Image default
জীবনী

দিয়াগো ম্যারাডোনা: জনগণের হৃদয়ে যিনি সর্বকালের সেরা

দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা, দিয়েগো মারাদোনা নামে সুপরিচিত । ভক্তদের কাছে এল পিবে দে অরো ডাকনামে পরিচিত মারাদোনা তার খেলোয়াড়ি জীবনের অধিকাংশ সময় আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স এবং নাপোলির হয়ে একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন। তিনি মূলত একজন আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেললেও মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় আক্রমভাগের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন । বহু ফুটবল খেলোয়াড় এবং বিশেষজ্ঞ তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গণ্য করেন।যেকোনো বিষয়ে সেরা নির্বাচন করার মূলত দুটি পদ্ধতি আছে। এর একটি হলো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ লোক দিয়ে বিচার করা; আরেকটি হলো, সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচন করা। দক্ষ লোক দিয়ে নির্বাচন করাটাই নিঃসন্দেহে বেশি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কিন্তু এর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের নির্বাচনকেও অবজ্ঞা করা যায় না। সাধারণ মানুষের নির্বাচনে মূলত দুটো সমস্যা হয়। একটি হচ্ছে, তারা আবেগের আশ্রয় বেশি নেয়; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সমসাময়িকদের এগিয়ে রাখে। ফুটবলের ইতিহাসে অল্প কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা কিনা দক্ষ বিচারক আর সাধারণ জনগণ দু’দিকের ভোটেই প্রথম দিকেই থাকেন। এরকম একজন খেলোয়াড় হচ্ছেন দিয়াগো ম্যারাডোনা। গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার সময় ফিফা প্রথমে সিদ্ধান্ত নেয়, ইন্টারনেটে ভোটিংয়ের মাধ্যমে সেরা নির্বাচন করা হবে। সেভাবে ভোটিংও হয়। তবে ফলাফল দেখে ফিফা কমিটি চোখে সর্ষে ফুল দেখে। ম্যারাডোনা ভোট পান ৫৩.৬%, পক্ষান্তরে পেলে পান মাত্র ১৮.৫৩%।

এরপরই ফিফা আরেকটি কমিটি গঠন করে, যেখানে ভোট গ্রহণ করা হয় তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ও ম্যাগাজিনের পাঠক আর জুরি বোর্ডের সদস্যদের কাছ থেকে। এই নির্বাচনে পেলে প্রথম হন। শেষ পর্যন্ত গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের দুটো পুরষ্কার দেওয়া হয়; একটি জনগনের সেরা, আরেকটি বিশেষজ্ঞদের সেরা। অনলাইনের ভোটিং আসলে গ্রহণযোগ্যতা হারায় তখন, যখন দেখা যায় ম্যারাডোনা-পেলের পরের ক্রমগুলো হচ্ছে ইউসেবিও, ব্যাজিও, রোমারিও, ভ্যান বাস্তেন, রোনালদো লিমা। ক্রুয়েফ আছেন ১৩ নম্বরে, ডি স্টেফানো ১৪ নম্বরে, প্লাতিনি ১৫ নম্বরে। যে জায়গার ফলাফল আপনাকে দেখাবে ক্রুয়েফ, ডি স্টেফানো কিংবা প্লাতিনির চেয়ে ব্যাজিও কিংবা রোমারিও (তখন পর্যন্ত তারা ক্যারিয়ার শেষ করেননি) ভালো, সেই ভোট গ্রহণ করা আসলে কষ্টকর। এছাড়া অনলাইনে সাধারণত নতুন প্রজন্মের মানুষরাই ভোট দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শতাব্দীর সেরা নির্বাচন করার মতো এত বড় বিষয়ে এই দিকগুলো ফিফা কমিটি আগে খেয়াল করল না কেন, কেন নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হলো। যদি অনলাইনের বিচারেও পেলে সেরা হতো, তখন কি আরেকটি নির্বাচন করা হতো?

দিয়াগো ম্যারাডোনা: জনগণের হৃদয়ে যিনি সর্বকালের সেরা
ছবি: jagonews24

এখানে দোষ পেলে কিংবা ম্যারাডোনা কারোরই নয়, দোষটা আসলে ফিফার উপরেই বর্তায়। এত বড় একটি সংস্থা এত বড় একটি নির্বাচনে ভুল কেন করল? সে যা-ই হোক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজকের লেখার মূল আলোচ্য বিষয় ম্যারাডোনা। একটি প্রোডাক্ট কতটা মূল্যবান, তার ব্যাপারে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় তার ‘মার্কেট ভ্যালু’ দেখে। ফুটবলারকে যদি প্রোডাক্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে ম্যারাডোনা ঠিক কতটা মূল্যবান ছিলেন, সেটা অনুমান করা সম্ভব না। তবে এরপরও যখন আপনি জানবেন যে, ম্যারাডোনা ফুটবল ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি কিনা দু’বার ট্রান্সফার ফির রেকর্ড গড়েছেন, তখন কিছুটা ধারণা করা হয়তো সম্ভব। ম্যারাডোনার পরে এই রেকর্ড আছে শুধুমাত্র আর একজনের, রোনালদো লিমার। ম্যারাডোনাকে জানতে ‘ম্যারাডোনা কে ছিলেন?’- এই প্রশ্নটির চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হওয়া উচিত, ‘ম্যারাডোনা কী ছিলেন?’

ম্যারাডোনা ছিল একটি বিশ্বাসের নাম। আজকের যুগের সেরা খেলোয়াড় মেসি অথবা রোনালদোকে যদি মালাগায় (স্প্যানিশ লিগের একটা দল) খেলতে দিয়ে বলা হয়, দলকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করাতে হবে, তাহলে কি সেটা তাদের জন্য সম্ভব হবে? রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনাকে টপকিয়ে কাজটা করা মোটামুটি অসম্ভবই বলা যায়। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে মোটামুটি এ ধরনের অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করেছিলেন ম্যারাডোনা। এই পর্যন্ত যতগুলো সর্বকালের সেরা একাদশ হয়েছে, তাতে দুজনের নাম অটোমেটিক চয়েজ হিসেবে ছিল, এর একজন হচ্ছেন ম্যারাডোনা। ‘৮০র দশকে একক কৃতিত্বে পুরো ফুটবল বিশ্বকেই চমকে দিয়েছেন তিনি। আজ বিশ্বজুড়ে আর্জেন্টিনার যত সমর্থক, তার শুরুটা হয়েছিল ম্যারাডোনার দ্বারা। শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড়ের কারণে কোনো দেশের এতটা সমর্থক, সেটা ম্যারাডোনাকে না জানলে বিশ্বাস হবে না। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিংবা ক্লাবে লিগ চ্যাম্পিয়ন অনেক খেলোয়াড়ই হন, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতি দ্বারা কোনো দলকে এতটা উদ্বুদ্ধ করার রেকর্ড ম্যারাডোনা ছাড়া ইতিহাসে আর কারো নেই।

ম্যারাডোনার শৈশব কাল

ম্যারাডোনার শৈশব কাল
ছবি: newsbust.in

দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর তারিখে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের লানুসের পলিপলিনিকো আবিতা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার বাবার নাম দিয়েগো মারাদোনা চিতরো এবং তার মায়ের নাম দালমা সালভাদোর ফ্রাঙ্কো দোনিয়া তোতা । তারা উভয়েই কোরিয়েন্তে নদীর তীরে একে অপরের থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরত্বে কোরিয়েন্তেস প্রদেশের উত্তর-পূর্বের এস্কুইনা শহরে জন্মগ্রহণ এবং শৈশব অতিবাহিত করেছেন। ১৯৫০ সালে তারা এস্কুইনা ছেড়ে বুয়েনোস আইরেসে বসতি স্থাপন করেন। মারাদোনা তার শৈশবেই পরিবারে সাথে কোরিয়েন্তেস প্রদেশ থেকে বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ উপকণ্ঠে অবস্থিত ভিয়া ফিওরিতো-এ স্থানান্তরিত হন এবং সেখানেই তিনি তার শৈশব অতিবাহিত করেছেন। তিনি তার বাবা-মায়ের চার কন্যার সন্তানের পর প্রথম পুত্র ছিলেন। তার দুই ছোট ভাই উগো মারাদোনা এবং রাউল মারাদোনা উভয়ই পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে, মারাদোনাকে একজন প্রতিভাবান স্কাউট তার প্রতিবেশী ক্লাব এস্ত্রেয়া রোহাতে খেলতে দেখে। অতঃপর তিনি উক্ত স্কাউটের বদৌলতে বুয়েনোস আইরেস ভিত্তিক ফুটবল ক্লাব আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের দল লস সেবায়িতাস-এ যোগদান করেন। একজন ১২ বছর বয়সী বল বয় হিসেবে তিনি প্রথম বিভাগের খেলার প্রথমার্ধের বিরতির সময় বল নিয়ে তার জাদুকরী কুশল প্রদর্শন করে দর্শকদের উল্লসিত করেন । মিডফিল্ডে খেলেও তিনি পাঁচবার আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশনের টপ স্কোরার হন। এরই মাঝে ১৯৭৯ সালে যুব বিশ্বকাপ জেতেন আর্জেন্টিনার হয়ে। যুব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন। এই সফলতা তাকে ১৯৭৯ সালের সেরা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়ের পুরস্কার এনে দেয়। এছাড়া ফিফা থেকেও সেই বছরের দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছরেও দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। তবে এসব পুরস্কার জেতার কারণে কিন্তু ম্যারাডোনা ‘গ্রেট’ নন।

বর্তমান যুগের অনেকেরই ধারণা, ম্যারাডোনা গ্রেট কারণ তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। আসলেই কি তাই? ম্যারাডোনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে। এরপর বিশ্ব আরো ৭টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল দেখেছে, এদের মাঝে ৭ জন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন। তারপরেও কেন তাদেরকে ম্যারাডোনার সমতুল্য বলা হয় না? বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া অবশ্যই অনেক বড় বিষয়, কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। মুলারের জার্মানির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া আর বেলের ওয়েলসের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গুরুত্ব নিশ্চয়ই এক না। আজ যদি বেল ওয়েলসকে নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন, তা কি অসম্ভব মনে হয় না? বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কাজটাও অনেকটা সেরকমই ছিল। একনজরে তার বিশ্বকাপ পারফর্মেন্সটা একটু দেখা যাক।

১৯৮২ বিশ্বকাপ

স্পেনে অনুষ্ঠিত ১৯৮২ ফিফা বিশ্বকাপে মারাদোনা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮২ সালে বার্সেলোনার কাম্প ন্যুতে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী খেলায় আর্জেন্টিনা বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয়েছিল। কাতালান জনতা স্থানান্তরের নতুন বিশ্বরেকর্ড করে তাদের দলে আগত মারাদোনাকে খেলতে দেখতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু তিনি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারেননি, যার ফলে আর্জেন্টিনা ১–০ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে আর্জেন্টিনা খুব সহজেই হাঙ্গেরি এবং এল সালভাদোরকে পরাজিত করে দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছিল, তবে দলের অভ্যন্তরে বেশ উত্তেজনা ছিল; কেননা তরুণ, কম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সাথে পুরাতন, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছিল। যার ফলে, মারিও কেম্পেস, অসভাল্দো আর্দিলেস, রামোন দিয়াস, দানিয়েল বেরতোনি, আলবের্তো তারান্তিনি, উবালদো ফিজোল এবং দানিয়েল পাসারেয়া সংবলিত আর্জেন্টিনা দল দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিল এবং উক্ত আসরের চ্যাম্পিয়ন দল ইতালির কাছে পরাজিত হয়েছিল। ইতালির বিরুদ্ধে ম্যাচটি ক্লাউদিও গেন্তিলে মারাদোনাকে আক্রমণাত্মকভাবে ট্যাকল করার জন্য বিখ্যাত হয়েছে, যেখানে ইতালি বার্সেলোনার সারিয়া স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ২–১ গোলে পরাজিত করেছিল। মারাদোনা এই প্রতিযোগিতায় সর্বমোট ৫টি ম্যাচ (যার মধ্যে একটিতেও তিনি বদলি হননি) খেলেছিলেন; যার মধ্যে তিনি হাঙ্গেরির বিপক্ষে দুটি গোল করেছিলেন। তাকে সব খেলায় বারবার ফাউল করা হয়েছিল, বিশেষ করে সারিয়াতে অনুষ্ঠিত ব্রাজিলের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে, যেখানে রেফারির খুবই হতাশাজনক পরিচালনা এবং হিংসাত্মক ফাউল লক্ষ্য করা গিয়েছে; উক্ত ম্যাচে আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের থেকে ৩–০ গোলে পিছিয়ে ছিল, এমন সময় মারাদোনার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়, অতঃপর তাকে বাতিস্তার উপর ফাউল করার ফলে ম্যাচ শেষের ৫ মিনিট পূর্বে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে চলে যেতে হয়েছিল।

১৯৮৬ এর বিশ্বকাপ

দিয়াগো ম্যারাডোনা: জনগণের হৃদয়ে যিনি সর্বকালের সেরা
ছবি: politicsnews24.com

মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ১৯৮৬ ফিফা বিশ্বকাপে মারাদোনা আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। ২৯শে জুন তারিখে, মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত ফাইনালে আর্জেন্টিনা পশ্চিম জার্মানিকে ২–১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়লাভ করেছিল। পুরো আসর জুড়ে, মারাদোনা আধিপত্য় বিস্তার করে খেলেছিলেন এবং প্রতিযোগিতার সবচেয়ে প্রগতিশীল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে প্রতিটি খেলার প্রতিটি মিনিট খেলেছিলেন; যেখানে তিনি ৫টি গোল এবং ৫টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন। মেক্সিকো সিটির অলিম্পিক বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচে তিনি তিনটি গোল করেছিলেন। পুয়েবলায় অনুষ্ঠিত ইতালির বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে মারাদোনা এই প্রতিযোগিতার প্রথম গোলটি করেছিলেন। পুয়েবলায় অনুষ্ঠিত প্রথম নকআউট পর্বে আর্জেন্টিনা উরুগুয়েকে পরাজিত করেছিল, যার ফলে তারা মেক্সিকো সিটির আসতেকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল, যেখানে মারাদোনা দুটি ঐতিহাসিক গোল করেছিলেন, যা তার কিংবদন্তির উপাধি অর্জন করতে সাহায্য করেছে। প্রথম গোলের পূর্বে বলটি তার স্পর্শ করেছিল, যা মারাদোনা প্রথমত অস্বীকার করেছিলেন। এই গোলটিই ‘হ্যান্ড অফ গড’ নামে পরিচিত। তবে এই বিতর্ক তিনি দূর করে ফেলেন মিনিট চারেক পরেই আরেকটি অসাধারণ গোল করে। মাঝমাঠে বল দখলে নেন ম্যারাডোনা, ইংল্যান্ডের গোলপোস্টের দিকে ঘুরে গিয়ে দৌড়ান মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ, এভাবে পাঁচ জন ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষককে কাটিয়ে গোল করেন তিনি। আর এই গোলটি গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এরপর সেমিফাইনালে আরো দুটি গোল করে একক কৃতিত্বে ম্যারাডোনা ফাইনালে ওঠান আর্জেন্টিনাকে। ফাইনালে তাকে ডাবল মার্কিংয়ে রাখায় গোল করতে না পারলেও তারই বাড়িয়ে দেওয়া পাসে আর্জেন্টিনার পক্ষে জয়সূচক গোল করেন বুরুচাগা। পুরো টুর্নামেন্টে পাঁচ গোলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ৫টি অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন ম্যারাডোনা। প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার ১৪টি গোলের ১০টিতেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল। এছাড়া পুরো টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে যতগুলো শট নিয়েছে, তার অর্ধেকের বেশিই ম্যারাডোনার তৈরি করা। কিন্তু এই পরিসংখ্যান দিয়েও ম্যারাডোনার কৃতিত্ব পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সেটা বোঝার জন্য আরো কিছু তথ্য দেওয়া জরুরি। প্রতিটি বিশ্বকাপ শেষেই বিশ্বকাপ কর্তৃপক্ষ ‘অলস্টার টিম’ নামে একটি একাদশ প্রকাশ করা হয়। বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করা খেলোয়াড়দের নিয়ে এই একাদশ গঠন করা হয়। মোটামুটিভাবে বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্ট দল থেকেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুযোগ পায়। এর মাঝে আবার স্বাভাবিকভাবে চ্যাম্পিয়ন দল থেকেই বেশি সদস্য সুযোগ পায়। ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮৬ সালে। সে বছর যে একাদশ প্রকাশ করা হয়, তাতে চ্যাম্পিয়ন দল থেকে মাত্র একজন সুযোগ পায় এই দলে, ম্যারাডোনা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল থেকে এরকম একটি একাদশে মাত্র একজন খেলোয়াড়ের সুযোগ পাওয়াটা এখন পর্যন্ত একটি রেকর্ড। এ ঘটনা থেকেই ম্যারাডোনার দলের বাকি সদস্যদের শক্তিমত্তা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

১৯৯০ এর বিশ্বকাপ

১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ছিল ভাঙাচোরা একটি দল। প্রথম পর্বে গ্রুপে তৃতীয় স্থানে থেকেও কোনোরকমে দ্বিতীয় পর্বের টিকেট পায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের। ব্রাজিলের সাথে আর্জেন্টিনার শক্তির ব্যবধান কেমন ছিল? ধরে নিন, ঢাল-তলোয়ার সহ ১০০ সৈন্য নিয়ে বন্দুক-বোমা সহ ৩০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতোই ব্যাপারটি। সবাই জানতো, ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারলেই আর্জেন্টিনা শেষ। শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ৮০ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে দুজনকে কাটিয়ে তিন জন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে ম্যারাডোনা যখন ক্যানিজিয়াকে পাস দেন, তখন ক্যানিজিয়ার সামনে গোলকিপার বাদে আর কেউ নেই। মূলত বাম পায়ের খেলোয়াড় হলেও, ম্যারাডোনা ক্যানিজিয়ার যে গোলে সহায়তা করেন, তা ডান পায়ে করেছিলেন। কারণ ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডাররা তাকে এমন অবস্থায় রেখেছিলেন যে, তিনি বাম পা ব্যবহারই করতে পারেননি!

দল দুর্বল হওয়ার কারণে ম্যারাডোনা খেলার কৌশলে পরিবর্তন আনেন সেবারে। রক্ষণাত্মক খেলে বেশিরভাগ ম্যাচ ট্রাইবেকারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়েই সেমিতে উঠে যায় আর্জেন্টিনা। সেই টুর্নামেন্টে ইতালি ছিল দুর্দান্ত এক দল। তাদের গোলকিপার ওয়াল্টার জেঙ্গার পরপর পাঁচ ম্যাচে গোল না খাওয়ার এবং সর্বমোট ৫১৮ মিনিট গোল না খেয়ে থাকার বিশ্বরেকর্ড করেন। তার উপর তারা ছিল স্বাগতিক, ১৯৯০ বিশ্বকাপের একমাত্র দল হিসেবে সবকটি ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল তারা। তাদের বিরুদ্ধে খর্ব শক্তির দল আর্জেন্টিনার কি কোনো তুলনা চলে? আর সেই অসম্ভব একতরফা ম্যাচটিও আর্জেন্টিনা জিতে যায় টাইব্রেকারে!

সেই ম্যাচের পর ফাইনালে জার্মানি ছিল দলগত বিচারে আর্জেন্টিনা থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। তারা ছিল সেই বিশ্বকাপে টানা তৃতীয়বারের ফাইনালিস্ট। অথচ সেই জার্মানিকেও কিনা জিততে হলো বিতর্কিত পেনাল্টিতে। আর সেই ম্যাচ সরাসরি দেখা অনেকই বিশ্বাস করেন, ট্রাইবেকারে গেলে হয়তো আর্জেন্টিনাই জিতে যেত ফাইনাল। সে ম্যাচে হেরে গিয়েও পুরো পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমী মানুষের চোখে নায়ক হয়ে যান ম্যারাডোনা।

১৯৯৪ এর বিশ্বকাপ

১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে ঘরের মাঠে কলম্বিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হারার পর পুরো গ্যালারি জুড়ে ছিল শুধু একটি নামই- ম্যারাডোনা। অবসর ভেঙে ‘৯৪ এর বিশ্বকাপে ফিরে এসে ম্যারাডোনা চমক দেখান। প্রথম দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনা অনায়াসে জয় পায়। এর মধ্যে প্রথম খেলায় গ্রিসের বিপক্ষে ম্যারাডোনা একটি গোল করেন। কিন্তু এরপরেই ডোপ কেলেঙ্কারিতে বাদ পড়তে হয় তাকে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় রাউন্ডে রোমানিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে পড়ে।

ম্যারাডোনার গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই তার বিপক্ষ দলের জানা ছিল, কেবল এক ম্যারাডোনাকে আটকাতে পারলেই চলবে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাকে প্রচুর ফাউলের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে ২৩ বার ফাউলের শিকার হন তিনি, যা বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ফাউল হবার রেকর্ড। আর ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে তাকে সর্বমোট ৫০ বার ফাউল করা হয়েছে, যা কিনা এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ফাউল হওয়ার রেকর্ড! এত কিছুর পরেও কিন্তু তাকে আটকানো যায়নি। বুকের উপর সরাসরি বুট দিয়ে মারার পরেও পেইনকিলার খেয়ে মাঠে নেমেছেন ম্যারাডোনা, সত্যিকারের নেতার মতো সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে।

গ্রেট খেলোয়াড়দের একটি অন্যতম গুণ হলো, তারা তাদের আশেপাশের খেলোয়াড়দের মাঝেও একটা আত্মবিশ্বাসের প্রেরণা ছড়িয়ে দেন। ১৯৯০ বিশ্বকাপের আগে গয়াকোচিকার নাম কেউ শুনেছে? তার ক্লাব ক্যারিয়ারও খুব একটা উজ্জ্বল ছিল না। অথচ ম্যারাডোনার ছোঁয়ায় তার মতো সাধারণ একজন খেলোয়াড়ও হয়ে উঠলেন অসাধারণ। আর্জেন্টিনার হয়ে ৫০ ম্যাচে মাত্র ১৬ গোল করা ক্যানিজিয়ার ক্লাব ক্যারিয়ারও ছিল সাদামাটা। কিন্তু ম্যারাডোনাকে পাশে পেলেই যেন অন্য রকম হয়ে যেতেন তিনি। ম্যারাডোনা দলে থাকলে দলের সবার ভেতর যে সাহস ফুটে উঠতো, তা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবেন না। এই কাজটি ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো আর কোন খেলোয়াড় করতে পেরেছেন ইতিহাসে? বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষভাবে খুঁজে দেখলে এমন খেলোয়াড় হয়তো পাওয়া অসম্ভবই হবে।

ক্লাব ক্যারিয়ার

ম্যারাডোনা ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে। সেখানে ১৬৭টি খেলায় ১১৫টি গোল করেন তিনি। এরপর তিনি চলে যান বোকা জুনিয়র্সে। এখানে তিনি লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। এখান থেকে ১৯৮২ সালে ম্যারাডোনা বার্সেলোনায় যোগ দেন।

বার্সেলোনা

১৯৮২ ফিফা বিশ্বকাপের পর জুন মাসে মারাদোনা স্থানান্তরের বিশ্ব রেকর্ড ৫ মিলিয়ন ইউরোর (৭.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিময়ে স্পেনীয় ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনায় যোগদান করেন। বার্সেলোনায় ম্যারাডোনা তার সর্বোচ্চ সফলতা পাননি। এখানে তিনি গোড়ালির ইনজুরিতে পড়েন। এছাড়া হেপাটাইটিসের সাথেও তাকে লড়াই করতে হয়। এত প্রতিকূলতার মাঝেও ম্যারাডোনা বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন। বার্সার হয়ে শেষ মৌসুমে মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য লিগ শিরোপা জিততে পারেননি ম্যারাডোনা। তবে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে জেতেন। এছাড়া একটা স্প্যানিশ সুপার কোপাও জেতেন তিনি। কিন্তু বার্সার হয়ে ম্যারাডোনার কৃতিত্ব আসলে অন্য একটি জায়গায়। ১৯৮৩ সালের ২৬ জুন বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদের খেলায় বিশ্ব নতুন এক জিনিস দেখতে পায়। বার্সা রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে তাদেরকে হারায়, তবে এটি ম্যাচের হাইলাইটিং পয়েন্ট না। ম্যাচে ম্যারাডোনা একটি গোল করেন। সেটিও বিশেষ কিছু নয়। বিশেষ কিছু হচ্ছে, গোলটা তিনি কীভাবে করলেন?

মাঝ মাঠ থেকে বল পাওয়ার পর তার সামনে ছিল কেবল গোলকিপার। গোলকিপারকে কাটিয়ে নেওয়ার পরে ফাঁকা পোষ্ট পেয়েও তিনি গোল করেননি! গোলটা করেন রিয়ালের আরেকজন এসে তাকে আটকানোর চেষ্টা করার পর। ম্যাচ শেষে রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকরা ম্যারাডোনাকে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানান, যা কিনা একজন বার্সেলোনা খেলোয়াড়ের জন্য প্রথম ছিল। এত কিছুর পরেও ম্যারাডোনা ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে ঘন ঘন বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি।

নাপোলি

ছবি: si.com

১৯৮৪ সালের ৫ই জুলাই তারিখে, মারাদোনা নাপোলিতে আসেন এবং নাপোলির খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে উপস্থাপিত হন, সান পাওলো স্টেডিয়ামে তার আগমনী অনুষ্ঠানে ৭৫,০০০ সমর্থক তাকে স্বাগত জানান। এই বিষয়ে ক্রীড়া লেখক ডেভিড গোল্ডব্লাট বলেছেন, সমর্থকরা নিশ্চিত ছিল যে তাদের ত্রাণকর্তা এসেছে । ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলি কখনোই ইতালির শীর্ষ ক্লাবের একটি ছিল না। ম্যারাডোনা আসার আগে কখনো লিগও জিততে পারেনি তারা। ১৯৬৮ এবং ১৯৭৫ সালে রানারআপ হওয়াই ছিল তখন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। তবে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে তারা চলে যায় পয়েন্ট তালিকার ১২ নম্বর পজিশনে। মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য রেলিগেশন থেকে বেঁচে যায় ক্লাবটি। এরকম এক ক্লাবে ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়ের আগমন কিছুটা বিস্ময়েরই। প্রথম মৌসুমে ম্যারাডোনা ১৪ গোল করলেও দুর্বল ডিফেন্সের কারণে নাপোলি লিগে ৮ম হয়। এর পরের মৌসুমে ম্যারাডোনা দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১১টি গোল করেন, সাথে নাপোলি উঠে আসে লিগ টেবিলের ৩ নম্বরে। পরের মৌসুমে নাপোলি জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরে আসে। বিশ্বকাপজয়ী ম্যারাডোনাও দলকে নিয়ে নতুন ভাবে নামেন মাঠে। আর এই মৌসুমেই নাপোলি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, যা তাদের ক্লাব ইতিহাসে প্রথম। এছাড়া ম্যারাডোনা থাকাকালীন তারা আরো একবার লিগ জেতে। একটি কোপা ইতালিয়া, উয়েফা কাপ আর একটি ইতালিয়ান সুপারকোপাও জেতে তারা। মাঝে ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ম্যারাডোনা লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

নাপোলিতে ৭ মৌসুম খেলে মাত্র ৫টি ট্রফি জয়কে আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ অর্জন মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, ম্যারাডোনা থাকাকালীন যে দু’বার নাপোলি লিগ শিরোপা জিতেছে, সেটাই তাদের একমাত্র অর্জন হয়ে রয়েছে। নাপোলি তাদের ইতিহাসে সর্বমোট ১০টি মেজর শিরোপা জিতেছে ,যার ৫টিই ম্যারাডোনার আমলে। আর নাপোলির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতাও ম্যারাডোনাই! নাপোলির ইতিহাসে ম্যারাডোনার অবদান কী, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। ম্যারাডোনার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নাপোলি তাদের ১০ নম্বর জার্সিটিকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে, এই জার্সি পরেই সেখানে খেলতেন ইতিহাসের এই জাদুময় ফুটবলার।

ড্রাগ টেস্টে পজিটিভ প্রমাণিত হয়ে ম্যারাডোনা ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে নাপোলি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর রিয়াল মাদ্রিদের মতো দল তার প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি যোগ দেন সেভিয়াতে। সেখানে ১ বছর খেলে চলে যান নিউ ওল্ড বয়েজে। সেখান থেকে আবার ফেরেন বোকা জুনিয়র্সে। এখান থেকেই ১৯৯৭ সালে অবসর নেন ম্যারাডোনা।
ম্যারাডোনার সময়ে তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আরেক গ্রেট মিশেল প্লাতিনি। তিনি ম্যারাডোনা সম্পর্কে বলেছিলেন,“আমি বল নিয়ে যা করতে পারি, দিয়েগো সেটা কমলা দিয়েই করতে পারবে!”
শুধু পুরস্কার দিয়ে বিবেচনা করলে ম্যারাডোনাকে মোটামুটি সাধারণ একজন খেলোয়াড়ই মনে হবে। কিন্তু ইতিহাস ম্যারাডোনাকে বিবেচনা করে ‘গ্রেট’ হিসেবেই, সেটাও ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দুজনের একজন হিসেবে। তার মানে, বিশেষজ্ঞরা ম্যারাডোনার কীর্তিগুলোকে ‘বিশেষ কিছু’ হিসেবেই বিবেচনা করেন।

গাড়ির রেসে ফেরারি গাড়ির সাথে অন্য গাড়িকেও প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। সব ড্রাইভারই তো ফেরারি গাড়ি পান না। অনেক রেসারকে ফেরারির চেয়ে অনেক সাধারণ মানের গাড়ি নিয়েই ট্র্যাকে নামতে হয়। ম্যারাডোনার কৃতিত্ব হচ্ছে এটাই যে, তিনি সাধারণ মানের গাড়ি নিয়ে ট্র্যাকে শুধু লড়াই করে যাননি, বরং সমসাময়িক অনেক ফেরারি গাড়ি সহ ভালো ড্রাইভারদের হারিয়ে দিয়েছেন।ম্যারাডোনার চেয়ে সমসাময়িক অনেক খেলোয়াড়েরই বল নিয়ে ছোটার গতি হয়তো বেশি ছিল, কোনো খেলোয়াড় হয়তো ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো ড্রিবলিং করতে পারতেন। কিন্তু এখানে পার্থক্যটা গড়ে দেয় প্রেশার, মানসিক চাপ। চাপের মধ্যে সবাই ভালো খেলতে পারেন না। চাপ থাকলে দেখা যায়, হিগুয়েনের মতো ভালো ক্লাবের ভালো খেলোয়াড়ও গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে বল বাইরে পাঠিয়ে দেন। বেকহামের মতো খেলোয়াড়, যিনি কিনা স্পট কিকের জন্য বিখ্যাত, তিনিই ইংল্যান্ডের হয়ে পরপর চারটি পেনাল্টি মিস করেন। অথচ অন্যান্য সময় ফ্রি কিক থেকে গোল করাটা বেকহামের কাছে ছিল যেন ‘ডাল ভাত’। চাপে থেকেও স্বাভাবিক খেলতে পারাটাই একজন খেলোয়াড়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তুলনামূলক দুর্বল দল নিয়েও এই কাজটি ম্যারাডোনার চেয়ে ভালো আর কে করতে পেরেছে ফুটবল ইতিহাসে?এখানেই ম্যারাডোনা আর সব গ্রেটের চেয়ে আলাদা, এ কারণেই তিনি গ্রেটদেরও গ্রেট !

পুরস্কার

১৯৯০ সালে আর্জেন্টিনার কোনেক্স ফাউন্ডেশন তাকে গত এক দশকে আর্জেন্টিনার ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক পুরস্কার ডায়মন্ড কোনেক্স পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে, মারাদোনা দাতব্য সংস্থার জন্য সান্তোস লাসিয়ারের সাথে একটি তিন পর্বের প্রীতি বক্সিং ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০০০ সালে মারাদোনা তার আত্মজীবনী ইয়ো সো এল দিয়েগো প্রকাশ করেন, যা আর্জেন্টিনার সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ে পরিণত হয়েছিল। দুই বছর পর মারাদোনা তার বই “কিউবার জনগণ এবং ফিদেল” হতে আগত অর্থ কিউবীয় রাজ্যে দান করেছিলেন। ২০০০ সালে তিনি ফিফা শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জয়লাভ করেছিলেন, যা ফিফার প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সাময়িকী এবং একটি বিচারকের ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছিল। মারাদোনা ইন্টারনেট ভিত্তিক এক জরিপেও জয়লাভ করেছিলেন, যেখানে পেলের ১৮.৫৩%-এর বিপরীতে তিনি ৫৩.৬% ভোট পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পূর্বে ফিফা একটি দ্বিতীয় পুরস্কার যোগ করেছিল এবং ফুটবল সাংবাদিকদের নিয়ে গঠিত একটি “ফুটবল পরিবার” কমিটি নিযুক্ত করেছিল, যারা পেলেকেও শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব প্রদান করেছিল। আইএফএফএইচএস (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স) ভোটেও পঞ্চম হয়েছেন মারাদোনা। ২০০১ সালে আর্জেন্টিনীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) মারাদোনার জন্য ১০ নম্বর জার্সি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ফিফার কাছে অনুমতি চেয়েছিল। ফিফা এই অনুরোধ মঞ্জুর করেনি, যদিও আর্জেন্টিনার কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে ফিফা প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তারা তা করবে। মারাদোনা বেশ কয়েকটি ভক্তদের জরিপে শীর্ষ স্থান অর্জন করেছিলেন, যার মধ্যে ২০০২ সালের ফিফার একটি জরিপ রয়েছে, যেখানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার দ্বিতীয় গোলটি বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল,এছাড়াও তিনি সর্বকালের চূড়ান্ত বিশ্বকাপ দল নির্ধারণের জন্য আয়োজিত একটি জরিপে সর্বাধিক ভোট পেয়েছিলেন। ২০১০ সালের ২২শে মার্চ তারিখে লন্ডন ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য টাইমস কর্তৃক ‘বিশ্বকাপে সর্বকালের সেরা ১০ খেলোয়াড়’ হিসেবে মারাদোনাকে এক নম্বর নির্বাচিত করা হয়েছিল। ২০০৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারিখে আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স মারাদোনার নামানুসারে তাদের স্টেডিয়ামের নামকরণ করেছে।

মৃত্যু

ম্যারাডোনার মৃত্যু
ছবি : bahumatrik.com

২০২০ সালের ২রা নভেম্বর তারিখে মানসিক কারণে মারাদোনাকে লা প্লাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল; সে সময় প্রাক্তন ফুটবলারের একজন প্রতিনিধি দল জানিয়েছিল যে তার অবস্থা গুরুতর নয়। একদিন পর, সাবডুরাল হেমাটোমার চিকিৎসার জন্য তার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। সফল অস্ত্রোপচারের পর ১২ই নভেম্বর তারিখে তাকে হাসপাতাল হতে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছিল এবং বহির্বিভাগের রোগী হিসেবে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৫শে নভেম্বর তারিখে ৬০ বছর বয়সে মারাদোনা আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আয়ার্স প্রদেশের তিগ্রেতে তার নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুর পর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা এবং মারাদোনার তিনটি ১০ নম্বর জার্সি (আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স এবং আর্জেন্টিনা) দ্বারা মারাদোনার কফিন মুড়িয়ে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ কাসা রোসাদায় রাখা হয়েছিল। ২৬শে নভেম্বর তারিখে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিততে মারাদোনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানটিতে ভক্তদের দ্বারা উক্ত স্থানের একটি অভ্যন্তরীণ উঠান দখল হওয়ার পর তাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে পর তার পরিবার কর্তৃক অনুষ্ঠানটি সংক্ষিপ্ত করে তার কফিনটি রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের রোতুন্দা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একই দিনে ব্যক্তিগতভাবে মারাদোনার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বুয়েনোস আইরেসের বেলা বিস্তার হারদিন দে বেয়া বিস্তা কবরস্থানে মারাদোনাকে তার বাবা-মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়েছে।

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বিবৃতিতে আর্জেন্টিনীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছিল যে, “আমাদের কিংবদন্তির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোক প্রকাশ করছি”, তিনি আরো বলা হয়েছিল: “আপনি সবসময় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন”। আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি আলবের্তো ফের্নান্দেস তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছিলেন। উয়েফা এবং কনমেবল পৃথক পৃথক ঘোষণায় জানিয়েছিল যে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, উয়েফা ইউরোপা লীগ, কোপা লিবের্তোদোরেস, এবং সুদামেরিকানা কাপের প্রতিটি ম্যাচ শুরুর পূর্বে এক মুহূর্ত নীরবতা পালন করা হবে। মারাদোনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বোকা জুনিয়র্সের খেলা স্থগিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে, সারা বিশ্বের অন্যান্য কনফেডারেশনগুলোও তার সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিল, যা ২০২০ এএফসি চ্যাম্পিয়নস লীগের খেলা থেকে শুরু হয়েছিল। ইতালির শীর্ষ স্তরের ফুটবল লীগ সেরিয়ে আ একটি মিনিটের নীরবতা পালন ছাড়াও খেলার ১০ম মিনিটে স্টেডিয়ামের পর্দায় মারাদোনার একটি ছবি প্রদর্শন করেছিল।

নাপোলিতে মারাদোনার সম্মানে রাতে স্টেডিয়াম সান পাওলোকে আলোকিত করা হয়েছিল। নাপোলির মালিক আউরেলিও দে লাউরেন্তিস এবং নাপোলির মেয়র লুইজি দে মাগিস্ত্রিস উভয়েই মারাদোনার নামে তাদের স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মারাদোনার মৃত্যুর পরের দিন রিয়েকার বিরুদ্ধে নাপোলির ইউরোপা লীগের ম্যাচের পূর্বে নাপোলির সকল খেলোয়াড় “মারাদোনা ১০” দেখা জার্সি পরিধান করার পাশাপাশি এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিলেন।[৩০৩] সারা বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনের ব্যক্তিত্বরাও তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ফুটবলের বাইরেও স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্য খেলাধুলার ক্রীড়াব্যক্তিরাও মারাদোনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

২০২০ সালের ২৭শে নভেম্বর তারিখে ভারতের কলকাতার বারাসাতের আদিত্য স্কুল অফ স্পোর্টস মারাদোনার নামে তাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নামকরণ করেছে। তিন বছর পূর্বে মারাদোনা এই স্টেডিয়ামে ১০০ জন শিশুকে নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন এবং প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে একই মাঠে একটি দাতব্য ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর্জেন্টিনীয় ফুটবল ফেডারেশন এক ঘোষণায় জানিয়েছিল যে ২০২০ কোপা দে লা লিগা প্রফেসিওনাল, যা কোপা দে লা লিগা প্রফেসিওনালের প্রথম মৌসুম, তার নাম পরিবর্তন করে কোপা দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা রাখা হবে। ২৮শে নভেম্বর তারিখে পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন জানিয়েছিল যে তাদের দ্বারা আয়োজিত প্রধান প্রতিযোগিতা পিএফএফ জাতীয় চ্যালেঞ্জ কাপে ওয়ালি মোহাম্মদের সাথে মারাদোনাকে সম্মান প্রদর্শন করা হবে। একই দিনে, আর্জেন্টিনা নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার রাগবি ম্যাচে হাকা পরিবেশন করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়ক স্যাম কেন মারাদোনার নাম এবং তার ১০ নম্বর জার্সি প্রদর্শন করেছিলেন। ২৯শে নভেম্বর তারিখে লা লিগায় বার্সেলোনা ৪–০ গোলে জয়লাভ করার ম্যাচে মেসি তার গোলটি মারাদোনার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট

Related posts

চিত্তরঞ্জন দাশ:উদার জাতীয়তাবাদের দিশারি

News Desk

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

News Desk

কুমার সাঙ্গাকারা : ক্রিকেটের সেই নিপাট ভদ্রলোক

News Desk

Leave a Comment