বলা হয়ে থাকে, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য জীবনভর চেষ্টা করেছেন, পৌঁছেছেন সাফল্যের চূড়ায়। পাবনার আতাইকুলা গ্রামের সামান্য একটি ওষুধের দোকান থেকে গড়ে তুলেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপ। তিনি স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী ! স্যামসন এইচ চৌধুরী বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি উদ্যোক্তা ছিল . তার নতুনত্ব , নেতৃত্ব এবং অধ্যবসায় দিয়ে গোড়া থেকে একটি ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। স্বপ্ন আর চেষ্টায় বড় হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্যামসন এইচ চৌধুরী। নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকার অদম্য স্পৃহা তার প্রতিষ্ঠিত স্কয়ার শুধু দেশসেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে তোলেননি, পণ্যমানে জয় করেছে বিশ্ব ক্রেতার মনও। তার আদর্শ, নীতিবোধ, ত্যাগ, মহানুভবতা এবং সেবামূলক নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ তাকে উপলব্ধি করেন, তাকে স্মরণ করেন।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন
স্যামসন এইচ চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলায়। তার বাবা ইয়াকুব হোসাইন চৌধুরী ও মা লতিকা চৌধুরী। তার স্ত্রীর নাম অনিতা চৌধুরী। তার তিন ছেলে – অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী ।
ভারতে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫২ সালে পাবনা জেলার আতাইকুলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। তার পিতা ইয়াকুব হোসেন ছিলেন একটি ফার্মেসির মেডিকেল অফিসার। তাঁর স্ত্রীর নাম অনিতা চৌধুরী। তাঁর তিন ছেলে – অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী ও স্যামুয়েল চৌধুরী
শিক্ষাজীবন
শিক্ষাজীবন কেটেছে বারবার ঠিকানা বদলের মধ্য দিয়ে। বাবার চাকরির সূত্রে পড়তে হয়েছে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে। কখনো উন্নত ও আধুনিক শিক্ষার সন্ধানে পরিবারের ইচ্ছায়ও যেতে হয়েছে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে। কৈশোরেই পুরো স্বপ্নচারী হয়ে ওঠেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। বাবার বদলি চাঁদপুর মিশন হাসপাতালে হওয়ায় শিশু স্যামসনের স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল চাঁদপুর মিশন স্কুলে। কয়েক বছর পরেই চাঁদপুর থেকে পাবনায় বদলি হন তার বাবা, সঙ্গে স্কুলও বদল হয় শিশু স্যামসনের। ভর্তি হন আতাইকুলায় এক গ্রাম্য স্কুলে। এক বছরের মাথায় উন্নত শিক্ষার খোঁজে বাবা-মা তাকে পাঠান ময়মনসিংহের ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুলে। সেখানে দুই বছর পড়াশোনার পর ১৯৩৫ সালে কলকাতা চলে যায় তার পরিবার। তখন স্যামসন ভর্তি হন বিষ্ণুপুরে শিক্ষাসংঘ হাইস্কুলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কারণে ১৯৪২ সালে নিজ গ্রামে ফেরে স্যামসনের পরিবার। আতাইকুলা হাইস্কুলে নতুন করে ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯৪৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৩০-৪০ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার বিষ্ণুপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এখান থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি স্কুল থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
স্যামসন এইচ চৌধুরীর বাবা ছিলেন আউটডোর ডিসপেনসারির মেডিক্যাল অফিসার। বাবার পেশার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ঔষুধ নিয়ে তিনি নাড়াচাড়া করেছেন। ভারত থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে ফিরে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনার আতাইকুলা গ্রামে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে চিন্তাভাবনা করে তিনি ‘ফার্মেসি’কেই ব্যবসায় হিসেবে বেছে নিলেন; গ্রামের বাজারে দিলেন ছোট একটি দোকান। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট সরকার তখন ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে পেয়ে যান ওষুধ কারখানা স্থাপনের একটা লাইসেন্স। তিনিসহ আরো তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলে প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকায় পাবনায় কারখানা স্থাপন করলেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। স্কয়ারের নামকরণও করা হয়েছিল চার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাই এর লোগোও তাই বর্গাকৃতির। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মরত। শুধু ঔষুধেই নয়, এই শিল্প গ্রুপের ব্যবসায় সম্প্রসারিত হয়েছে প্রসাধনসামগ্রী, টেক্সটাইল, পোশাক তৈরী, কৃষিপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি মিডিয়াতেও। তিনি দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙার চেয়ারম্যান ছিলেন। স্কয়ার গ্রুপ ২০০৯-১০ অর্থবৎসরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সেরা করাদাতা নির্বাচিত হয়েছিলো।
বয়স তখন মোটে ১৭, স্বপ্ন দেখতেন ভালো কিছু করার, দেশের মানুষের সেবা করার। সেই স্বপ্ন থেকেই কাউকে কিছু না বলে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ছাড়েন, আশ্রয় নেন কলকাতার এক আত্মীয়র বাসায়। কদিন পরই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন ভবিষ্যতের সন্ধানে। বড় শহর মুম্বাইয়ে নোঙর ফেলে করতে থাকেন চাকরির সন্ধান। সেখানেই সুযোগ হয় নৌবাহিনীতে পরীক্ষা দেওয়ার, কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। দায়িত্ব পান সিগন্যাল বিভাগে। আবেদন করলেন ‘রাডার অপারেটর’ হওয়ার। অন্য কোথাও কাজ করতে নারাজ তিনি। অদম্য ইচ্ছা, আপসহীন মানসিকতা আর একরোখা জেদের কারণে চার দিন জেলে থাকতে হলো তাকে। চার দিনের প্রতিদিন সকালে ঊর্ধ্বতনরা এসে স্যামসনকে প্রশ্ন করতেন, অন্য কোথাও কাজ করবে কি না, অনড় থাকলেন স্যামসন। তার ইচ্ছার কাছে হেরে পঞ্চম দিনে রাডার বিভাগে নিয়োগ দিতে বাধ্য হলো। নৌবাহিনীতে তিন বছরের চাকরি জীবনে কিছু সহকর্মীর সঙ্গে তিনি ফেরেন মাদ্রাজের বিশাখাপত্তম বন্দরে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নৌ-বিদ্রোহে যোগ দিয়ে ফের পাঁচ দিনের কারাবাস ভোগ করতে হয় স্যামসনকে। পরে স্যামসনকে সরকারের অন্য কোনো দপ্তরে নিয়োগের সুপারিশ করে নৌবাহিনী। তাতে রাজি না হয়ে ১৯৪৭ সালে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফেরেন পলাতক ছেলেটি। নতুন চাকরি নিয়ে যোগ দেন সরকারের ডাক বিভাগে।
২২ বছর বয়সে ১৫ বছরের কিশোরী অনীতা চৌধুরীকে বিয়ে করেন স্যামসন। তাদের তিন ছেলে-এক মেয়ে— অঞ্জন চৌধুরী, তপন চৌধুরী, স্যামুয়েল চৌধুরী ও রত্না পাত্র। ১৯৫২ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। তখন থেকে বাবার ইচ্ছায় নিজেদের ডিসপেনসারিতে বসতে শুরু করেন, হাতেখড়ি হতে থাকে ব্যবসার। স্বপ্নচারী স্যামসন একটি ওষুধ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বপ্নপূরণে বাবার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিলেন ১৯৫৬ সালে। কারখানা গড়ে তোলেন, নাম দেন ই-সনস (ইয়াকুব হোসেন অ্যান্ড সনস)। সিরাপ উৎপাদন শুরুর মধ্যে বড় ব্যবসায়ী হওয়ার পথে প্রথম পা রাখেন স্যামসন। দুহাতে একাই করতেন মালিক, শ্রমিক, পরিবেশক ও বাজারে পৌঁছানোর কাজ। একমাত্র সহযোগী ছিলেন স্ত্রী অনীতা।
স্কয়ার প্রতিষ্ঠা
১৯৫৮ সালে তিন বন্ধু মিলে স্কয়ার প্রতিষ্ঠা করেন। এর পেছনেও কাজ করেছে স্যামসনের দূরদর্শী ভাবনা। দেশ ভাগের আগে পাবনায় একজন ফার্মাসিস্ট ছিলেন, যিনি ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করতেন। দেশভাগের সময় তিনি ভারতে চলে গেলে তার ফার্মেসি একজনে কিনে নিয়ে ‘এডরুক’ নামে পরিচালনা শুরু করেন। এটি দেখে কোম্পানি করার ভাবনা মাথায় আসে স্যামসনের। শুরুতে বন্ধু ডা. কাজী হারুনার রশিদের সঙ্গে আলাপ করে তাকে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিলেন, রাজি হলেন বন্ধু। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে উদ্যমী স্বভাবের স্বপ্নবাজ যুবক স্যামসন চৌধুরী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন দত্তের কাছে গেলেন একটি আবদার নিয়ে। চাইলেন ওষুধ কারখানা স্থাপনের লাইসেন্স এবং পেয়েও গেলেন। পরে কাজী হারুনার রশিদসহ আরও দুই বন্ধু ডা. পি কে সাহা ও রাধা বিনোদ রায়কে সঙ্গে নিয়ে চারদ-ের ওপর গড়ে উঠল নতুন কোম্পানি ‘স্কয়ার’। চারজন অংশীদারের সমান মালিকানায় শুরু হয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের কর্মযজ্ঞ। স্কয়ারের নামকরণ প্রসঙ্গে স্যামসন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এটি চার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া আমাদের চার হাত সমান। এর লোগোও তাই বর্গাকৃতির।’ আর এ কারণেই এই কোম্পানির নাম স্কয়ার। যাত্রাকালে স্কয়ারের পুঁজি ছিল মোটে ১৭ হাজার টাকা। পরে প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে ৮০ হাজার টাকা লগ্নি করেন এতে। তিন বছর লোকসানে শাখা কোম্পানিটি প্রথম লাভের মুখ দেখে চতুর্থ বছরে গিয়ে। ১৯৬২ সালে ঢাকায় কোম্পানির প্রথম শাখা অফিস হলো। ইটের পর ইট গেঁথে যেভাবে বড় অট্টালিকা নির্মাণ হয়, সেভাবেই নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগোতে থাকে স্কয়ার। সেই স্কয়ার এখন দেশের ওষুধ খাতের আইকন। স্কয়ারকে তিনি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানির তালিকায়ও শীর্ষে উঠে এসেছে।
ব্যবসা মানেই মুনাফা এ ধারণাকে অনেকটাই ভুল প্রমাণ করেছে স্যামসন এইচ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্কয়ার গ্রুপ। এ কথার সঙ্গে দ্বিমত তার চরম প্রতিপক্ষও করবেন না। ‘আমার কাছে কোয়ালিটিই সবার আগে। সব পর্যায়েই আমরা কোয়ালিটি নিশ্চিত করি।’ বলতেন কোয়ালিটিম্যান স্যামসন চৌধুরী। তার প্রমাণও রেখে গেছেন স্কয়ার ব্র্যান্ডিংয়ের সব পণ্য আর সেবায় এই কর্মবীর। তার এই গুণের বলেই ১৯৫৮ সালের সেই ছোট উদ্যোগ বিশাল গ্রুপে পরিণত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বিশালত্বের পথে পা ফেলে স্কয়ার। ওই বছর কয়েকটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে স্কয়ারকে সম্পূর্ণ আধুনিক রূপ দিলেন স্যামসন চৌধুরী। তৈরি হতে থাকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ। ১৯৮৭ সালে স্কয়ার প্রথম তাদের তৈরি ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাজারে শেয়ার ছাড়ে। ব্যবসার গ-ি বাড়তে থাকে স্কয়ারের। অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে ব্যবসা বড় করতে গিয়ে মানে কখনো চুল পরিমাণ ছাড় দেননি স্যামসন। ১৯৯৬ সালে স্কয়ার ফার্মার একটি অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ বাজারে বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্যামসন এইচ চৌধুরী ওই সময়ে আমেরিকা সফরের একপর্যায়ে সেখানে একটি মেডিকেল জার্নালে ওই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তাদের দ্রুত ওষুধটির উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধের পাশাপাশি মজুদ সমুদয় কাঁচামাল ধ্বংসের নির্দেশ দেন। সে সময় কোম্পানিতে কয়েক লাখ টাকার কাঁচামাল মজুদ ছিল। তার নির্দেশ পেয়ে কোম্পানির কর্মকর্তারা সমুদয় কাঁচামাল ধ্বংস করেন এবং ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেন। তার অতি ঘনিষ্ঠজন লেখক ড. ডেনিস দিলীপ দত্ত বলেন, ৪০ বছর আগে আমি যখন তার কাছ থেকে চার্চের সেবা কাজের দায়িত্বগুলো ক্রমে ক্রমে গ্রহণ করছিলাম, তখন তিনি জন এফ কেনেডির একটি ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে ও আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেনÑ সেবাদানের মাধ্যমে দেশ ও দশের কল্যাণমূলক কার্যসূচি গ্রহণ করতে। তিনি তার কর্মচারীদেরও বঞ্চিত করেননি। জীবিত থাকতে ৩৩ হাজার কর্মচারীর জন্য প্রতিদিন দুপুরের খাবার, ভাতা, আকর্ষণীয় বোনাস চালু করে দিয়ে গেছেন, যা এখনো বহাল আছে। তিনি তাদের সমস্যার কথা শুনতেন, চাহিদাগুলো পূরণ করতেন। তাই তারা কখনো ধর্মঘট করেননি।
ব্যবসা ও বিপণনে সাফল্যের জন্য কোনো বিশেষ কৌশল প্রসঙ্গে স্যামসন চৌধুরী বলতেন, ‘আমি সব সময় স্বপ্ন দেখেছি বিশ্বের নামিদামি ওষুধ কোম্পানির আদলে গড়ে উঠুক স্কয়ার; যেখানে নিয়মিত গবেষণা হবে, উন্নয়ন হবে, কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ থাকবে সব পর্যায়ে। এখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হোয়াইট-কলার জব। তাদের সবাই গুণ-মান বজায় রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট, প্রশিক্ষিত। আমরা একটা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছি। আমাদের ওষুধের কোয়ালিটি আজ দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। ডাক্তাররা অবিচল আস্থার সঙ্গে আমাদের ওষুধ প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর ৫০টি দেশে আমাদের ওষুধ যাচ্ছে।’
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে সাফল্যের পর ব্যবসা বাড়াতে মনোনিবেশ করেন স্যামসন। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্কয়ার টয়লেট্রিস’। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড। এর কয়েক বছর পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘অ্যাগ্রো কেমিক্যালস ভেটেরিনারি’ ইউনিট খোলা হয়। স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসায়িক দক্ষতায় কয়েক বছরের মধ্যেই একে একে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার স্পিনিং লিমিটেড, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস লিমিটেড, স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্ট লিমিটেড, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিকস এবং স্কয়ার হাসপাতালের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান। তিনি কখনো ঋণখেলাপি ছিলেন না। পুঁজিবাজারে কোনো নয়ছয় করেননি। তার প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন অজাতশশ্রু ও দানবীর। অসংখ্য ছাত্র, দরিদ্র, অনাথ তার সহানুভূতি পেয়ে নতুন জীবন পেয়েছে। পাবনায় অনীতা-স্যামসন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিনা মূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের স্থায়ী ব্যবস্থা করে গেছেন তিনি। জীবদ্দশায় স্যামসন চৌধুরী অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তার কীর্তির জন্য বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ২০০৭ ও ০৮ সালে পর পর দুই বছর দেশের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০০৫ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্র্তৃক সেরা করদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পান। ২০০৯ ও ১০ সালে সিআইপি মনোনীত হন।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের এখনকার টার্গেট বিদেশে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যে এরইমধ্যে কেনিয়ায় কারখানা তৈরি করছে কোম্পানিটি। চলতি বছরের শেষ নাগাদ কেনিয়ার কারখানায় ওষুধের উৎপাদন শুরু করতে চায় স্কয়ার। এর মাধ্যমে কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার ছয়টি দেশের ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের ওষুধের বাজার ধরতে চান তারা। ১৯৮৭ সালে স্কয়ার প্রথম তাদের তৈরি ওষুধ বিদেশে রফতানি করে। নব্বই দশকের শুরুতে কোম্পানিটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে বাজারে শেয়ার ছাড়ে। ১৯৫৮ সালের সেই ছোট উদ্যোগই আজকের স্কয়ার গ্রুপ ।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ প্রতিষ্ঠা
১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করে ‘স্কয়ার টয়লেট্রিজ’। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন স্পিনিং মিল করার সিদ্ধান্ত নেয় স্কয়ার। বর্তমানে গাজীপুর, ময়মনসিংহের ভালুকা ও হবিগঞ্জে স্কয়ারের বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্কয়ার টেক্সটাইল লিমিটেড। দুই যুগের ব্যবধানে স্কয়ার বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ বস্ত্রকল। কয়েক বছর পর স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘অ্যাগ্রো কেমিক্যালস ভেটেরিনারি’ ইউনিট খোলা হয়। স্যামসন চৌধুরীর ব্যবসায়িক দক্ষতায় কয়েক বছরের মধ্যেই একে একে যাত্রা শুরু করে স্কয়ার স্পিনিং লিমিটেড, স্কয়ার নিট ফেব্রিকস লিমিটেড, স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্ট লিমিটেড, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, স্কয়ার ইনফরমেটিক্স এবং স্কয়ার হসপিটাল। পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতাল বর্তমানে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। তবে সেই মুনাফা উদ্যোক্তারা নেন না। পুনর্বিনিয়োগ করেন। এমনকি নিজেরাও এ হাসপাতালে নগদ অর্থ দিয়ে চিকিৎসা নেন। বর্তমানে ভোগ্যপণ্য, বস্ত্র, মিডিয়া, তথ্যপ্রযুক্তি, হাসপাতাল, নিরাপত্তা সেবা, ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স, হেলিকপ্টার সার্ভিস ও কৃষিপণ্য খাতে তাদের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০টি। বর্তমানে কর্মী রয়েছে ৫৫ হাজারের বেশি।
স্কয়ারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান:
১. স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস
২. স্কয়ার টেক্সটাইলস
৩. স্কয়ার ফ্যাশনস
৪. স্কয়ার ইয়ার্ন
৫. স্কয়ার হেস্ককন
৬. স্কয়ার হসপিটাল
৭. স্কয়ার টয়লেট্রিজ
৮. স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ,
৯. স্কয়ার সিকিউরিটিজ ম্যানেজমেন্ট
১০. ফার্মা প্যাকেজেস
১১. মিডিয়াকম
১২. স্কয়ার এয়ার
১৩. স্কয়ার ইনফরমেটিকস
১৪. এজেস সার্ভিস
১৫. স্কয়ার ফ্যাশন ইয়ার্ন
১৬. মাছরাঙা কমিউনিকেশনস
১৭. স্কয়ার অ্যাগ্রো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রসেসিং,
১৮. সাবাজপুর টি কোম্পানি
১৯. স্কয়ার ডেনিম এবং
২০. স্কয়ার অ্যাপারেলস।
এছাড়া বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্কয়ার গ্রুপের অংশীদারিত্ব রয়েছে।
সম্পৃক্ততা
চেয়ারম্যান, স্কয়ার গ্রুপ
চেয়ারম্যান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ
চেয়ারম্যান, এস্ট্রাস লিমিটেড
সম্মানিত সদস্য, কুর্মিটোলা গল্ফ ক্লাব
সাবেক চেয়ারম্যান, মাইক্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজ ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস (মাইডাস)
চেয়ারম্যান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার, ২০০৪-২০০৭
সভাপতি, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি, ঢাকা (১৯৯৬-১৯৯৭)
সহ-সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ
সাবেক পরিচালক, দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)
সদস্য, নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ ফ্রান্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি
পরিচালক, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ
চেয়ারম্যান, সেন্ট্রাল ডিপোজিটোরি এজেন্সি অব বাংলাদেশ
সদস্য, উপদেষ্টা, কমিটি অব দ্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ড্রাস্ট্রিস
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
দেশের বেসরকারি খাতে শিল্প স্থাপন, পণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতির আয় বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার কারণে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার ৪২ জন ব্যক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সিআইপি (শিল্প) নির্বাচন করে। তন্মধ্যে বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর ১৮ জনের মধ্যে একজন ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী।
দ্য ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল প্রদত্ত বিজনেসম্যান অব দ্য ইয়ার (২০০০)
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম) বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার (১৯৯৮)
একুশে পদক, ২০১৩
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই স্যামসন এইচ চৌধুরী তার সন্তানদের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সে সময় তিনি নিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পক্ষে সহযোগিতা আনার জন্য তৎপর ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় ভারতে রিলিফ ক্যাম্পে খাদ্য সরবরাহ করেছেন স্যামসন। বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠনে সিসিডিবি গঠন, আরিচা-ভোলা-পটুয়াখালী-বরিশালের মৎস্যজীবীদের জাল, নৌকা, কোল্ড স্টোর প্রদান, মহেশখালীতে সাগর মৎস্যজীবী, নরসিংদীতে তাঁতিদের পুনর্বাসন, রাজশাহীতে ১২ মিলিয়ন ডলারের কৃষি প্রকল্প, বাংলাদেশ সরকারকে দূরপাল্লার ওয়াকিটকি ও বার্জ প্রদান এবং বরিশাল ও গোপালগঞ্জে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের ইপি প্রকল্প প্রণয়ন এসব অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
শ্রদ্ধা ও সমাধি
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুরের র্যাফেল হাসপাতালে মারা যান তিনি। পাবনার কাশিপুরস্থ খামারবাড়ী এস্ট্রাসে স্যামসন এইচ চৌধুরীকে সমাহিত করা হয়। সমাহিত করার পূর্বে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। সমাহিত করার মূহুর্তে পরিবারের সকল সদস্যবৃন্দসহ স্কয়ার পরিবারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পাবনার মানুষের আপনজন স্যামসন এইচ চৌধুরীকে তারা আজও ভুলতে পারেননি। পথিক এখনও অ্যাস্ট্রাসের পাশে গিয়ে থমকে দাঁড়ান, নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। আত্মীয়স্বজনের মতো কর্মচারীরা এমনকি পাবনাবাসীও নীরবে চোখের পানি ফেলেন।
সমাজসেবায় এক অনন্য মানবিক ছিলেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। নীরবে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। আত্মপ্রচার একেবারেই পছন্দ করতেন না। সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাবনার ঐতিহাসিক অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। অসাধারণ সৌজন্যবোধ ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি ছিলেন সব মানুষের অতি প্রিয়ভাজন। তার চলনে-বলনে-কথনে ছিল মাধুর্য। তেমনি পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। মানবিক গুণাবলি, সফল উদ্যোক্তা, কর্মীবান্ধব মনোভাব এক অনন্য উচ্চতায় স্থান করে নেন স্যামসন। কীর্তিমানদের মৃত্যু নেই । তার আদর্শ, নীতিবোধ, ত্যাগ, মহানুভবতা ও সেবামূলক নানামুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ তাকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন, তাকে স্মরণ করেন।