Image default
জীবনী

দালাই লামা – তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা

“সুখ এমন কিছু না যা সরাসরি তৈরী হয়, এটা আসে তোমার কর্মের দ্বারা”।

উক্তিটি আমার না। উক্তিটি দালাই লামার, যাকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে মান্য করা হয়। ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই তাক্তসের বর্তমান চীনে তিনি জন্মগ্রহন করেন। শান্তি প্রচার থেকে শুরু করে গৌতম বুদ্ধদেবের নৈতিক শিক্ষার জীবন যাপন প্রচারের জন্য প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য পর্যন্ত তিনি সুনাম কুড়ান। কিন্তু তার জন্মের পর থেকেই চলতে হয় এক কঠিন যাত্রার।

‘দালাইলামা’ পৃথিবীর ছাদে থাকা এককালের নিষিদ্ধ রাজ্য তিব্বতের ধর্মগুরুর পদবী। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ‘গেলুগ’ নামের যে শাখাটি প্রচলিত আছে, তার প্রধান ধর্মগুরুকে দালাইলামা নামে অভিহিত করা হয়। মোঙ্গলীয় ভাষায় ‘দালাই’ শব্দের অর্থ সমুদ্র আর সংস্কৃত ‘লামা’ শব্দের অর্থ গুরু বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। অর্থাৎ দালাইলামা শব্দটির পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় এমন এক শিক্ষক যার জ্ঞান বা আধ্যাত্মিকতা সমুদ্রের মতোই গভীর। অন্যদিকে দালাইলামাদের নামের সাথে গিয়াৎসু শব্দটি যুক্ত থাকে। যেমন বর্তমান দালাইলামার নাম তেনজিন গিয়াৎসু। তিব্বতীয় ভাষায় এই ‘গিয়াৎসু’ শব্দের অর্থও সমুদ্র। যে শব্দটি আসলে দালাইলামার সাথে অনেকটাই সমার্থক। কিন্তু তাহলে দালাইলামা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো কীভাবে? চলুন জেনে নিই কে এই দালাইলামা?

একটি আধ্যাত্মিক খেতাব ইতিহাস
ছবি: whatsnewlife.com

একটি আধ্যাত্মিক খেতাব ইতিহাস

তিব্বতি গেলুগপা বৌদ্ধধর্মের দালাই লামা একটি বংশ (তুলকু – বুদ্ধের তিনটি দেহের মধ্যে একটি), এটি ১৩১১ সাল থেকে শুরু হয়েছিল। তিব্বত বৌদ্ধধর্মের রীতিনীতি অনুসারে, দালাই লামা বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের মূর্ত প্রতীক।

সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ১৯৫৯ অবধি, দালাই লামারা তিব্বতের  শিক শাসক ছিলেন, তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে রাজ্যকে নেতৃত্ব দিতেন। এই কারণে, দালাই লামাকে আজ তিব্বতিবাসীদের আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিহ্যগতভাবে, একটি দালাই লামার মৃত্যুর পরে, সন্ন্যাসীরা তাত্ক্ষণিকভাবে অন্য একজনের সন্ধানে যান। একটি আকর্ষণীয় সত্য যে একটি ছোট ছেলে যিনি তার জন্মের কমপক্ষে 49 দিন পরে বেঁচে আছেন তিনি নতুন আধ্যাত্মিক নেতা হন।

সুতরাং, নতুন দালাই লামা মৃতের চেতনার শারীরিক মূর্ত প্রতীক এবং বোধিসত্ত্বের পুনর্জন্মের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্তত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন। একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে অবশ্যই মৃত দালাই লামার পরিবেশের লোকদের সাথে জিনিসগুলির স্বীকৃতি এবং যোগাযোগ সহ অনেকগুলি মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। এক ধরণের সাক্ষাত্কারের পরে নতুন দালাই লামাকে তিব্বতের রাজধানীতে অবস্থিত পোটালা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছেলেটি আধ্যাত্মিক এবং সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ যে ২০১৮ এর শেষে, বৌদ্ধ নেতা রিসিভারের পছন্দ সম্পর্কিত পরিবর্তনগুলি করার জন্য তার অভিপ্রায়টি ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর মতে, ২০ বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়া এক যুবক এক হতে পারেন। তদুপরি, দালাই লামা বাদ দেয় না যে এমনকি কোনও মেয়েও তার জায়গা দাবি করতে পারে।

দালাইলামার সাথে জড়িয়ে আছে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ইতিহাস
ছবি: roar.media

দালাইলামার সাথে জড়িয়ে আছে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের ইতিহাস

রাজা নামরি সংজেন এর হাত ধরে তিব্বত রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় সপ্তম শতাব্দীতে। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীতে সংজেন এর বংশধরেরা প্রতিবেশী চীন সাম্রাজ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আয়তন বাড়াতে থাকে। নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি মধ্য এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এই তিব্বত রাজ্য। প্রতিবেশী চীনের সাথেও বাড়তে থাকে সংঘর্ষ। তাই ৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বত চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাত এড়াতে শান্তিচুক্তি করে।

পঞ্চম শতাব্দীতে প্রথম তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার শুরু হয়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর আগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের তেমন প্রচার হয়নি। অষ্টম শতাব্দীতে রাজা ত্রাইসং দাস্তেন বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একে রাজধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেন। রাজার আমন্ত্রণে চীন আর ভারত থেকে বৌদ্ধভিক্ষুরা দলে দলে তিব্বতের রাজসভায় এসে যোগ দেন। পাশাপাশি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। কিন্তু তখনকার দিনে তিব্বতের অধিবাসীরা ‘বন’ নামক এক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।

লামা এবং দালাইলামা
ছবি: bbci.co.uk

লামা এবং দালাইলামা

তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসবিদদের মতে আভালোকিতেসাভ্রা নামক বুদ্ধের এক অনুসারী ছিলেন, যিনি হিমালয়ের পাদদেশের মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবেন বলে বুদ্ধকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তার অনুসারীরাই পরবর্তীতে তিব্বতের রাজার আমন্ত্রণে ভারতবর্ষ থেকে তিব্বতের লাসায় এসে বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর শিক্ষকেরা ‘লামা’ নামে পরিচিত ছিলেন। লামাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণ তার হাতেই শিক্ষাকেন্দ্রের সকল দায়িত্বভার অর্পিত থাকতো। তিব্বতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে একদিকে অখন্ড তিব্বত রাজ্যের পতন ঘটে, অন্যদিকে তিব্বতজুড়ে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রচারের কারণে ধীরে ধীরে প্রধান লামাদের হাতেই তিব্বতের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।

১২৭১ সালে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান চীনে প্রতিষ্ঠা করেন ইউয়ান সাম্রাজ্য। ধীরে ধীরে পরিধি বড় হতে থাকা ইউয়ান সাম্রাজ্যের দখলে আসে তিব্বতও। ১৫৬৯ সালে তৎকালীন ইউয়ান সম্রাট আটলান খান তৎকালীন তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মগুরু লামাদের প্রধান সোনাম গিয়াৎসুকে তার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তবে প্রধান লামা তার বদলে তার কয়েকজন শিষ্যকে আলটান খানের রাজদরবারে পাঠান। তার শিষ্যরা তাকে ফিরে এসে আলটান খান এবং তার রাজ্যসদস্যদের বৌদ্ধধর্মের ব্যাপারে আগ্রহের কথা জানায়। অবশেষে ১৫৭৭ সালে সোনাম গিয়াৎসু আটলান খানের রাজদরবারে আসেন। আটলান খান সোনাম গিয়াৎসুর জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দালাইলামা উপাধি দেন।

তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের বিশ্বাসীদের মতে প্রধান লামা ‘গেনদুন দ্রুপ’ এর তৃতীয়বার জন্ম নেন সোনাম গিয়াৎসুর মাধ্যমে। তাই সোনাম গিয়াৎসুকে মূলত আখ্যায়িত করা হয় তৃতীয় দালাইলামা হিসাবে। দালাইলামা উপাধির পাশাপাশি আটলান খান তিব্বতের শাসনক্ষমতার ভারও তাদের হাতেই অর্পণ করেন। ১৬৪২ সালে পঞ্চম দালাইলামা লবসাং গিয়াৎসুর সময়ে দালাইলামাদের ক্ষমতায় কিছু সংস্কার আনা হয়। এরপর থেকে ৩৭৫ বছর ধরে তিব্বতের প্রধান আধ্যাত্মিক আর ধর্মীয় গুরু হিসাবে তিব্বতের ক্ষমতার বিধিবিধান অপরিবর্তিতভাবে ন্যস্ত আছে দালাইলামাদের হাতে।

বর্তমান দালাইলামা
ছবি: banglanews24.com

বর্তমান দালাইলামা

বর্তমানে তীব্বতের দালাই লামা হচ্ছেন তেঞ্জিন গ্যাটসু (১৪তম দালাই লামা)। তাকে দালাই লামা বলেই ডাকা হয়। ১১ বছর বয়সে দালাই লামার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল হেনরিখ হেরার (বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান পর্বত আরোহী) এর সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে ১৯৩৯ সালে, হেনরিখ ও তার দল হিমালয় পর্বতে যাত্রা পথে ভারতীয় ফোর্স দ্বারা গ্রেপ্তার ও জেলখানায় বন্দী হন। ১৯৪৪ সালে সেখান থেকে তার বন্ধু পিটার অফস্নেইটার সহ পালিয়ে যান। একসময় তারা তিব্বতে পৌঁছান।

তেনজিন গায়াতসো নিজেকে একজন সাধারণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ১৯৩৫ সালের জুলাই উত্তর-পূর্ব তিব্বতের আমডোর টাক্টসরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রামে একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দুই বছর বয়সে, শিশুটির নাম, পরে ল্যামো ধোনডুপ, পূর্বের ১৩ তম দালাই লামার পুনর্জন্ম হিসাবে স্বীকৃত হয়েছিল, থুবটেন গায়তসো। বিশ্বাস করা হয় যে দালাই লামাগুলি অবলোকিতেশ্বর বা চেনেরজিগ, করুণার বোধিসত্ত্ব এবং তিব্বতের পৃষ্ঠপোষক। বোধিসত্ত্ব হলেন সমস্ত বুদ্ধিমান প্রাণীর কল্যাণে বুদ্ধত্ব অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত প্রাণীরা, যারা মানবতাকে সাহায্য করার জন্য পৃথিবীতে পুনর্জন্মের প্রতিজ্ঞা করেছেন।

বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা আর জীবন
ছবি: internet

বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা আর জীবন

প্রধান লামাদের অধীনে রাজধানী লাসায় ৬ বছর বয়সে বর্তমান দালাইলামার শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি বৌদ্ধ দর্শনের সর্বোচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ইতোমধ্যে ১৯৫০ সালে চীন তিব্বতের দখল নেয়। কিন্তু মার্চ ১৯৫৯ এ তিব্বতের জনগণ তাদের স্বায়ত্ত্বশাসন পুনরায় আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে এবং চীনের সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হাজারখানেক তিব্বতী জনগণ হতাহত হয়। দালাইলামাকে তার বাসস্থান পোতালা প্যালেস থেকে উৎখাত করা হয়। দালাইলামা তিব্বত থেকে ভারতে পাড়ি জমালে তাকে আশ্রয় দেয় ভারত সরকার।

সেই থেকে ভারতের ধর্মশালায় অবস্থান করছেন দালাইলামা। চীনের সাথে সংঘাত এড়াতে সবসময়ই সমঝোতা আর অহিংসার কথা বলে আসছেন তিব্বতের এই নেতা। ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকা হাজার হাজার তিব্বতি লামা আর লক্ষাধিক অনুসারীদের শান্তভাবে চীন সরকারের এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহবান জানিয়ে আসছেন এই নেতা।

মূলত সেসময় তিব্বতে বাহিরের কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এর কারণ তিব্বতিয়ানদের বিশ্বাস ছিল, তিব্বতের বাহিরের মানুষের প্রবেশের কারণে অশান্তির সৃষ্টি হবে, ক্ষতি হবে। কিন্তু পর্বতারোহী হেনরিখ ও তার বন্ধু পিটার অনাহার কষ্টে একরকম বিপদে পড়েই বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করে। পরে সেখানকার রাজ অধিবেশনে হেনরিখ আর তার বন্ধুর থাকার অনুমতি দেওয়া হয়।

দালাই লামার ধর্মীয় শিক্ষা
ছবি: tibetanjournal.com

দালাই লামার ধর্মীয় শিক্ষা

দালাই লামার ধর্মীয় শিক্ষা জীবন শুরু হয় মাত্র ৬ বছর বয়স থেকে। তার শিক্ষা জীবনে জানতে হয়েছিল যুক্তিবিদ্যা, তীব্বতিয়ান চিত্র কারুকার্য, সংস্কৃতি, ঔষুধ জ্ঞান, বৌদ্ধ দর্শন। অতি অল্পবয়সী দালাই লামার ধর্মীয় জ্ঞানের চেয়ে বাহিরের জীবন যাপন, এডভেঞ্চার, আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তির প্রতি বেশি আকর্ষন ছিল। বাড়ির চৌকাঠের বাইরে সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে পারতো না, পারতো না তার সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে। একা সময় কাটাতে হতো তাকে। কিন্তু সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় তার জীবনে হেনরিখ আসার পর। এই হেনরিখ একদিকে যেমন দালাই লামার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল, তেমনি দালাই লামাও। হেনরিখ বহির্বিশ্বের নানা তথ্য জ্ঞান দিতো দালাই লামাকে আর অন্যদিকে দালাই লামা ধর্মীয় শান্তি অনুশাসন দেখাতো হেনরিখককে। এছাড়া হেনরিখ তিব্বতে জলাধার, রাজধানী লাসার মানচিত্র, দালাই লামার উপদেষ্টা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছিল। তার রচিত “7 years in Tibet” বিখ্যাত একটি বই। এই বই তৎকালীন সময়ে তিব্বত সম্পর্কে দেখিয়েছিল বিশ্বকে।

দালাই লামার দিনকাল ভালোই চলছিলো। কিন্তু ১৯৫০ সালে শেষদিক থেকে গণচীন তিব্বতকে নিজের অধীকৃত ভূমি হিসেবে দাবি করে প্রচার চালাতে থাকে। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিয়ানদের স্বাধীকার আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তখন দালাই লামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় নেয় ও হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করে। সেখানেই ভূতপূর্ব স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

এরপর দালাই লামা বিভিন্ন জায়গাতে তার ধর্মীয় জ্ঞান, শান্তি প্রচার করেন। হয়ে উঠেন একজন বিখ্যাত বক্তা। দেশে বিদেশে ভ্রমণের সময় পরস্পর সৌহার্দ্যবোধ ও সন্মানের জন্যও তিনি আলোচিত হয়েছেন। ১৯৮৯ সালে দালাই লামা শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান তিব্বতের শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম ও বৈশ্বিক পরিবেশ সমস্যা নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচেষ্টার জন্য।

দালাইলামা কি নির্বাচিত হয়ে থাকেন ?
ছবি: roar.media

দালাইলামা কি নির্বাচিত হয়ে থাকেন ?

কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং একজন দালাইলামার মৃত্যুর পর এক আশ্চর্য প্রথা অনুসরণ করে খুঁজে বের করা হয় আরেকজন দালাইলামাকে। তিব্বতের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১৪ জন দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়েছে। তিব্বতের বৌদ্ধ ‘গেলুগ’ শাখার বিশ্বাস অনুসারে দালাইলামা একবার দেহত্যাগ করলেও তাদের বার বার র্জন্ম হয়। পৃথিবীর অনাগত মানুষকে বুদ্ধের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতেই তার এই পুনর্জন্ম। তাই একজন দালাইলামার মৃত্যুর সাথে সাথে তিব্বতের প্রধান লামারা একত্র হয়ে খোঁজ শুরু করেন নতুন দালাইলামারূপী শিশুকে। মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় খুঁজে বের করা শিশু দালাইলামাকে।

প্রধান লামাদের স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশ: একজন দালাইলামার মৃত্যুর পরেই প্রধান লামাদের কেউ একজন তাদের স্বপ্নে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাবার জন্য কী করতে হবে তার ইঙ্গিত পান। সেই অনুসারে কাজ করে শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করা হয়। ধোঁয়ার গতিপথ অনুসরণ করা: প্রধান লামাদের কেউ যদি স্বপ্নে কোনো নির্দেশ না পান তাহলে পূর্ববর্তী দালাইলামার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় যে ধোঁয়া নির্গত হয়, লামারা তার গতিপথ অনুসরণ করেন। সেই ধোয়ার গতিপথ অনুসরণ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নতুন জন্ম নেয়া শিশুর মধ্যে দালাইলামাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তারা।

‘লামও-লা-সো’ নামক এক সরোবরের পারে ধ্যান: যখন অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় শিশু দালাইলামাকে খুঁজে পাওয়া না যাবে, তখন লামও-লা-সো নামক পাহাড়ঘেরা এক সরোবরের পাড়ে ধ্যান শুরু করেন লামারা। ৫,৩০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ২ বর্গ কিলোমিটারের এই সরোবরের ব্যাপারে তিব্বতে প্রচলিত আছে অনেক রূপকথা।

তবে তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের মতে এই সরোবরের দেবী পালদেন লামো প্রথম দালাইলামাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি দালাইলামাদের পুনর্জন্মের ধারাকে অব্যাহত রাখবেন। তাই প্রধান লামারা শিশু দালাইলামার ব্যাপারে কোনোরূপ ইঙ্গিত পাওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত রাখেন সেই ধ্যান। ১৯৩৫ সালে বর্তমান ১৩ তম দালাইলামার মৃত্যুর পর তার পরবর্তী তেনজিন গিয়াৎসুকে খুঁজে বের করতে ৪ বছর ধ্যানরত ছিলেন প্রধান লামারা। ৪ বছরের মাথায় লামারা  তার ব্যাপারে অবহিত হয়ে তাকে খুঁজে বের করেন। শিশু দালাইলামাকে খুঁজে বের করার পর তার সামনে অন্যান্য জিনিসের সাথে পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কিছু জিনিস উপস্থাপন করা হয়। যদি সেই শিশু পূর্ববর্তী দালাইলামার ব্যবহৃত কোনো জিনিস বাছাই করে, তবেই তাকে পরবর্তী দালাইলামা হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে দালাইলামার এই অনুসন্ধান শুধুমাত্র তিব্বতেই সীমাবদ্ধ।

দালাই লামা নির্বাসনের চ্যালেঞ্জ
ছবি: dw.com

নির্বাসনের চ্যালেঞ্জ

শতাব্দী ধরে তিব্বতের মানুষ বিশুদ্ধ বিশ্বে একটি অনন্য সংস্কৃতি ও সুবিশাল স্কুল গড়ে তোলার পাশাপাশি বিশ্বের বাকি অংশ থেকে আপেক্ষিক বিচ্ছিন্নতায় বাস করতেন। হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নতা বিচ্ছিন্ন হয় এবং তিব্বত, তিব্বত সংস্কৃতি এবং তিব্বত বৌদ্ধধর্মকে বহিষ্কার করে হিমালয় থেকে ছিটকে যায় এবং সারা পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর পবিত্রতা, তাঁর নির্বাসনের সময় যখন তাঁর ২০ এর দশকে তখনও একযোগে বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল।

তিব্বত রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে তিব্বতের জনগণের সাথে কথা বলার দায়িত্ব তাদের ছিল এবং তারা তাদের নিপীড়নকে কমিয়ে দিতে পারে। তিব্বতের হাজার হাজার দশকের কল্যাণেও তাকে বিবেচনা করা হতো, যারা তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, প্রায়ই তারা যা করেছিল তা ছাড়া আর কিছুই না। তিব্বত থেকে তিব্বতীয় সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। পরের কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ জাতিগত চীনা তিব্বততে অভিবাসিত হবে, তিব্বতীরা তাদের নিজস্ব দেশে একটি জাতিগত সংখ্যালঘুকে পরিণত করবে।

তিব্বতি ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয় প্রান্তিককৃত ছিল। তিব্বতে বৌদ্ধধর্মকেও নির্বাসিত করা হয়েছিল। প্রধান স্কুলগুলির উচ্চ লামা তিব্বত ত্যাগ করে, এবং নেপাল ও ভারতে নতুন মঠ স্থাপন করে। দীর্ঘদিন তিব্বতি মঠ, স্কুল ও ধর্মের কেন্দ্রগুলিও ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। শতাব্দী ধরে তিব্বতে বৌদ্ধ ভৌগোলিকভাবে সীমিত এবং একটি শতাব্দী ধরে উন্নত হয়েছে এমন একটি অনুক্রমের সঙ্গে কাজ করা হয়েছে। তাই দ্রুত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার পরে কি তার সততা বজায় রাখতে পারে?

নির্বাসনে সরকার
ছবি: prothomalo.com

নির্বাসনে সরকার

১৯৫৯  সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর পবিত্রতা ও তিব্বতীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, যারা তাঁর সঙ্গে নির্বাসনে ছিলেন। ১৯৬০ সালে নেহেরু নিচু হিমালয়ের কংগ্রে ভ্যালিতে পাহাড়ের পাশে অবস্থিত ম্যাকলেওড গঞ্জ নামে উচ্চ ধর্মশালায় একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য তাঁর পবিত্রতাকে অনুমোদন করেছিলেন। এখানে তার পবিত্রতা তিব্বত নির্বাসিতদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা।

তিব্বতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ (সিটিএ), তিব্বত সরকারকে নির্বাসনে ডেকেছে, ভারতে তিব্বতীয় নির্বাসিতদের সম্প্রদায়ের জন্য সরকার হিসেবে কাজ করে। সিটিএ ধর্মশালায় ১,০০,০০০ টি বা তিব্বতিদের জন্য বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প সরবরাহ করে। তার পবিত্রতা দালাই লামা সিটিএর প্রধান নয় । তার দৃঢ় বিশ্বাসে, সিটিএ একটি নির্বাচিত গণতন্ত্র হিসেবে কাজ করে, একটি প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সহ। CTA এর লিখিত সংবিধান বৌদ্ধ নীতির উপর ভিত্তি করে এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার উপর ভিত্তি করে।

২০১১ সালে তার পবিত্রতা আনুষ্ঠানিকভাবে সমস্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অব্যাহতি দিয়েছিল; তিনি “অবসরপ্রাপ্ত,” তিনি বলেন। কিন্তু এটা কেবল সরকারি দায়িত্ব থেকে।

মিডিয়া স্টার
ছবি: zeenews.com

মিডিয়া স্টার

তার পবিত্রতা দালাই লামা এবং তার সবগুলোই দাঁড়িয়ে আছে, এবং তবু তিব্বতের পরিচয়টি একসঙ্গে আঠালো হয়। তিনি বিশ্বের বৌদ্ধধর্মের একজন রাষ্ট্রদূতও হয়েছেন। খুব কমই, তার পরিচিত, সম্মানীয় চেহারা বৌদ্ধধর্মের সাথে পাশ্চাত্যরা আরও আরামপ্রিয় বোধ করে, এমনকি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কি তা বোঝা যায় না তা সত্ত্বেও। দালাই লামা’র জীবনকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চলচ্চিত্রে স্মরণ করা হয়, একটি ব্র্যাড পিট অভিনয় করেন এবং অন্যটি মার্টিন স্কর্সেস পরিচালিত। তিনি বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বইয়ের লেখক। তিনি একবার ভ্যাগে একটি ফরাসি সংস্করণ অতিথি সম্পাদক ছিল। তিনি বিশ্বের ভ্রমণ করেন, শান্তি ও মানবাধিকারের কথা বলছেন, এবং তার জনসাধারণের উপস্থিতিগুলি দাঁড়িয়ে থাকা-ঘর-কেবলমাত্র জনসাধারণকে আঁকড়ে ধরে। ১৯৮৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

পঙ্কজ মিশ্র নিউ ইয়র্কের (“পবিত্র মানুষ: দালাই লামা আসলে কিসের জন্য দাঁড়াবেন?”) লিখেছেন, “যে কেউ একজন ‘বৌদ্ধ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী’ বলে দাবি করে, সেহেতু দালাই লামার বড় কার্বন প্যাটারপ্রিন্ট রয়েছে এবং প্রায়ই মনে হয় ব্রিটিনি স্পারস হিসাবে সর্বব্যাপী। ”

যাইহোক, তাঁর পবিত্রতা দালাই লামা এছাড়াও অবমাননার একটি উদ্দেশ্য। চীন সরকার তাকে চিরতরে অভিশাপ দেয়। পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা যারা প্রদর্শন করতে চায় তারা চীনের কোন lapdogs তার পবিত্রতা নিয়ে ছবি তুলতে চায় না। তবুও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যারা তার সাথে সাক্ষাত করতে সম্মত হন তাই আনুষ্ঠানিক সেটিংস এ, চীন  প্ল্যাকেট ।

চিন-ভারত সংঘাতের আবহে 'দলাই লামা'-কে ব্যবহার
ছবি: kalerkantho.com

চিন-ভারত সংঘাতের আবহে ‘দলাই লামা’-কে ব্যবহার

এর আগে চিন-ভারত সংঘাতের আবহে ‘দলাই লামা’-কে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টির ‘মেন্টর’ সঙ্ঘ পরিবার। মোদী সরকারে উদ্দেশে সঙ্ঘ পরিবারের প্রস্তাব, চিনকে কড়া জবাব দিতে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত করা হোক তব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামাকে। প্রসঙ্গত, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া দলাই লামা চিনের পয়লা নম্বর শত্রু।

দলাই লামার চিন বিরোধিতা

এদিকে লাদাখে চিনা আগ্রাসনের আবহেই দলাই লামা চিনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেনা। তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বেজিংকে ঠুকে বলেছিলেন, চিন তিব্বত দখল করতে পারলেও আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে লাদাখে আগ্রাসন দেখিয়েছে চিন। আর তিব্বতীরা কখনও তা মেনে নেবে না।

দালাই লামাকে নিয়ে হেনরিখের বিখ্যাত বই “7 years in Tibet” অবলম্বনে একই নামে মুভি রয়েছে। চাইলে দেখতে পারেন মুভিটি, যেখানে রয়েছেন জনপ্রিয় নায়ক ব্রাড পিট সহ আরো অনেকে। সবচেয়ে অবাককর ব্যাপার হলো, ব্রাড পিটকে এই মুভির জন্য সেইসময়ে চীনে প্রবেশ নিষিদ্ব ঘোষণা করা হয়। পরে অবশ্য তা কিছুটা শিথীল হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৬ সালে মুভি প্রচারের জন্য তিনি চীনে যেতে পেরেছিলেন। তবে যাই হোক, বই আর মুভি দুটিই স্পষ্টতর বিশ্ববাসীকে বুঝাতে পেরেছিল যে, দালাই লামা আর হেনরিখের বন্ধন ও তিব্বতের শান্তিপ্রিয় মানুষ আর জোরপূর্বক চীনের অংশীদারিত্ব।

এখন দালাই লামার বয়স ৮৪। আগের মত বক্তা আর নন। তিনি নিজে যেমন আলোচিত, তেমনি আলোচিত তার বিখ্যাত বই সমূহও যেমনঃ “The Art of Happiness”, “Freedom in Exile”, “Destructive emotions”, “The Universe in a Single Atom”, “The Books of Joy” প্রভৃতি।

 

সূত্র: উইকিপিডিয়া , রোয়ার মিডিয়া  , জীবন্ত জীবন

Related posts

সিদ্দিকুর রহমান : বলবয় থেকে দেশ সেরা গলফার

News Desk

ভগবান বিষ্ণুর রাম অবতার: নেপথ্যের কাহিনি

Sanjibon Das

বাস্তিয়ান শোয়েনস্টেইগার: এক জীবন্ত ফুটবলার গল্প

News Desk

Leave a Comment