহিনী, জেনিকে বারংবার পেয়েও হারানোর কাহিনী। জীবনের প্রতিটি মোড়ে তাকে একটা কথাই শুনতে হয়েছে-
“Run Forrest, Run.”
“প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর জীবনের সেসব সীমাবদ্ধতাকে কিভাবে জয় করে বাঁচতে হয়, কঠিনতম সব পরিস্থিতি থেকে কিভাবে নিজেকে পার করতে হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করার পরেও কিভাবে অন্যান্য কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা যায়
You can live aimless. Life is like a box of chocolates, you never know what you’re gonna get..so, run.
‘ফরেস্ট গাম্প’ মূলত আমাদের জীবনে পারিবারিক বন্ধন, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের গুরুত্বের উপর একটা কমেন্ট্রি | আজকের প্রজন্ম ফরেস্টের দৃষ্টি দিয়ে দুনিয়াটাকে হয়ত দেখে না, কিন্তু তাতে এই জিনিসগুলির মূল্য আদৌ কমে যায় না | আমরা কেউ স্বয়ম্ভূ নই; একটা ভালো শৈশব আমাদের সকলেরই প্রয়োজন |