আর্জেন্টিনা সেরা খেলোয়াড় বলতে সর্ব প্রথম মেরাডোনা কে সবাই চিনেন | এ যুগের আর্জেন্টিনা ফ্যানেরা লিওনেল মেসিকে চেনেন, চেনেন সমকালীন তারকা ডি মারিয়া, আগুয়েরো, হিগুয়েইন, মাশ্চেরানোদেরও। কিন্তু মারিও কেম্পেসকে এই যুগের আর্জেন্টিনা ভক্তরা কতটা চেনেন? আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ককে নিয়েই বাংলা ডায়েরির আজকের আয়োজন।

একটি বিশ্বকাপের আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেবার মতো কঠিনতম বিষয় আর হতে পারে না। তবুও এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন ৫ মহান ফুটবল নায়ক। ১৯৩৮ বিশ্বকাপে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একইসাথে দুটো পুরস্কার অর্জন করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন ব্রাজিলের লিওনিদাস, ১৯৬২ বিশ্বকাপে গারিঞ্চা, ১৯৮২ বিশ্বকাপে পাওলো রসি এবং ১৯৯০ সালে সালভাদর শিলাচি। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ আসরে আরও একজন জিতেছিলেন এই দুটো পুরস্কার। যদিও শুধুমাত্র এই দুটো পুরস্কার নয়, সেবার প্রথমবারের মতো আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিলো তারই দৌলতে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে গোলক্ষুধার আভা, পাতলা ছিপছিপে গড়নের চে গুয়েভারার দেশে জন্ম নেওয়া সেই খেলোয়াড়ের নাম মারিও কেম্পেস।

একজন মারিও কেম্পেস: টালমাটাল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ছবি: Getty Images

মারিও কেম্পেস ১৯৫৪ সালের ২৫ জুলাই আর্জেন্টিনা জন্মগ্রহণ করেন | তাঁর বাবা মারিও, একজন ফুটবলারও তাকে অল্প বয়স থেকেই খেলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসাবে ব্যাপকভাবে বিবেচিত। সাত বছর বয়সে তিনি একটি জুনিয়র দলের সাথে খেলতে শুরু করেছিলেন এবং চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি টালারেস রিজার্ভে যোগ দেন। ক্লাব পর্যায়ে তিনি শ্রেষ্ঠ জন্য খেলার জন্য পরিচিত ভ্যালেন্সিয়া , যেমন শেষ হচ্ছে লা লিগা ‘র সর্বোচ্চ গোলদাতা দুইবার, তিনি আর্জেন্টিনার পক্ষে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলে তিনটি বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন | তিনি ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। ওই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করার পেছনে তার ছিল মুখ্য অবদান ছিল ।

এল ম্যাটাডোর:

অসামান্য গোলস্কোরিং দক্ষতার কারণে কেম্পেসের ডাকনাম হয়ে যায় ‘এল ম্যাটাডোর’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ঘাতক। ক্যারিয়ারজুড়েই নিজের এই ডাকনামের সার্থকতা প্রমাণ করে গেছেন কেম্পেস। আর্জেন্টিনার হয়ে ৪৩ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২০ গোল। দেশের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। প্রথম খেলেছেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপে, কিন্তু দলের পাশাপাশি ব্যর্থ হন কেম্পেস নিজেও, পুরো টুর্নামেন্টে করতে পারেননি একটি গোলও। তবে আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা সুদে আসলে পরের বিশ্বকাপে মিটিয়ে দেন কেম্পেস। আর্জেন্টিনাকে প্রথমবারের মতো এনে দেন বিশ্বকাপের শিরোপা।

একজন মারিও কেম্পেস: টালমাটাল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ছবি: Getty Images

১৯৭৮ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠের টুর্নামেন্টে গোল করেছিলেন মাত্র ৩ টি ম্যাচে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, ইতালির বিপক্ষে ৩ ম্যাচের কোনটিতেই গোল পাননি। এরপর কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি কেম্পেসকে জোর করে শেভ করান। কাকতালীয় হলেও সত্য, এরপরের সবকয়টি ম্যাচেই গোল পেয়েছিলেন কেম্পেস! টুর্নামেন্টে মোট গোল করেছিলেন ৬ টি, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে করেছিলেন দুইটি গোল, যা আর্জেন্টিনাকে এনে দেয় নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা।অথচ ওই বিশ্বকাপে নাও খেলতে পারতেন কেম্পেস! ঘরের মাঠের বিশ্বকাপের জন্য শুধু আর্জেন্টিনার লীগে খেলা খেলোয়াড়দেরই বিবেচনা করেছিলেন কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন কেম্পেস। আসলে কোচ মেনোত্তিকে বাধ্য করেছিলেন কেম্পেস তাঁকে দলে নিতে, ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে দুর্দান্ত গোলস্কোরিং ফর্ম দেখিয়ে। ১৯৭৬-৭৭ ও ১৯৭৭-৭৮, টানা দুই মৌসুমে জিতেছিলেন পিচিচি ট্রফি (লা লীগায় সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার)। নিজের প্রথম মৌসুমেই করেছিলেন ২৪ গোল, পরের মৌসুমে আরও চারটি বেশি, করলেন ২৮ গোল। কেম্পেসকে দলে রাখার যৌক্তিকতা বোঝাতে গিয়ে মেনোত্তি বলেছিলেন, ‘ও দারুণ শক্তিশালী। ওর স্কিল আছে, স্পেস ক্রিয়েট করতে পারে, ভীষণ জোরে শুট করে। ও এমন একজন যে দুই দলের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। এবং ও সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতে পারে।’

মারিও কেম্পেস
ছবি: Getty Images

শুরুর দিকে নিষ্প্রভ কেম্পেস:

তবে কেম্পেসের জন্য চ্যালেঞ্জও ছিল। দলের বাকিরা যেখানে ফেব্রুয়ারি থেকেই একসাথে অনুশীলন করছেন, কেম্পেস সেখানে জাতীয় দলের সাথে যোগ দেন মে মাসে। এক বছর পরে ফিফার সাথে এক সাক্ষাৎকারে কেম্পেস জানিয়েছিলেন, দলের বাকিরা তাঁকে এমনভাবে বরণ করে নিয়েছিলেন, যেন তিনি তিন মাস আগে থেকেই দলের সাথে অনুশীলন করছেন। পুরো দলের একাত্মা হয়ে থাকাটাকেই ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করেন বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। পুরো অনুশীলন পর্বের সময় বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল গোটা আর্জেন্টিনা দল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেই নিজেদের কষ্ট সার্থক করেছিলেন তারা।

একজন মারিও কেম্পেস: টালমাটাল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ছবি: Getty Images

গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কেম্পেস গোলের মুখ না দেখায় ইতালির পেছনে থেকে গ্রুপে দ্বিতীয় হতে হয় আর্জেন্টিনাকে। যার ফলে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল, পোল্যান্ড ও ওই বিশ্বকাপের সারপ্রাইজ প্যাকেজ পেরুর মুখোমুখি হতে হয় স্বাগতিকদের।

কেম্পেসের ‘হ্যান্ডবল’:

পোল্যান্ডের বিপক্ষে আক্রমণ ও রক্ষণ দুইদিকের দারুণ ভূমিকা রাখেন কেম্পেস। ম্যাচের শুরুর দিকেই হেডে গোল করে টুর্নামেন্টে নিজের গোলখরা কাটান তিনি। আর হাফ টাইমের আগে আগে পোল্যান্ডের একটি নিশ্চিত গোল গোললাইন থেকে হ্যান্ডবল খেলোয়াড়ের মতো বাঁচিয়ে দেন তিনি। তবুও অবশ্য লাল কার্ড দেখেননি তিনি, পেনাল্টি থেকেও গোল করতে পারেনি পোল্যান্ড। পরে দ্বিতীয়ার্ধে আরেকটি গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন কেম্পেস।

একজন মারিও কেম্পেস: টালমাটাল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ছবি: Getty Images

ভাগ্যকেও পাশে পেয়েছিল আলবিসেলেস্তারা। ব্রাজিলের সাথে ড্র্ করার পর ফাইনালে উঠতে পেরুকে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে হারাতেই হতো আর্জেন্টিনাকে। বাঁচা-মরার ম্যাচে আবারও জোড়া গোল করলেন কেম্পেস, আর্জেন্টিনাও পেরুকে হারালো ৬-০ গোলে।

ফাইনালের নায়ক:

২৫ জুন ফাইনালে এস্তাদিও মনুমেন্টালে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হলো আর্জেন্টিনা। চার বছর আগে এই ডাচদের কাছেই ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া আর্জেন্টাইনদের ঘরের মাঠের দর্শকদের সামনে অনুপ্রেরণার অভাব ছিল না। ক্রুইফবিহীন নেদারল্যান্ডসও তখন যথেষ্ট শক্তিশালী, তবুও প্রথমার্ধে এগিয়ে গেলো আর্জেন্টিনাই। এবারো গোলদাতার নাম কেম্পেস, টুর্নামেন্টে নিজের পঞ্চম গোল করলেন মাতিয়ে তুললেন গোটা বুয়েন্স আয়ার্সকে।দ্বিতীয়ার্ধে খেলায় সমতা আনে ডাচরা, গোল করেন ডিক নানিঙ্গা। জয়সূচক গোলটাও প্রায় করেই ফেলেছিলেন রব রেনসেনব্রিঙ্ক। খেলা যখন অতিরিক্ত সময়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, তখনই আবারও দৃশ্যপটে হাজির কেম্পেস। পাকা শিকারির মতো দুর্দান্ত দক্ষতায় আদায় করে নিলেন নিজের ও দলের দ্বিতীয় গোল, বুয়েন্স আয়ার্সে তখন শিরোপা জয়ের আগাম উদযাপন শুরু হয়ে গেছে।

একজন মারিও কেম্পেস: টালমাটাল আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক
ছবি: Getty Images

নিজের সেই গোলের স্মৃতিচারণ করেছিলেন কেম্পেস, ‘দুইজন ডিফেন্ডারকে ড্রিবলিং করে আগাচ্ছিলাম, গোলকিপার আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো। আমি শুট করলাম, কিন্তু বল গোলকিপারের গায়ে লেগে বাউন্স করলো। বলটা দ্রুত নিচে নেমে আসছিল। আমি দৌড় অব্যাহত রাখি, এবং শেষ পর্যন্ত দুইজন ডাচ ডিফেন্ডার চলে আসার ঠিক আগে বুটের সোল দিয়ে বল জালে ঠেলে দেই। এটা আমার সবচেয়ে সুন্দরতম গোল ছিল না ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে রোমাঞ্চকর গোল অবশ্যই ছিল।’

মারিও কেম্পেস
ছবি: roar.media

পরে ড্যানিয়েল বার্তোনি আরও এক গোল করলে ৩-১ গোলের জয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। কেম্পেসও আর্জেন্টিনায় জাতীয় বীরের সম্মান পেয়ে যান।নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক, অথচ আর্জেন্টাইনরা যেন কেম্পেসকে ভুলেই গেছে! ফিফার কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেম্পেসের উত্তরসূরি ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘একজন খেলোয়াড় এবং মানুষ, দুই দিক থেকেই মারিও আমার কাছে একজন ফেনোমেনন। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে উনি যা করেছেন, তার জন্য আমরা সবাই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা তাঁর প্রতি সেই কৃতজ্ঞতা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারিনি। বিশ্বকাপজয়ী দলের হৃদপিণ্ড ছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনায় তাঁর নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি সম্মান প্রাপ্য।’

সূত্র: উইকিপিডিয়া, প্রিয়লেখা

Related posts

সিদ্দিকুর রহমান : বলবয় থেকে দেশ সেরা গলফার

News Desk

মানবতাবাদী এক পদার্থবিজ্ঞানী লিসা মাইটনার

News Desk

‘মমতাজউদদীন আহমদ নাট্যজন পুরস্কার’ পাচ্ছেন মামুনুর রশীদ

News Desk

Leave a Comment