ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা—এ কথায় যদি কারও আপত্তি থাকে, তবে তাঁকে দেখিয়ে দিলেই চলত। ব্যাকরণ ভুলে যাওয়া ব্যাটসম্যানদের যুগে তাঁর ব্যাটিংই স্বস্তি দিত সবাইকে। চোখ ধাঁধানো সব ড্রাইভ, কাট, পুল সটে দেড় দশক ধরে মাতিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্ব। তিন ধরনের ক্রিকেটেই তিনি ছিলেন অসামান্য। এই কিংবদন্তি শুধু তাঁর সময়ের নয়, সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। তিনি আর কেউ নন, ‘দ্য ওয়ান এন্ড অনলি কুমার সাঙ্গাকারা।’
কুমার সাঙ্গাকারা বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে এক পরিচিত নাম ,তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হয় | ক্রিকেটের দুনিয়ায় সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শট কোনটি? শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভ নাকি রিকি পন্টিং এর পুল ? ধোনীর হেলিকপ্টার শট নাকি দিলশানের ডিল স্কুপ? লারার লেট কাট নাকি রাহুল দ্রাবিড়ের পারফেক্ট ডিফেন্স?
এসব নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকতে পারে ঠিকই তবে অফসাইডে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন কাভার ড্রাইভ কার এ ব্যাপারে প্রায় সব ক্রিকেটপ্রেমী-ই একমত। তাবৎ দুনিয়ার বাঘা বাঘা বোলারদের চোখের পলকে এক পা মাটিতে গেড়ে বসে সীমানা ছাড়া করেছেন এই শ্রীলঙ্কান মহারথী। এতোক্ষণে হয়তো পাঠকের মনেও ভেসে উঠেছে সেই শৈল্পিক কাভার ড্রাইভটি। কাভার ড্রাইভের স্রষ্টা, শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তী বাহাতি উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান দ্যা গ্রেট কুমার সাঙ্গাকারার সম্পর্কে বাংলা ডায়েরির আয়োজন |
কুমার সাঙ্গাকারার শৈশবকাল
১৯৭৭ সালের ২৭শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ,ক্যান্ডি শহরের নিকটবর্তী মাতালে তে | তাঁর পিতার নাম ছিল স্বর্ণকুমারা সাঙ্গাকারা এবং মাতার নাম ছিল আনুশকা সুরাঙ্গানা। পরবর্তীতে পরিবারসহ ক্যান্ডিতে শিফট হোন স্বর্ণকুমার সাঙ্গাকারা এবং ছেলেকে সেখানকার ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। ছোটোবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ এবং পারদর্শী কুমার। তার পিতা চোসকানন্দ সাঙ্গাকারা একজন সম্মানিত আইনজীবী ছিলেন। সুরম্য ক্যান্ডি লেকের পাশে একটি বাড়িতে বাস ছিল সাঙ্গাকারা পরিবারের। তরুণ সাঙ্গাকে মুক্তমনা হয়ে বেড়ে উঠতে এবং বহুমুখী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে উত্সাহিত করতেন তার পিতা।
তার দুই বোন তুষারী ও সরঙ্গা এবং বড় ভাইয়ের নাম বেমেন্দ্র। কিশোর বয়সেই সাঙ্গাকারা বেশ কয়েকটি খেলা খেলতে শুরু করেছিলেন; জুনিয়র স্কুলে ব্যাডমিন্টন, টেনিস, সাঁতার, টেবিল টেনিস এবং ক্রিকেট। অল্প বয়সেই ব্যাডমিন্টন এবং টেনিসের জন্য তিনি জাতীয় পুরষ্কার জিততে সক্ষম হয়েছিলেন।
ট্রিনিটি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ লিওনার্ড ডি আলুইস সাঙ্গার ক্রিকেট প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সাঙ্গার মাকে উৎসাহও দিয়েছিলেন ছেলের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দিকে নজর দিতে। কোচ উপনন্দ জয়সুন্দেরার অধীনে তিনি তার স্কুলের অনূর্ধ্ব -১৩ ক্রিকেট একাদশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বার্টি উইজেসিংহে অনূর্ধ্ব -১৫, অনূর্ধ্ব -১৭, অনূর্ধ্ব -১৯ এবং প্রথম একাদশের স্কোয়াডে সাঙ্গাকারাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ১৯ বছর বয়সে তার ব্যতিক্রমী ব্যাটিং ও উইকেটরক্ষার দক্ষতার জন্য ট্রিনিটির খেলোয়াড়দের জন্য সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘দ্য ট্রিনিটি লায়ন’ পেয়েছিলেন।
সাঙ্গা স্কুলের সিনিয়র প্রিফেক্ট (প্রধান বয়) ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে আর্টস স্ট্রিমে অ্যাডভান্সড লেভেল পরীক্ষা দিয়েছিলেন। শিক্ষা এবং কো-কারিকুলার এক্টিভিটিসে অল-রাউন্ড পারফর্মেন্সের জন্য তিনি ট্রিনিটি কলেজের সর্বোচ্চ সম্মান, রাইড গোল্ড মেডেলও পেয়েছিলেন। স্কুল শেষে সাঙ্গা কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে ভর্তি হন, তবে ক্রিকেটের প্রতি তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার কারণে ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি। সাঙ্গাকারা একজন কোরিস্ট ছিলেন এবং স্কুলে থাকাকালে তিনি বেহালা বাজাতেন।
কুমার সাঙ্গাকারার খেলোয়াড়ী জীবন
শ্রীলঙ্কা-এ দলে প্রথম বার সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৯৮-৯৯ সিজনে দক্ষিণ আফ্রিকা-এ দলের বিপক্ষে সিরিজে। এরপর জিম্বাবুয়ে-এ দলের বিপক্ষে অপরাজিত ১৫৬ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই ইনিংসের পরেই নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান কুমার সাঙ্গাকারা, যার ফলে ২০০০ সালে অনুষ্ঠেয় সিঙ্গার ত্রিদেশীয় সিরিজে গলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক ঘটে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। অভিষেক ওয়ানডেতে গ্লাভস হাতে একটি ক্যাচ ও ব্যাট হাতে ৩৫ রান করেন তিনি। পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৮৫ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে দলকে ৯৭ রানের জয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যাচসেরার পুরস্কারটিও পেয়ে যান সাঙ্গাকারা। ফলস্বরূপ সেই মাসেই গলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে তার।
২০ জুলাই, ২০০০। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম ম্যাচে টেস্ট অভিষেক হয় ২২ বছর বয়সী সাঙ্গার। শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি জিতেছিল এবং একমাত্র ইনিংসটি সাঙ্গাকারা তৃতীয় উইকেটের পতনে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। নিকি বোজের বলে লেগ বিফোর উইকেট হওয়ার আগে করেছিলেন ২৩ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেকের সময় তিনি ৩৫ রান করেছিলেন এবং ২000 সালে সিঙ্গার ট্রাই নেশন সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কার পেয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেছিলেন ৮৫ রান। এভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আসন্ন টেস্ট সিরিজের জন্য নিজের জায়গাটি সুরক্ষিত করেন; ৬৬.৫ গড়ে ১৯৯ রান দিয়ে সিরিজটি শেষ করেছিলেন। ওয়ানডেতে তার জার্সি নং ১১।
নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির আগে 90 এর ঘরে আউট হয়েছিলেন দু’বার, একবার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরেকবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০০১ এর আগস্টে ভারত তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কা আসে এবং এই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সাঙ্গাকারা টেস্টে তার প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন। তিন নম্বরে নেমে তার খেলা অপরাজিত ১০৫ রানের সেই ইনিংসটি শ্রীলঙ্কাকে দশ উইকেটের এক বিশাল জয় এনে দিয়েছিল।
পরে সেই বছর সাঙ্গাকারা তার দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরিও তুলে নিয়েছিলেন, এবারও সফরকারী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের বিপক্ষে তিন ম্যাচের প্রথম ম্যাচেই। ২০০২ সালে তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেন। তার ব্যাটই সেবার শ্রীলঙ্কাকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছিল।
২০০৩ সালের এপ্রিলে, সাঙ্গাকারা পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছিলেন, যদিও ম্যাচটি হেরেছিল লঙ্কানরা। মারভান আতাপাত্তুর সাথে ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪৪৮ রানের জুটি গড়েন সাঙ্গা। সেই খেলায় তিনি করেছিলেন ২৭০ রান, এটিই তার প্রথম ২৫০+ স্কোর। জুলাই ২০০৫-এ, সাঙ্গা আইসিসি ওয়ার্ল্ড ইলেভেন ওয়ানডে দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা যখন বাংলাদেশ সফর করেছিল, তখন নিয়মিত অধিনায়ক মারভান আতাপাত্তু ইঞ্জুরড থাকার কারণে অধিনায়কের দায়িত্ব পান মাহেলা জয়াবর্ধনে। আর প্রথম বার কুমার সাঙ্গাকারাকে সহ-অধিনায়ক করা হয়।
পাকিস্তান ২০০৬ এর মার্চ মাসে দু’টি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে খেলতে শ্রীলঙ্কা সফরে যায় এবং এখানেও মাহেলা–সাঙ্গাকারা জুটিই অধিনায়কত্বের দায়িত্বে বহাল থাকেন। এই জুটি কেবলমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন সময়টুকুতেই এই পদে অধিষ্ঠিত থাকতে চেয়েছিল। তবে তৃতীয় বারের মতো সিরিজে এটির সময়সীমা বাড়ানো হয় কারণ আটপট্টু এপ্রিল মাসেও ইংল্যান্ড সফরে যেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
জুলাই, ২০০৬। সেবার শ্রীলঙ্কায় খেলতে আসে সাউথ আফ্রিকা। সেবার মাহেলার সাথে মিলে গড়েন ৬২৪ রানের ম্যারাথন জুটি। পাক্কা দুইদিন ধরে ব্যাটিং করেছিলেন তাঁরা।দ্রুততম ৮০০০, ৯০০০, ১১০০০, ১২০০০ রানের মালিক তিনি। তিন নম্বরে নেমে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির(৩৭) মালিক তিনি। তিন নম্বরে সবচেয়ে বেশি রানের মালিকও তিনি। যে তিন নম্বরকে ধরা হয়ে থাকে ব্যাটিং পজিশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পজিশন, সেখানেই ১১০০০-র উপর রান। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান। বিশ্বকাপে টানা চার সেঞ্চুরি। এক পঞ্জিকাবর্ষে ২৮৬৮ রান! কিংবদন্তি মানদন্ডে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেবার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার ক্রিকেট ইতিহাসে। টেন্ডুলকারের ঠিক পরে।
২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি আইসিসি টেস্ট প্লেয়ার র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ স্থান অর্জন করেন ৯৩৮ রেটিং নিয়ে। যেকোনো শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়ের প্রাপ্ত সর্বোচ্চ রেটিং এবং টানা চারটি টেস্টে ১৫০ এর বেশি রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান তিনি।
ওয়ান্ডেতে তার সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ২০০৫ সালের অক্টোবরে ওয়ার্ল্ড ইলেভেনের হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় জনি ওয়াকার সিরিজ খেলার পর। ওয়ার্ল্ড ইলেভেন বড় ব্যবধানে সবকটি ম্যাচ হেরে গেলেও সাঙ্গাকারা তার প্রতিভার ছাপ রেখেছিলেন পুরো সিরিজ জুরে। ২০০৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোবার্টে ১৯২ রানের এক দানবীয় ইনিংসে নিজের জাত আরেকবার চেনান কুমার।
টেস্ট ক্রিকেটে অসামান্য ব্যাটিংয়ের জন্য ২০০৮ সালের উদ্বোধনী ক্রিকইনফো পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সাঙ্গাকারা টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম ৮ হাজার, ৯ হাজার, ১০ হাজার (যৌথভাবে), ১১ এবং ১২ হাজার রানের ক্লাবে ঢোকার অনন্য রেকর্ড গড়েন।
২০০৯ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কান দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় সাঙ্গাকারাসহ শ্রীলঙ্কার ৬ জন খেলোয়াড় আহত হয়। সাঙ্গাকারা কাঁধে আঘাত পেয়েছিলেন। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে সাঙ্গাকারা আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট একাদশে জায়গা পান। পরের বছর তিনি ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবে যোগদানের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। একই বছর টেস্টে পরপর দুইটি ডাবল সেঞ্চুরি করেন এবং ইতিহাসের ৫ম ক্রিকেটার হিসেবে এই মাইলফলক স্পর্শ করেন। সাঙ্গাকারার ক্যারিয়ারে তার সতীর্থ মাহেলা জয়াবর্ধনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। ‘কুমার-মাহেলা’ এমন এক জুটি যা শ্রীলঙ্কাকে টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব এনে দিয়েছে এবং একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছিয়েছে দুইবার।
‘কুমার ও মাহেলা’ শব্দ দুটি একে অপরের সাথে প্রায় মিশে গেছে এবং এমন একটি সত্তায় পরিণত হয়েছে যা শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট অনুরাগীদের সপ্ন দেখিয়েছে, সান্ত্বনা দিয়েছে আবার ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসনও করেছে। ৫৫০ ম্যাচ একসাথে খেলেছেন এই দুজন কিংবদন্তী। সিডনিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটিই ছিল একসঙ্গে তাদের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
কুমার সাঙ্গাকারা এমনি একজন ক্রিকেটার যাকে সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায়না। একজন নির্ভরশীল ব্যাটসম্যান, দায়িত্ববান কাপ্তান, যোগ্য উইকেট রক্ষক; হাতে গোনা কয়েকজন গ্রেটদের মধ্যে তিনি একজন যারা টেস্ট এবং ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটে ১০ হাজার রান করেছেন।
১৫ বছরের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ১৩৪ টি। ২৩৩ ইনিংসে রান করেছেন ১২৪০০। সর্বোচ্চ ৩১৯, গড় ৫৭.১৪। টেস্টে তার ডাবল সেঞ্চুরি ১১ টি, ৩৮ টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি হাফসেঞ্চুরি রয়েছে ৫২ টি।
একদিনের ক্রিকেটে ৪০৪ ম্যাচে ৩৮০ ইনিংসে রান করেছেন ১৪২৩৪। গড় ৪২, সর্বোচ্চ ১৬৯। ওয়ানডেতে স্ট্রাইক রেট ৭৮.৫। একদিনের খেলায় সেঞ্চুরি ২৫ টি আর হাফসেঞ্চুরি ৯৩ টি। উপরের পরিসংখ্যান-ই প্রমাণ করে দলের মিডল অর্ডার কীভাবে সামলেছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে।
জীবনে বেশ কয়েকটা দলের হয়ে খেলেছেন, ব্যাট হাতে ২২ গজে রাজ করেছেন সারা দুনিয়ায়। শ্রীলঙ্কা জাতীয় দল, এশিয়া একাদশ, আইসিসি ওয়ার্ল্ড ইলেভেন, কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব, ল্যাঙ্কাশায়ার, ননডেস্ক্রিপ্ট ক্রিকেট ক্লাব, ডেকান চার্জার্স, কন্দুরতা ওয়ারিয়র্স, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, কান্দুরতা মারুনস, জামাইকা তাল্লাওয়াহস, ডারহাম, সারে কাউন্টি, ওয়ার্ন ওয়ারিয়র্স, ঢাকা ডায়নামাইটস, হোবার্ট হারিকানস, জেমিনি আরবিয়ানস, কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটরস, করাচি কিংস, গ্যালাক্সি গ্ল্যাডিয়েটরস ল্যান্টাউ, মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব, মুলতান সুলতানসস এর হয়ে খেলেছেন।
এতো এতো পাওয়ার মাঝেও না পাওয়ার একটা শিরোপা আক্ষেপ সবসময়ই ছিল সাঙ্গার। ২০০৭, ২০১১ পরপর দুটি ওয়ানডে ফাইনালে হেরে তাদের কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চোকার উপাধি। শেষমেষ বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফাইনালে আবার জায়গা পায় শ্রীলঙ্কা। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য সাঙ্গা বেছে নেন ফাইনাল ম্যাচকেই। এর আগের চার ফাইনাল হারায় এ ম্যাচের আগে বেশ চাপে ছিল শ্রীলঙ্কা। ভারতের দেওয়া ১৩১ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে নেমে ৭৮ রানে ৪ উইকেট হারালে সেই চাপ আরো বেড়ে যায়। তবে এবার আর চাপের মুখে দমে যাননি সাঙ্গাকারা, ঠাণ্ডা মাথায় ৩৫ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলে দলকে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেন তিনি।
ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও জিতে নেন। আর এ ম্যাচের মধ্য দিয়েই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন কুমার সাঙ্গাকারা ও তার সতীর্থ মাহেলা জয়াবর্ধনে।
ব্যক্তিগত জীবনে কুমার সাঙ্গাকারা
ব্যক্তিগত জীবনে যমজ দুই সন্তানের পিতা তিনি। তাঁর স্ত্রীর নাম ইয়াহেলি যিনি কিনা কিশোর বয়স থেকেই ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারার সাথে। চ্যারিটিমূলক কাজের জন্য বিখ্যাত তিনি শ্রীলঙ্কায়।‘থিংক ওয়াইস’ প্রকল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি যার কাজ এইচআইভি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি। ইউনিসেফ এবং আইসিসির মিলিত একটি প্রকল্প এটি
একনজরে কুমার সাঙ্গাকারা সম্পর্কিত কিছু তথ্য
প্রথম জীবনে তিনি পিতার মতো আইনজীবী পেশায় যেতে চেয়েছিলেন।
মাঠের মতো রান্নাঘরেও সমান পারদর্শী কুমার সাঙ্গাকারা।
কুমার সাঙ্গাকারাকে যুক্তরাজ্যে শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মাইথ্রিপাল সিরিসেনা। এই প্রস্তাব সাঙ্গাকরাকে অবাক করে দিয়েছিল, তবে যারা লঙ্কান ক্রিকেটারকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন তারা সম্ভবত এটি প্রত্যাশাই করেছিল। ২০১১ সালের এমসিসি স্পিরিট অফ ক্রিকেট কাউড্রে স্পিচে সাঙ্গাকারা তার স্পষ্টবাদী মতামতের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন যেখানে তিনি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে রাজনৈতিক প্রভাবের সমালোচনা করেছিলেন।
কুমার তার ধারাভাষ্যের ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মাধ্যমে।
টি-২০ ক্রিকেট ইতিহাসে ২য় উইকেটে মাহেলার সাথে সর্বোচ্চ ১৬৬ রানের জুটি তার।
তিনি একমাত্র ব্যাটসম্যান যার দুটি টি-২০ ফাইনালে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড ।
শচীন টেন্ডুল্কারের পর ইতিহাসের ২য় সর্বোচ্চ রান স্কোরার। মোট ২৮৬৮০ রান ক্রিকেটের ৩ ফরম্যাট মিলিয়ে। একমাত্র ক্রিকেটার যিনি এক বিশ্বকাপ আসরে (২০১৫) ৪টি সেঞ্চুরি করেছেন।
এই শতাব্দীতে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় হিসেবে এমসিসি স্পিরিট অফ ক্রিকেট ভাষন দেন।
বর্তমানে তিনি সর্বকনিষ্ঠ এবং ২য় শ্রীলঙ্কান হিসেবে এমসিসি বিশ্ব ক্রিকেট কমিটিতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।
বেশ কিছু দাতব্য সংস্থার সাথে জড়িত তিনি।
জাতিসংঘের এইডস সচেতনতা প্রোগ্রামের সাথে জড়িত
টেস্ট ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ রান স্কোরার (১২৪০০)
ওয়ার্ল্ড কাপে উইকেট রক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল ৫৪ উইকেট ৩৭ ম্যাচে।
পছন্দের ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারা
পছন্দের বোলার মুরালিধরন ও ওয়াসিম আকরাম
কুমার সাঙ্গাকারার প্রাপ্ত এওয়ার্ড
স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি (আইসিসির সেরা ক্রিকেটার): ২০১২।
বর্ষসেরা আইসিসি টেস্ট খেলোয়াড়: ২০১২।
বর্ষসেরা আইসিসি ওয়ানডে খেলোয়াড়: ২০১১, ২০১৩।
বছরের আইসিসি টেস্ট দলে জায়গা: ২008, ২০০৮, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৪।
বছরের আইসিসির ওয়ানডে দলে জায়গা: ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৫।
উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার: ২০১২।
এলজি পিপল চয়েস অ্যাওয়ার্ড: ২০১১, ২০১২।
সিয়েট আন্তর্জাতিক বর্ষসেরা ক্রিকেটার: ২০১৫।
‘অ্যাডা দেড়ান’ শ্রীলঙ্কান এওয়ার্ড: ২০১৬।
ডায়লগ এসএলসি বর্ষসেরা ওয়ানডে ব্যাটসম্যান: ২০১৫।
জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচে ২৪ আগস্ট, ২০১৫ ভারতের বিপক্ষে খেলা শেষে এক আবেগঘন ভাষণ দেন কুমার সাঙ্গাকারা। সাঙ্গাকারা বলেন, “শ্রীলঙ্কার জনগণ এবং শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট অনুরাগীদের সামনে খেলাটা ছিল আমার জীবনের অন্যতম বিশেষ সুযোগ। আমি আপনাদের ভালবাসা এবং সমর্থনের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আমার ইনিংস শেষ। আমি আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলব না। তবে আমি আপনার সাথে খেত্তরমামা, গল, তামিল ইউনিয়নে এবং এসএসসিতে তরুণ ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে আসব।”
তথ্যসূত্র : উইকিপেডিয়া, বিবিসি,নিউজভিউস