৭১১ সাল; জলদস্যুদের দ্বারা এক মুসলিম নারী নির্যাতিতা হয়ে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসূফের নিকট এক মর্মস্পর্শী পত্র লিখলেন। নির্যাতিতা ঐ নারীর পত্র হাতে পাওয়ার পর হাজ্জাজ বিন ইউসূফ সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট অভিযোগ জানালেন। জলদস্যুদের উপর তার কোনো প্রভাব নেই, কাজেই এক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই- এমন একটি পত্র রাজা দাহির হাজ্জাজ বিন ইউসূফকে লিখে পাঠালেন। হাজ্জাজ বিন ইউসূফ এই পত্রটি পেয়েই ভারতবর্ষে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমে দুটি অভিযান ব্যর্থ হলেও তাঁর নিজ ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাশিম ভারত অভিযান চালিয়ে সফল হন। ৭১২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু দখল করে নেন। এর পর থেকে পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের সাথে উত্তর ভারতের রাজপুত রাজ্যগুলোর যুদ্ধ লেগেই থাকতো, যার ফলে ধীরে ধীরে উত্তর ভারতে মুসলিম সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। এদিকে আরব বিশ্বের সাথে বাণিজ্যের সুবাদে তারও বহু আগে দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আরবদের বসবাস শুরু হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে পুনরায় ইসলাম প্রচার শুরু হলে এসব আরবদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এসব আরব মুসলিমদের দ্বারা দক্ষিণ ভারতে বাহমানি সালতানাত আর দাক্ষিনাত্য সালতানাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে তুর্কীরা সাবেক রাজপুত ভূখন্ডগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেন দিল্লী সালতানাত। একে একে মামলুক দাস বংশ, খিলজী রাজবংশ, তুঘলক আর লোদি বংশের ধারাবাহিকতায় মুঘল রাজবংশের হাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা এসে পৌঁছায়।

১১৯১ সালে ত্বরাইনের প্রথম যুদ্ধে রাজপুত বীর পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে শোচনীয় পরাজয় আর ১১৯২ সালে ত্বরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতের উপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২০৬ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মুহাম্মদ ঘুরীর সাম্রাজ্য তাঁর বিশ্বস্ত সব সেনাপতির মাঝে ভাগ হয়ে যায়। দিল্লীর শাসনভার লাভ করেন কুতুবউদ্দীন আইবেক নামক এক তুর্কী মামলুক সেনাপতি। তিনিই ভারতের দিল্লী সালতানাতের দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১২০৬ থেকে ১২১০ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লী শাসন করেছিলেন। ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মারা যান।

কুতুবউদ্দীন আইবেকের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় আরাম শাহ সিংহাসনে বসেন। কুতুবউদ্দীন আইবেকের সাথে আরাম শাহর কী সম্পর্ক ছিলো তা স্পষ্ট না। তবে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজসভার ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেছেন, আরাম শাহ ছিলেন কুতুবউদ্দীন আইবেকের ভাই। আরাম শাহ সিংহাসনে বসে অবশ্য স্বস্তি পাননি। সে সময় দিল্লীর রাজসভার অভিজাত প্রায় ৪০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল ছিলো, যাদের একত্রে বলা হত ‘চিহালগানি’। এই চিহালগানি আরাম শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই একমত হয়েছেন যে, কুতুবউদ্দীন আইবেকের মৃত্যুর পর দিল্লীর আশেপাশে যোগ্য কেউ না থাকায় আরাম শাহকেই সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু শীঘ্রই আরাম শাহ রাজ্য চালনায় তাঁর অযোগ্যতা প্রদর্শন করতে থাকেন। আর তাই চিহালগানি আরাম শাহের পরিবর্তে বাদাউনের গভর্নর শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশকে সিংহাসনে বসাতে চাইলো। ইলতুৎমিশ সানন্দে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে দিল্লী অধিকার করলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে ইলতুৎমিশ বেশ সাহসী আর যোগ্য শাসক ছিলেন। ১২১১ থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লী শাসন করেছিলেন। এ সময় তাকে বেশ কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়েছিলো, তিনি দক্ষতার সাথে সেসব প্রতিহত করেন। এমনকি কুখ্যাত মোঙ্গল বাহিনীর সাথেও তাকে কয়েকবার লড়াই করতে হয়েছিলো। শাসনক্ষমতার শেষদিকে এসে ইলতুৎমিশ তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। তাঁর পরে সিংহাসনে বসার মতো একমাত্র যোগ্য ছিলেন তাঁর বড় পুত্র। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ায় ইলতুৎমিশকে বিকল্প উপায় ভাবতে হচ্ছিলো। এক্ষেত্রে তাঁর সামনে তাঁর কন্যা সুলতানা রাজিয়া ছাড়া আর কেউ ছিলো না। কারন তাঁর অন্যান্য ছোট পুত্রের কেউই রাজ্য চালনার জন্য উপযুক্ত ছিলো না। সুলতান ইলতুৎমিশ তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।

সুলতানা রাজিয়ার জন্মকাল ও দিল্লির মসনদে শাসনের অধ্যায়-

১২০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সী নারী। সুলতানা রাজিয়া ছিলেন সুলতান ইলতুতমিশের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। তিনি একাধারে একজন ভাল প্রসাশক ও সেনাপতি ছিলেন। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈন্য হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সুলতান ইলতুতমিশের সবথেকে যোগ্য পুত্র সুলতানের জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করলে সুলতান তার কন্যা রাজিয়া কে দিল্লির শাসক হিসেবে মনোনিত করে যান। যখনই ইলতুতমিশের রাজধানী ছাড়তে হত, তিনি তখন তার কন্যা রাজিয়াকে শাসনভার বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন। রাজিয়া ছিলেন সুলতানের জ্যেষ্ঠা কন্যা, বুদ্ধিমতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পটু।

সুলতানা রাজিয়া
ছবি: tarangabarta.com

রাজনীতি আর যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অবস্থা এমন হয়েছিল যে হেরেমের সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগই ছিলো না। হেরেমের রীতিনীতিও তেমন একটা জানতেন না রাজিয়া! এই নিয়মগুলো কখনোই অনুসরণ করতে বাধ্য ছিলেন না রাজিয়া। তিনি কখনই তার চারপাশের মহিলাদের মধ্যে ভীতু এবং সংরক্ষিত আচরণে প্রভাবিত হননি। রাজিয়া তার বাবাকে রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনায় সরাসরি সহযোগিতা করতেন। তার মেধা, প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্রীয় কাজে দক্ষতা দিয়ে বাবা ইলতুৎমিশের প্রিয় হয়ে উঠেন।

সুলতান ইলতুতমিশের মৃত্যুকালে তিনি তার মেয়ে রাজিয়া সুলতানাকে নিজ উত্তরসূরি ঘোষণা করে গেলেও তুর্কি সভাসদগণ একজন নারীকে দিল্লির সুলতানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিল না। অনেক তুর্কি অভিজাতদের মধ্যে ঈর্ষা ছড়িয়ে গিয়েছিল যে একজন মহিলা সুলতান পুরুষ যোদ্ধা এবং সম্ভ্রান্ত লোকদের কাছে অপমান। তাই তারা রাজিয়াকে বাদ দিয়ে রাজিয়ার সৎ ভাই রুকনুদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু শাসক হিসেবে ফিরোজ ছিল অত্যন্ত অযোগ্য, শাসনকার্য পরিচালনা করার বদলে তিনি বরং বিলাসিতায় দিন কাটানো শুধু করেন।

পর্দার আড়াল থেকে দিল্লির রাজকার্যের আসল কলকাঠি নাড়ছিল তার মা শাহ তুরকান। ফলশ্রুতিতে যে সভাসদরা আগে ফিরোজকে সিংহাসনে বসিয়ে ছিল তারাই এবার ফিরোজের অদক্ষতায় বিরক্ত হয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তাকে এবং তার মাকে হত্যা করে। ফিরোজকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আর কোনো উপায় না দেখে এবার সভাসদদেরা অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও গত সুলতান ইলতুতমিশের ইচ্ছা রাখে এবং রাজিয়াকে দিল্লির শাসনকর্তা ঘোষণা করে।

মামলুক রাজবংশের ইতিহাসে কখনও ‘সুলতান’ উপাধি ছিল না বা কোনও মহিলাকে সম্বোধন করত কারণ কোনও মহিলা এর আগে কখনও শাসন করেনি। রাজিয়া তাকে ‘সুলতানা’ বলে সম্বোধন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সুলতানা মানে “সুলতান (শাসক) এর স্ত্রী বা উপপত্নী। এবং তিনি গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে তাকে “সুলতান” হিসাবে সম্বোধন করা হবে, কারণ তিনি নিজেও কারও চেয়ে দ্বিতীয় নন। আসলে, তিনি সর্বোচ্চ ছিলেন।

১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে বসেন। রাজিয়া একজন বিচক্ষণ ও দক্ষ শাসক ছিলেন। তার সময়ে দাসবংশের শাসনকাল খুব সুদৃঢ় হয় এবং রাজ্যের সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করে। তার সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধিত হয়। তিনি যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেন। রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষ লাগানো হয় এবং পানি সরবরাহের জন্য অসংখ্য কুয়ো খনন করা হয়। তিনি সাহিত্যিক, শিল্পী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তার শাসনামলে সঙ্গীত ও চিত্রকলারও প্রভূত বিকাশ সাধিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন এবং নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি কবি ছিলেন এবং কুরআন পাঠ করতে পারতেন।

রাজিয়া সুলতানা অন্তঃপুরিকা ছিলেন না। তিনি প্রকাশ্য দরবারে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। তিনি কোন ঘোমটা ব্যবহার করতেন না। পুরুষের বেশে তিনি আলখাল্লা এবং পাগড়ি পরে জনসম্মুখে আসতেন। তিনি সভাসদ, আমির-ওমরাহদের রাজ্য শাসন প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে আইন বা নির্দেশ জারি করতেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন এবং বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন। দুর্ভাগ্যবশত রাজিয়া সুলতানার খোলামেলা রাজকীয় আচার-আচরণ রক্ষণশীল আমিরগণ মোটেই পছন্দ করতেন না। তিনি খুবই উদার ও জনদরদি শাসক ছিলেন। তিনি হিন্দুদের ওপর অর্পিত বর্ধিত কর বিলোপ করেন; কিন্তু তার এই পদক্ষেপ অনেক আমির মোটেও পছন্দ করেননি।

১২৩৬ সাল থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত মোট চার অথবা সাড়ে চার বছর রাজিয়া ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাসের ভিড়ে এই সময়টুকুর কথা হয়তো তেমন আলোচনাতেই আসতো না। কিন্তু সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা নিজ যোগ্যতাবলেই এই সময়টুকুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী সুলতান হিসেবে অবশ্যই তিনি নিজেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন। কারণ একজন নারী হিসেবে তিনি যে সময় সিংহাসনে বসেছিলেন, সে সময় তা কল্পনাও করা যেতো না।

ত্রিভুজ প্রেমের গল্প :

দিল্লির সুলতানা হিসেবে রাজিয়ার চার বছরের শাসনকাল শুরু হয়। তিনি ছিলেন একই সাথে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সুলতানা এবং দিল্লির মসনদে বসা প্রথম নারী শাসক। আর এখান থেকেই শুরু হয় ত্রিভুজ প্রেমের মিথ্যা উপাখ্যান। একদিকে কথিত প্রেমিক জামাল উদ্দিন ইয়াকুত এবং অন্যদিকে প্রতিশোধপরায়ণ মালিক আলতুনিয়া। বলা হয়ে থাকে, ত্রিমুখী প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদের প্রতিশোধই সুলতানা রাজিয়া’র ক্ষমতাচ্যুৎ ও হত্যার কারণ। সেই সাথে রাজপরিবার ও সভাসদগণের কূটবুদ্ধির প্রয়াস যেকোন রগরগে তুর্কি সিরিয়ালকেও হার মানিয়ে দেয়।

দিল্লীর সুলতান হিসেবে রাজিয়া সুলতানা অনুমিতভাবেই দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন। তিনি ছিলেন প্রজা দরদী, প্রজাদের থেকে দূরে না থেকে বরং তাদের সাথে মিশতেন এবং নিজ রাজ্যের হিন্দু প্রজাদের সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণ রক্ষা করতে সচেতন ছিলেন। তিনি একজন সমরবিশারদ হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি অনেকগুলো স্কুল, একাডেমী, গবেষণার কেন্দ্র এবং পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুল-কলেজের সিলেবাসে কুরআন, জনপ্রিয় প্রাচীন দার্শনিকদের রচনা, মুহাম্মদের রীতিনীতি এবং বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের বিভিন্ন হিন্দু রচনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চারদিকে প্রসারিত হতে থাকে সুলতানা রাজিয়ার দূরদর্শী শাসনকার্য। যত বিস্তৃত হয়েছে তার শাসনকার্যের প্রজ্ঞা ততই বেড়েছে চারপাশের ষড়যন্ত্রের অশনিসংকেত।

কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল জামাল উদ্দিন ইয়াকুত নামক একজন অতুর্কি কৃষ্ণাঙ্গকে আস্তাবলের প্রধান থেকে সভাসদগণের প্রধান করে তোলা। ইয়াকুত নামক এক অতুর্কি তার আনুগত্য এবং যোগ্যতার কারণে হয়ে উঠলেন সুলতানা রাজিয়ার অতি ঘনিষ্ঠ। এর ফলে রাজিয়া তাকে আমির প্রধান হিসেবে ঘোষণা করলে তুর্কি সভাসদরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। আমির প্রধান হওয়ার গৌরব শুধুমাত্র একজন তুর্কির জন্যই নির্ধারিত ছিল কোন আফ্রিকান হাবশী সেই সম্মান পাবে তা তুর্কিরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

তাছাড়াও সুলতানা রাজিয়া সকল ক্ষেত্রে ইয়াকুতের পরামর্শ গ্রহণ করতো এবং সেই অনুযায়ীই রাজকার্য পরিচালনা করতো। তখন গুঞ্জন উঠতে শুরু করে যে ইয়াকুত শুধু সভাসদের প্রধাণই নন, সুলতানা রাজিয়ার সাথে প্রেমের সম্পর্কও ছিল। এমন গুজবই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করেছিল। চারদিক থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। প্রথমেই বিদ্রোহ করেন লাহোরের গভর্নর। অবশ্য রাজিয়া এই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ফলাফলস্বরূপ অন্দরমহলের ভিতর ও বাহিরের ষড়যন্ত্র রাজিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ফন্দিফিকির আঁটা শুরু করে। এমনকি মালিক আলতুনিয়ার শরণাপন্ন হয়। সে সময় বাথিন্দার গভর্নর ছিলেন মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়া।

মালিক আলতুনিয়া ছিলেন রাজিয়া সুলতানার বাল্যবন্ধু এবং কারো কারো মতে তার বাল্য প্রেমিকও বটে। রাজিয়া সুলতানা দিল্লির ক্ষমতায় বসার পরপর তিনি তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু রাজিয়া দিল্লির শাসক হিসেবে ব্যস্ততার কারণে প্রস্তাবগুলো বারবার প্রত্যাখান করেছিলেন। সুতরাং যখন মালিক শুনতে পান হাবসী ইয়াকুত রাজিয়ার এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তখন তিনি সংগত কারণেই অত্যন্ত ক্রুদ্ধ এবং ঈর্ষান্বিত হন। আলতুনিয়া মেনে নিতে পারেনি যে সুলতানা রাজিয়া তাকে প্রত্যাখ্যান করে ইয়াকুত তার ঘনিষ্ঠ হতে পারে।

অতঃপর মালিক আলতুনিয়া রাজিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। যুদ্ধে সুলতানা রাজিয়া ইয়াকুতকে সঙ্গে নিয়ে আলতুনিয়ার বাহিনীকে প্রতিহত করতে রওনা দেয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত যুদ্ধে রাজিয়া পরাজিত হন। পরাজিত ইয়াকুতকে বন্দী করে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। অতঃপর মালিক রাজিয়াকে বন্দি করে বাতিন্দাতে ফেরত যান। বন্দী করা হলেও তাকে রাজকীয় কায়দায় রাখা হয় এবং রোজ শুক্রবারে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তার সাথে এমন অভূতপূর্ণ আচরণ ধীরে ধীরে রাজিয়াকে আবার আলতুনিয়ার প্রতি অনুরক্ত করে তুলে এবং দুইজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বলা হয়ে থাকে তিনি যতটা না অনুরক্ত হয়ে বিয়ে করেছেন এরচেয়েও বড় কারন দিল্লির সিংহাসন উদ্ধার করার জন্য। কারণ যখন রাজিয়া বন্দি ছিল তখন তার অনুপস্থিতিতে তার সৎ ভাই মুজউদ্দিন বাহরাম দিল্লির ক্ষমতা দখল করেন। এটিই প্রধান কারণ ছিল রাজিয়ার মালিককে বিবাহ করতে রাজি হওয়ার।

রাজিয়া যে শুধুমাত্র জীবন রক্ষার জন্য বা অনুরক্ত হয়ে আলতুনিয়াকে বিয়ে করেননি, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ শিগগিরই তিনি আলতুনিয়াকে দিল্লি আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিয়ে সফল হন। অতঃপর দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে দুইজন একত্রে সৈন্য জড়ো করে দিল্লীর অভিমুখে রওনা দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বাহারাম তাদের যুদ্ধে পরাজিত করে। বাহরাম নিজ সিংহাসন শক্ত করার জন্য রাজিয়া এবং তার স্বামী মালিক উভয়কেই হত্যা করে। আর এভাবেই শেষ হয় দিল্লির প্রথম নারী শাসক রাজিয়ার ঘটনাবহুল জীবন।

সুলতানা রাজিয়ার মৃত্যু :

তার মৃত্যু নিয়ে বেশ কয়েকটি কথা রয়েছে। একটি পক্ষ দাবি করেছেন, ১২৪০ পলায়নকালে তার একজন ভৃত্য যে কিনা এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এই ভৃত্যই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।

কথিত আছে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোশাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিল। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তার সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব রাজকীয় রত্ন বাজারে বিক্রি করতে গেলে সে ধরা পড়ে। আর একইসঙ্গে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার।

অন্য একটি সূত্র মতে, ১২৪০ সালের ১৩ অক্টোবর রাজিয়া আর আলতুনিয়া দিল্লির সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, ১৪ অক্টোবর তাদের হত্যা করা হয়।

অন্য সূত্রমতে, ১২৪০ সালে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরার পথে বনে দস্যুদের আক্রমণে তিনি মারা যান। আবার কোনো কোনো সূত্রমতে, যুদ্ধে তার স্বামী আলতুনিয়া নিহত হলে তিনি নিহত স্বামীর পাশে অবস্থান নেন। আর এ সময় হঠাৎ একটি তীর তাকে বিদ্ধ করলে তিনি নিহত হন।

সমাধিস্থল :

রাজিয়া সুলতানার সমাধিস্থল নিয়ে বিতর্ক আছে। একটি মত অনুসারে তার দেহ হরিয়ানার কোইথালে সমাধিস্থ আছে, অপরদিকে মনে করা হয় তার সমাধি পুরোনো দিল্লীর বুলবুল-ই-খানা মহল্লায় আছে। পুরোনো দিল্লীর সমাধিটি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা সংরক্ষিত হলেও অত্যন্ত অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় বিদ্যমান।

রাজিয়া সুলতানার সমাধিস্থল
ছবি: medieval.gumlet.net

ইসলাম ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়জন নারী খুব বেশি আলোচিত হন, রাজিয়া সুলতানা তাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি শুধুমাত্র নিজ যোগ্যতাবলে ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী সব রাজা, মহারাজা, বাদশাহ আর সম্রাটদের পাশে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিলেন। আর তাই ভারতবর্ষের শাসকদের তালিকায় আজও তার নামটি নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছে।

তথ্য সূত্র:

১। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান (আফসার ব্রাদার্স)
২। ভারতবর্ষের ইতিহাস- আন্তোনভা, বোনগার্দ-লেভিন, কতোভস্কি (প্রগতি প্রকাশন)                                                        ৩। উইকিপিডিয়া

Related posts

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: জীবন, কর্ম ও জনশ্রুতি, ইতিহাসের দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব

News Desk

রিজার্ভ আরও কিছুটা কমে ৩৩.৮৬ বিলিয়নে

News Desk

ডা. দীপু মনি জীবনী, পেশা, ধর্ম, কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবন

News Desk

Leave a Comment