Image default
জীবনী

রবি শঙ্কর :এক কিংবদন্তী সেতার বাদক

সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন, ‘রবিশঙ্করের সেতার, বিসমিল্লাহ খানের সানাই আর আল্লারাখা খানের তবলা যে শুনেনি ভারতবর্ষে সঙ্গীতের সুধাই তো তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না।’ এই তিন শিল্পীর মধ্যে প্রথম দুজনের জন্ম আবার একই শহর- বারাণসীতে।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য আর ভারতীয় সঙ্গীতকে যিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। সেতারকে যিনি নিয়ে গেছেন যন্ত্র সঙ্গীতের ইতিহাসের নতুন এক দিগন্তে, যিনি পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যের সঙ্গীতের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করেছেন এক নতুন জাগরণের, সৃষ্টি করেছেন এক বিপ্লবের, তিনি সেতার সম্রাট রবি শঙ্কর।

রবি শঙ্কর
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ; ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মাটিতে তখন রক্তের তীব্র গন্ধ। ঘরে-বাইরে সর্বত্র অস্থিরতার রেশ। নেই কোথাও একটু নিরাপদ স্থান। এদিক ওদিক সবখানেই চোখে পড়ে রক্ত স্তূপ, কান পাতলেই শোনা যায় কান্নার রোল, যেন এক সাক্ষাৎ মৃত্যুকূপ। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রয়াসে। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই, নেই খাবারের কোনো ব্যবস্থা, নেই চিকিৎসার জায়গাও। ঠিক তখনই ছন্নছাড়া উদ্বাস্তু মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। শিষ্য তথা বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আয়োজন করলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। বিশ্বে যত চ্যারিটি কনসার্ট হয়েছে তার মাঝে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর প্রভাব অনেক। ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত এই দাতব্য কনসার্ট হতে অর্জিত সকল অর্থসাহায্য রবিশঙ্কর দান করলেন বাংলাদেশের মানুষদের। তিনি আজ নেই তবে তার প্রতি বাংলার মানুষের আত্নার টান আজও রয়েছে দৃঢ়। তিনি শুধু বিখ্যাত সেতারবাদকই নন, তিনি বাঙালির পরম বন্ধু, বাঙালির দুঃখের সাথী।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর ১৯২০ সালে ৭ এপ্রিল ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। জীবিকার্জনের জন্য তাঁর বাবা শ্যামশংকর চৌধুরি নড়াইল থেকে বেনারসে চলে যান। তিনি ছিলেন ঝালওয়ারের মহারাজার একজন কর্মী।

রবিশঙ্করের ছেলেবেলা

রবিশঙ্করের পূর্ণ নাম রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী, ঘরোয়া নাম ‘রবু’। আদি পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলায় হলেও তার জন্ম ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসী শহরে। বেশ সচ্ছল পরিবারেই জন্ম হয় রবিশঙ্করের। সেখানেই বড় হয়েছেন তিনি। রবি শংকর ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং আইনজ্ঞ। কিন্তু রবি শংকরের প্রায় পুরো ছেলেবেলাটাই বাবার অবর্তমানে কাটে। বস্তুত একরকম দারিদ্রের মধ্যেই রবি শংকরের মা হেমাঙ্গিনী তাকে বড় করেন। বড় ভাই উদয় শংকর ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। ঐ সময়টায় তিনি ছিলেন প্যারিসে। রবি শংকর ১৯৩০-এ মায়ের সাথে প্যারিসে বড় ভাইয়ের কাছে যান এবং সেখানেই আট বছর স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বার বছর বয়স থেকেই রবি শংকর বড় ভাইয়ের নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক। ঐ বয়স থেকেই তিনি অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছেন ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।

পণ্ডিত হয়ে ওঠার গল্প

প্রখ্যাত এই পণ্ডিত সেতারবাদক হিসেবে বিশ্বজয় করলেও তাঁর শুরুটা ছিল একটু অন্যরকম। চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই উদয় শঙ্কর আগে থেকেই নৃত্য জগতে বেশ সারা ফেলতে শুরু করেছেন। পরবর্তীতে রবিশঙ্করের মেধার পরিচয় পেয়ে তার দলে যোগ দেয়ার জন্য বলেন। একেতো সংসারে টানাপোড়েন তার উপর আবার অল্প বয়স। একপ্রকার ঝোঁকের বশেই রাজি হয়ে যান রবিশঙ্কর। সেই থেকে তার যাত্রারম্ভ।১০ বছর বয়সে ১৮৩০ সালে তিনি তাঁর বড় ভাই প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের নাচের দলের সাথে প্যারিসে যান। এর ঠিক তিন বছর পর তিনি এই নৃত্য সংগঠনের সদস্য হন এবং নাচ শিখতে শুরু করেন। নৃত্যে পারদর্শীতার কারণে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এরকমই একটা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এ সময় এই দলে ছিলেন মাইহার রাজদরবারের প্রধান সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তিনি রবিশঙ্করকে দেখেই বুঝতে পারলেন, ঠিকমতো তালিম পেলে ছেলেটা একদিন বিশ্বজয় করবে। তিনি রবিশঙ্করকে একজন একক সেতারবাদক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং একটা শর্ত দিয়ে বসেন, শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষায় তাঁকে একনিষ্ঠ থাকতে হবে। এজন্য ইউরোপ ভ্রমণ শেষে নৃত্যদল ত্যাগ করে তালিম নিতে মাইহারে চলে যান রবিশঙ্কর।

রবিশঙ্করের পণ্ডিত হয়ে ওঠার গল্প
আলাউদ্দিন খাঁ এবং আলী আকবর খানের সঙ্গে রবিশঙ্কর (বামে) ; ছবি : thehindu.com

১৯৩৮ সালে ১৮ বছরের এক যুবক মাইহারে আসেন অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দিন খানের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে। আচার্য রবিশঙ্করের একনিষ্ঠতা আর ভক্তি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সহচার্যে আসেন। এরপর আর কখনো পিছনে তাকাতে হয়নি এই কালজয়ী পণ্ডিতকে। ওস্তাদ আলী আকবর খানের সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দী বাজিয়েছিলেন। ১৯৩৮-৪৪ সাল পর্যন্ত গুরুর বাড়িতে থেকেই তিনি তার শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন করেন। গুরুর দেয়া সেই শর্ত তিনি পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে।

রবিশঙ্করের পারিবারিক জীবন : প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী

একুশ বছর বয়েসে রবিশঙ্কর তার গুরু (যাঁকে তিনি বাবা বলে ডাকতেন) আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন।অন্নপূর্ণা দেবী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা ও একজন গুনী সংগীতজ্ঞ হবার কারণেই তাদের বৈবাহিক জীবন নিয়ে সবার আগ্রহ ছিল আকাশছোঁয়া। রবিশঙ্কর যখন মাইহারে দীক্ষা নিতে আসেন, তখন অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ১৩ বছরের লাজুক এক কিশোরী। রবিশঙ্করের ভাষায়, “খুব উজ্জ্বল আর দারুণভাবে নজরকাড়া। চোখ দুটো ভারি মিষ্টি, আর গায়ের রঙ আলুভাইয়ের (ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ) চেয়ে ফর্সা” । ১৯৪১ সালের ১৫ মে সন্ধ্যাবেলা বিয়ে হয় তাদের। এই সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন ২১ বছরের এক যুবক।
এই বিয়েতে তাদের একটি পুত্র সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করের জন্ম হয়। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও দেবী অন্নপূর্ণা একই জায়গাতে থাকার কারণে সবাই ধারণা করতো তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা মাইহারে বাবা-মায়ের সাথে আশ্রমের মতো একটা পরিবেশে বড় হয়েছিলেন, তাই কোনো প্রশ্নই ছিলো না পণ্ডিতজির আকর্ষণে জড়িয়ে পড়ার। পণ্ডিত রবিশঙ্করও তাঁর আত্মজীবনী রাগমালাতে লিখেছেন, “আমাদের মাঝে প্রেম, রোম্যান্স বা লুকোচুরির কিছুই ছিল না। ওই সময় অনেকে অবশ্য এ রকমই ভাবতো। বিয়ের আগে এ ব্যাপারে ওর সত্যিকার মনোভাব কী ছিল সেটা আমি জানতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল ওর মত আছে।”

রবিশঙ্করের পারিবারিক জীবন : প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী
প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমে সবকিছু ঠিক থাকলেও কিছুদিন পর থেকে তাদের সাংসারিক জীবনে টানাপোড়ন শুরু হয়। এর একটি প্রধান কারণ ছিলো অন্নপূর্ণা দেবীর জনপ্রিয়তা। বলা হয়ে থাকে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ৮০ ভাগ পেয়েছিলেন অন্নপূর্ণা, ৭০ ভাগ আলী আকবর খাঁ, আর ৪০ ভাগ পেয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এই বিষয়টা ভালোভাবে নিতে পারতেন না পণ্ডিতজি। কোনো অনুষ্ঠানের পর ভক্তদের অন্নপূর্ণা দেবীকে ছেঁকে ধরাটা পছন্দ ছিলেন না পণ্ডিতজির। তাই একসময় বাজানোই ছেড়ে দিলেন দেবী অন্নপূর্ণা। এই টানাপোড়নের আরেকটা কারণ ছিল তাদের পুত্র শুভঙ্করের জন্ম। জন্মের কিছুদিন পরেই শুভঙ্করের এক ভয়ানক অসুখ ধরা পড়ে। সারারাতই কান্নাকাটি করতো সে। সারাদিন ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করার পর রাত জাগাটা তাদের মাঝে নতুনভাবে ঝামেলার কারণ হলো। বোম্বেতে তাদের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছালে একদিন অন্নপূর্ণা জানতে পারলেন, রবিশঙ্করের জীবনে নতুন কারো আগমন হয়েছে। নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সাথে রবিশঙ্করের প্রেম চলছে। এই কারণে সব ছেড়ে তিনি ছেলে শুভকে নিয়ে মাইহারে চলে আসলেন। পরে কমলার বিয়ের পর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন পণ্ডিতজির কাছে। কিন্তু এই সংসার আর টেকেনি। ১৯৬৭ সালে ইতি ঘটে তাদের সংসারের।

পরবর্তীতে আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্স এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এই সম্পর্ক একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। নোরা জোন্স – রবি শঙ্করের এই মেয়ে একজন প্রথিতযশা জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক এবং পাশ্চাত্য লোক সঙ্গীতের শিল্পী ও সুরকার। নোরা জোন্স ২০০৩ ও ২০০৫ সালে দশটি গ্র্যামি এওয়ার্ড পেয়েছেন।

নোরা জোন্স- রবি শঙ্কর
রবি শঙ্করের মেয়ে নোরা জোন্স ; ছবি : newindianexpress.com

পরবর্তীতে রবিশঙ্কর তার গুণগ্রাহী ও অনুরক্তা সুকন্যা কৈতানকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে তার দ্বিতীয় কন্যা অনুশকা শংকরের জন্ম হয়। বাবার কাছে শিক্ষা নিয়ে অনুশকা এখন নিজেও সেতার বাজিয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

সঙ্গীত জীবন

১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে সকল যন্ত্র এবং ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি মাইহার থেকে মুম্বাই যান এবং সেখানকার ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে কবি ইকবালের ‘সারে জাঁহা মে আচ্ছা’ কবিতার সুর করেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণের জন্য ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-এর নয়াদিল্লি শাখার সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন।

জর্জ হ্যারিসন এবং রবিশঙ্কর
কনসার্টের জন্য প্রেস কনফারেন্সে জর্জ হ্যারিসন এবং রবিশঙ্কর ; ছবি : udiscovermusic.com

১৯৫০ সালের দিকে সিনেমার আবহ সঙ্গীতে কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনায় কাজ করা ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের অপু-ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার)-র মতো বিখ্যাত সিরিজের পরিচালকও ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে একক সেতার পরিবেশন করার সুযোগ পান তিনি। এরপর তিনি পাশ্চাত্য দেশে পারফর্ম করতে শুরু করেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন।

সত্যজিৎ রায়ের সাথে রবিশঙ্কর
সত্যজিৎ রায়ের সাথে রবিশঙ্কর ; ছবি; livemint.com

তিনি ১৯৫৪ সালে একটি সঙ্গীতদলের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান এবং একক বাদ্য পরিবেশন করেন। ১৯৫৫ সালে ওস্তাদ আলী আকবর খানের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের এক পরিবেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রোতাদের আগ্রহের সৃষ্টি হয় ভারতীয় রাগ সংগীতের উপর। ইউরোপ, আমেরিকায় ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে তুলে ধরার জন্য ১৯৫৬ সালে জানুয়ারি মাসে পণ্ডিত রবিশঙ্কর অল ইন্ডিয়া রেডিওর চাকরি ছেড়ে দেন এবং যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। এই সফরে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর একেক পর এক তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে থাকেন এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ১৯৫৬ সালে লণ্ডন থেকে তাঁর তিনটি রাগের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সঙ্গীত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং একইসাথে তিনি কিছু পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনাও করেন। এই বছরেই তিনি মুম্বাইতে কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক প্রতিষ্ঠা করেন।

জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে
জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৭ সালে তিনি দ্য মনেটারি পপ ফেস্টিভ্যালে সেতার পরিবেশন করেন এবং মেনহুইনের সাথে জার্মানির বেস্ট চেম্বার মিউজিক পারফর্মেন্স ফর ওয়েস্ট মিটস ইস্ট পুরষ্কারে ভূষিত হন।এরপর মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত তাঁর কিন্নর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের একটি শাখা খোলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে। ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করেন এবং সেখানে সেতার পরিবেশন করে বাঙালীদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে অনেকদিন সঙ্গীত জগৎ থেকে আলাদা হয়ে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৯ সালে নৃত্যনাট্য ঘনশ্যাম এর মাধ্যমে আবার কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থায়ীভাবে বিরতি নেন।

বিখ্যাত যত পুরস্কার আর সম্মাননা

পন্ডিত রবিশঙ্কর তার সঙ্গীত জীবনে অর্জন করেছেন ৪টি গ্র‍্যামি অ্যাওয়ার্ড যার মধ্যে সর্বশেষ অ্যাওয়ার্ড তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও পেয়েছেন নানা পুরস্কার, অর্জন করেছেন বিশ্বখ্যাত নানা সম্মাননাও। চলুন এক নজরে দেখে আসা যাক –

১৯৬২ সাল – ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক
১৯৮১ সাল – ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ পদক
১৯৯১ সাল – ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেসের গ্র্যান্ড প্রাইজ
১৯৯৮ সাল – সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ
১৯৯৯ সাল – ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন পদক
২০০০ সাল – ফরাসি সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার
২০০১ সাল – রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত অনারারী নাইটহুড
২০০২ সাল – দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
২০০৩ সাল – আইএসপি এ ডিস্টিংগুইশড আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, লন্ডন
১৪টি সম্মানসূচক ডক্টরেট
ম্যাগাসাসে অ্যাওয়ার্ড, ম্যানিলা, ফিলিপাইন
গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর উপাধি – ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম

জীবনাবসান

বিশ্বখ্যাত এই পণ্ডিত ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর অতিমাত্রায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং হৃৎপিন্ডের ভাল্ব পরিবর্তন করা হয়। তাঁর দুর্বল শরীর এই অপারেশনের ধাক্কা সহ্য করতে না পারায় দেহত্যাগ করেন এই মহান কিংবদন্তী। পাশ্চাত্য সংগীতের তুলনায় যে ভারতীয় রাগসংগীত যে অনেক উচ্চস্তরের- এ কথা প্রমাণ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর চৌধুরি।

মেয়ে আনুশকা শঙ্করের সঙ্গে রবিশঙ্কর
মেয়ে আনুশকা শঙ্করের সঙ্গে রবিশঙ্কর ; ছবি : www.emirates247.com

সেতারের সুরে তিনি ছিলেন, আছেন আর থাকবেনও। তার অনুসারীরা শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করবে আজীবন। তার উক্তিতেই তিনি বলেছেন –

“I will keep playing as long as my body lets me, and as long as I’m wanted by my listeners.

Because music is the only thing that keeps me going.”.

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, কালচারাল ইন্ডিয়া, বায়োগ্রাফি, অনুশীলন

Related posts

ইরেশ যাকের জীবনী,ফ্যামিলি এবং সম্পূর্ণ প্রোফাইল

News Desk

হযরত ঈসা (আঃ) এর জীবনী এবং শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

লেমন কাওসার

জিরো থেকে হিরো একজন জামাল ভূঁইয়ার গল্প

News Desk

Leave a Comment