Image default
জীবনী

জহির রায়হান : কলম-ক্যামেরাকে অস্ত্র বানানো এক কিংবদন্তির গল্প

জহির রায়হান নামটার সাথে আমরা বেশিরভাগ মানুষই পরিচিত হয়েছি তার রচিত ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস পড়ার মাধ্যমে। নবম-দশম শ্রেণিতে এই উপন্যাসটি আমাদের অনেকেরই পাঠ্য বিষয় ছিল। কিন্তু তিনি কেবলই একজন ঔপন্যাসিক নন। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য কিংবা আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রে কারো অবদানের কথা যদি বলা হয়, তবে সবার আগে উঠে আসবে জহির রায়হানের নাম। তিনি একাধারে ছিলেন একজন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক। বিনোদন ও সাহিত্য জগৎ ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছিল তার অসামান্য অবদান। পেশাদার জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তিনি বাঙালির উপর অত্যাচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনকালে তার অর্জন তাকে বাংলার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

জহির রায়হান
লচ্চিত্র পুরস্কার হাতে জহির রায়হান; ছবি : CodePen

তার লেখা বরফ গলা নদী, কাঁচের দেয়াল, আরেক ফাল্গুন, হাজার বছর ধরে, একুশের গল্প যেন বারবার হাহাকার তুলতে বাধ্য পাঠক হৃদয়ে। ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৫ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে তিনি নিগার সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামে ডকুমেন্টারি তৈরি করে একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা পুরো পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বকে জানান দিয়েছিল। উনার সব সৃষ্টিই যেন অমর, তবুও পাঠক এবং সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এখানে উনার তিনটি অমর সৃষ্টি নিয়ে লিখতে চাই।

জন্ম, শিক্ষাজীবন ও পারিবারিক তথ্য 

জহির রায়হানকে স্মরণ করলে প্রথমেই এই কথাটাই মনে আসবে, জহির রায়হান একজন দ্যুতিময় আলোক বিচ্ছুরণ। জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন।

জন্ম, শিক্ষাজীবন ও পারিবারিক তথ্য
প্রথম স্ত্রী সুমিতা দেবী ও ছেলের সাথে জহির রায়হান; ছবি : IMDB

তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

কর্মজীবন 

জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি যে নদী মরুপথেতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন।

প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা
প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা; ছবি : wikipedia

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়াতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

সাহিত্যিক জীবন

কলকাতায় ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের প্রভাবে জহির রায়হান প্রথম রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসেন। এসময় তিনি কলকাতায় রাস্তায় রাস্তায় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা বিক্রি করতেন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য। ছোটবেলা থেকেই তার বই পড়া ও লেখালেখির অনেক শখ ছিল। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি যখন হাইস্কুলের ছাত্র, তখন ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও’ নামে প্রথম তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তৎকালীন নিরীহ বাঙালিদের ওপর চলমান অত্যাচারের চিত্র তার কবিতায় ফুটে ওঠে।

“ওদের জানিয়ে দাও,

ওরা আমার ভাই-বোনকে কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে

ওদের স্টীম রোলারের নিচে

ওদের জানিয়ে দাও

ওরা দেখেও যদি না দেখে

বুঝেও যদি না বোঝে”

অল্প বয়সেই জহির রায়হান কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তিনি কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। গোপন পার্টিতে তাঁর নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। তার আসল নাম ছিল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। দেশের প্রতি জহির রায়হানের যে ভালোবাসা এবং পাকিস্তানিদের প্রতি যে ঘৃণা তা পরবর্তীতে তার বিভিন্ন লেখায় এবং চলচ্চিত্রে বার বার প্রকাশ পেয়েছে।

১৯৬৩ সালে তার উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ চিত্রালী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর সেই অতি পরিচিত উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭১ সনে। গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা ও সাংসারিক টানাপোড়েন কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এখানে। এই উপন্যাসের জন্য জহির রায়হান ইংরেজি ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান।

জহির রায়হান
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ফিল্ম ফেস্টিভালে বক্তব্য পেশ করছেন; ছবি : IMDB

ভাষা আন্দোলন কে কেন্দ্র করে লেখা তার উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি তিনি কারাগারে বসে লিখেছিলেন। কারণ জহির রায়হান ছিলেন সবসময় পাকিস্তানিদের বিপক্ষে এবং ভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্যই তাকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর ‘বরফ গলা নদী’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭৬ সনে, এটি উত্তরণ পত্রিকায় প্রথমে প্রকাশিত হয়। ‘তৃষ্ণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা ছিল এই বইটিতে। অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্মকথা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘আর কতদিন’। বইটির নামের মধ্যেই যেন লেখক প্রকাশ করেছেন এক তীব্র আকুতি! এরপর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। জহির রায়হান তার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে ৮ টি উপন্যাস ও ২১ টি গল্প লিখেছেন।

লেখার সংখ্যা কম হলেও সাহিত্যের মান নিয়ে কোন আপস দেখা যায়নি তার লেখায়। এছাড়াও জহির রায়হানের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে;

পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (প্রবন্ধ); এটি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘পরিচয়’ সাহিত্যপত্রের বাংলাদেশ সংখ্যায় (জুলাই ১৯৭১) এ প্রকাশিত হয়।
অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র (প্রবন্ধ), সোভিয়েত বিপ্লবের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব উদযাপন কমিটির (ঢাকা) স্মরণিকা ‘তরঙ্গ’-এ (নভেম্বর, ১৯৬৭) প্রকাশিত হয়।
জহির রায়হান রচনাবলি ১ম খণ্ড
জহির রায়হান রচনাবলি‌‌ ২য় খণ্ড

উপন্যাস

• শেষ বিকেলের মেয়ে (১৯৬০) প্রথম উপন্যাস। প্রকাশক: সন্ধানী প্রকাশনী (রোমান্টিক প্রেমের উপাখ্যান)
• হাজার বছর ধরে (১৯৬৪) আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত আখ্যান। (চলচ্চিত্ররূপ (২০০৫)
• আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯) বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কথামালা।
• বরফ গলা নদী (১৯৬৯) প্রথম প্রকাশ: ‘উত্তরণ’ সাময়িকী। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা।
• আর কতদিন (১৯৭০) অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্মকথা।
• কয়েকটি মৃত্যু
• একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০)
• তৃষ্ণা (১৯৬২)

জীবন থেকে নেয়া 

‘জীবন থেকে নেয়া’ তার এক অমর সৃষ্টি। ১৯৭০ সালে এর ১০ এপ্রিল এটি মুক্তি পায়। চিত্রায়নের পর কলকাতায় তিনি কয়েকটি প্রদর্শনী করিয়েছিলেন। প্রদর্শনীতে প্রাপ্ত অর্থ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ তহবিলে দান করেছিলেন। তার অনবদ্য চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন অস্কার বিজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এছাড়াও মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক সহ অন্যান্য প্রথম সারির পরিচালকরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন এই চলচ্চিত্র দেখে।

জীবন থেকে নেওয়া'
জহির রায়হানের সর্বাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেওয়া’ এর পোস্টার; ছবি : CodePen

একুশের গল্প

জহির রায়হানের আরেক অমর সৃষ্টি ‘একুশের গল্প’। এই গল্পের তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকা তপু আর রেণু ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু সংসার নামক জীবনে প্রবেশের আগেই হারিয়ে যায় তপু। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজপথে মিছিলে থাকা অবস্থায় তপু পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিখোঁজ হয়।

হাজার বছর ধরে (Symphony of Agony)

রাত বাড়ছে হাজার বছরের পুরনো সেই রাত। আবহমান বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনবোধ, জীবন দর্শন এবং জীবন অনুভূতিকে উপজীব্য করে সত্যিই এক কালজয়ী উপন্যাসের চরিত্র লিখনশৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার জহির রায়হান। এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপায়ন করেন জহির রায়হানের সহধর্মিণী কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। চলচ্চিত্রটি ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে ২০০৫ সালে মরণোত্তর পুরস্কার লাভ করেন জহির রায়হান।

হাজার বছর ধরে
জহির রায়হানের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্ৰাপ্ত চলচ্চিত্র; ছবি : facebook

সমগ্র বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি কলকাতায় চলে যান। তিনি সে সকল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও দেশের স্বাধীনতা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কলকাতায় থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচার অভিযান শুরু করেন। ভারত ও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। এসময় চরম অর্থকষ্টে থাকা সত্ত্বেও নিজের লেখা ও চলচ্চিত্র থেকে আয় করা টাকা মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে দান করেন। বিভিন্ন স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণা চালান।

পটুয়া কামরুল হাসান, জহির রায়হান ও অজয় রায়
কলকাতায় ১৯৭১ সালে এক প্রতিবাদ সমাবেশে (বাঁ থেকে) পটুয়া কামরুল হাসান, জহির রায়হান ও অজয় রায়; ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি প্রোপ্যাগান্ডা অনেক অপপ্রচার শুরু করে। এসব দেখে ক্ষুদ্ধ হয়ে তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার এই প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ পৃথিবীব্যাপী অনেক সাড়া ফেলে। এই প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতা সম্পর্কে বাইরের দেশগুলোতে ঘরে ঘরে মানুষ জানতে পারে। জহির রায়হান রাতারাতি দেশের বাইরে অনেক পরিচিতি পেয়ে যান। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তখন তার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করে। নিচে কলকাতার একটি পত্রিকায় জহির রায়হানের দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে।

স্টপ জেনোসাইড
বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর একটি দৃশ্য; ছবি :Daily Sun

“আমি জহির রায়হান। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। আমি কেবল একজন লেখক এবং চলচ্চিত্রকার। কিন্তু আমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় দেখেছি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো আমি কিছু পাকিস্তানি মিলিটারিদের একটা অপারেশনের সময় একটা মুভি ক্যামেরা হাতে রাস্তায় চলতে দেখতাম। তারা মানুষ গুলি করে মারার পর সেই মুভি ক্যামেরা দিয়ে মৃত লাশগুলোর ভিডিও চিত্র নিতো। ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পর সেগুলোর ভিডিও চিত্র নিতো। তারা কিছু বাঙালিকে একত্র করে একটা দোকান লুট করতে বাধ্য করে। নিজেদের মুভি ক্যামেরা দিয়ে তারা সেই লুট করার ভিডিও চিত্র ধারণ করে। এরপর আমি শুনেছি এবং পরে নিজে দেখেছি যে তারা এই ধারণকৃত অংশগুলো ইডিট করে। এই ইডিট করা ভিডিওগুলো প্রেসে ছেড়ে দিয়ে বলে যে, বাঙালিরা অবাঙালিদের হত্যা করা শুরু করেছে। এই অরাজক ও বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাদের (মিলিটারিদের)রাস্তায় নামতে হয়েছে। এটি ছিল পুরোপুরি একটা মিথ্যা বানোয়াট কথা।”

নিখোঁজ ভাইয়ের খোঁজে একদিন বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জহির রায়হান ঢাকায় ফেরেন। ফিরে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাক হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট চলার সময় রাজাকার আল বদর বাহিনী তার বড় ভাই প্রখ্যাত লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করেছে। মানুষ যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ার কাজে ব্যস্ত, তখন তিনি বিভিন্নভাবে নিখোঁজ ভাইকে খোঁজার অভিযান শুরু করেন। ১৯৭২ সালের ২৮শে জানুয়ারি সকালে এক রহস্যময় ব্যক্তি তাকে ফোন করে জানান যে, তার ভাইকে মিরপুর ১২ নাম্বারে একটি হাউজিং সেক্টরে আটকে রাখা হয়েছে। একথা শুনেই তিনি ভাইয়ের খোঁজে মিরপুর যান এবং আর ফিরে আসেননি।

জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে অনেক ধরনের থিওরি রয়েছে। এমন বলা হয় যে, তিনি একটি সার্চ পার্টি নিয়ে মিরপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পাক হানাদার বাহিনীর কিছু সদস্য ছদ্মবেশে ছিল। তারা তাকে লুকিয়ে আটক করে হত্যা ও গুম করে ফেলে। তার ছোট ভাই হাবীবের ভাষ্যমতে, তিনি জহির রায়হানকে মিরপুর পুলিশ স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। এরপর আর তার দেখা পাননি। এমন খবরও শোনা যায় যে মিরপুর পুলিশ স্টেশন থেকে জহির রায়হানকে জানানো হয়েছিল, মিরপুর ১২ নাম্বারে কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে। সেখানে না গিয়ে আগে তাকে কল ট্রেস করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর তিনি নাকি ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে যান। আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় আরো অনেক গুজব ছড়িয়েছে, যা আদৌ সত্যি না মিথ্যা, কেউ জানে না। তার মৃতদেহও কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার নিখোঁজ হওয়ার কোনো তদন্তের দিকেও কেউ কখনো আলোকপাত করেনি।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তার মৃত্যুদিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেদিন তিনি রহস্যময় ফোনকলটি বিশ্বাস না করে যদি ঘরে থেকে যেতেন, তাহলে হয়ত বাঙালি এই কিংবদন্তিকে এত অল্প বয়সে হারাতো না। আমরা হয়ত আরো অনেক কালজয়ী উপন্যাস এবং চলচ্চিত্র পেতাম।

পুরস্কার 

জহির রায়হান বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য নিম্নোক্ত পুরস্কারসমূহ লাভ করেন

• ১৯৬৪: হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
• ১৯৬৫: কাচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার
• ১৯৭২: গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার – ১৯৭১ (মরণোত্তর)
• ১৯৭৭: শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (মরণোত্তর)
• ১৯৯২: সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর)
• ২০০৫: হাজার বছর ধরে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর)

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, গুণীজন, বায়োগ্রাফি

Related posts

মডেল এলেন ঘোড়ায় চড়ে

News Desk

কিলিয়ান এমবাপে : ফরাসী ফুটবলের নতুন সেনসেশন

News Desk

মৌসুমী হামিদ জন্ম,পেশা,কর্মজীবন,অ্যাফেয়ার্স,ফেইসবুক,ফ্যামিলি

News Desk

Leave a Comment