নিঝুম রাত তবে নিস্তব্ধ নয়। পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে ভুঁড়ি ভোজ চলছে, গ্রামেরই কোন গরীব কৃষকের খাসী ধরে এনে হয়তো জবাই করা হয়েছিল ঐ দিনে। হৈ-হুল্লোড় করে খাওয়ায় ব্যস্ত পাকসেনাদের কোন ধারণাই নেই কিছু দূরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে এক গেরিলা দল, নেতৃত্বে আজম খান।
কষ্ট ও হাহাকার মাখানো এই গানের পেছনে যে বলিষ্ঠ মনোবল আর দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের মানুষ রয়েছেন, তিনি হলেন আমাদের ‘গুরু’ আজম খান। ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল, তখন যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার চলছিল চারদিকে। না পাওয়ার বেদনা স্বাধীনতার উল্লাসকে আড়াল করে ফেলেছে। এই সময় আজম খান গাইলেন এই হতাশার গান। হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিক। এ যেন এক নতুন জাগরণ। হাজার মানুষের মনের কথা যেন ফুটে উঠছে তার কণ্ঠে। শুরু হলো বাংলায় পপ গানের বিস্তার।
মায়াময় দৃষ্টির প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন না বলা এক একটি কবিতা। কাব্যের হাত ধরে সুরের বর্ণ পরিচয়। বন্দুক ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। পিতৃআজ্ঞা পালন করে দেশকে মুক্ত করতে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অধ্যায়ও কবেই চুকেবুকে গেছে। হাতের ‘গান’ ফেলে দিলেও কণ্ঠের গানতো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। হয়ে গেলেন যোদ্ধা থেকে গানের বোদ্ধা। রণাঙ্গন ছেড়ে একেবারে সঙ্গীতাঙ্গনে। সেই থেকে কোটি মানুষের অন্তরে মিশে যাওয়া এক নাম, আজম খান। যে নাম কখনও মোছার নয়, কারণ তিনি যে গুরু। গুরুদের কখনো আমরা হারাইনি, হারাতে পারি না।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
২৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ সালে ঢাকার আজিমপুরের ১০ নম্বর কলোনীতে জন্ম মাহবুবুল হক ‘আজম’ খানের। তাঁর বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন। বাবা ১৯৫৬ সালে কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করলে আজিমপুর থেকে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তারা। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা বাবা, মা এবং চার ভাই ও এক বোনের সাথে। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন।
তাঁর বাবা আফতাবউদ্দিন আহমেদ ১৯৫৬ সালে কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করলে আজিমপুর থেকে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তাঁরা।
শিক্ষাজীবন:
আজম খান পড়াশোনা শুরু করেন ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। এরপর কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন তিনি। সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ শুরু হওয়ায় আর পড়ালেখায় অগ্রসর হতে পারেননি।
ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ সালে ঢাকার আজিমপুরের ১০ নম্বর কলোনীতে জন্ম মাহবুবুল হক ‘আজম’ খানের। তাঁর বাবার নাম আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন। বাবা ১৯৫৬ সালে কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করলে আজিমপুর থেকে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তারা। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা বাবা, মা এবং চার ভাই ও এক বোনের সাথে। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন।
তাঁর বাবা আফতাবউদ্দিন আহমেদ ১৯৫৬ সালে কমলাপুরে বাড়ি নির্মাণ করলে আজিমপুর থেকে নিজ বাড়িতে চলে আসেন তাঁরা।
সময় যখন যুদ্ধে যাওয়ার:
সময়টা তখন ১৯৬৮ সাল। আজম খানের বয়স তখন প্রায় ১৮ বছর। রক্ত টগবগ করা, খুবই সাদামাটা গোছের দেখতে, লিকলিকে তবে দীর্ঘদেহী কিশোর ছিলেন আজম খান। সেই সাথে ছিল তাঁর সেই লম্বা চুলের গোছা! তাঁর চোখ থেকে তখনো কৈশরের সারল্যমাখা চাহনি মুছে যায়নি। তবে তাঁর ভেতর ব্যক্তিত্ব ছিল প্রচুর!
ধীরে ধীরে দেশে শুরু হয় তুমুল সংগ্রাম। তিনিও শামিল হন সেই সংগ্রামে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেন তিনি। সেই সময় তিনি ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’র সক্রিয় সদস্য হিসেবে গণসঙ্গীত প্রচার শুরু করেন। এসব কারণে তিনি আর তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।
মাত্র ২১ বছর বয়সেই যুদ্ধ অংশ নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়তে চান তিনি। মাকে এই নিয়ে বলার পর তাঁর মা বলেন বাবার সাথে কথা বলতে। বাবাকে তিনি প্রচুর ভয় পেতেন।তবুও দুরুদুরু বুকে বাবার কাছে কথাটা বলতেই বাবা তাঁকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিলেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। সাথে এও বলে দিলেন, দেশকে স্বাধীন না করে আসার আগ পর্যন্ত তিনি যেন ঘরে না ঢুকেন।
কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধের সাফল্যের পর তাকে একটা সেকশনের ইন-চার্জ করে ঢাকায় পাঠানো হয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় গেরিলা তাণ্ডবে পুরো পাকিস্তানি বাহিনীর ঘুম উধাও করে দিয়েছিল আজম খানের দল। তার হাত ধরেই এলো ‘অপারেশান তিতাস’। ঢাকা শহরের গ্যাস পাইপলাইন নষ্ট করে দিয়ে বিদেশীদের জানান দেয়া যে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এটাই ছিল এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য। অপারেশনের সময় তার বাম কান আঘাতপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সেসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংঘটিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।
কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেও কখনো গানটাকে ভোলেননি তিনি। সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে সহযোদ্ধাদের কাছে তার গানই ছিল একমাত্র বিনোদন। আজম খানের স্মৃতিকথা উল্লেখ করতে গিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেন,
“২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।”
অবশেষে এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সেতুবন্ধন মনের মতো হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তখনও যেন অপেক্ষা করছিল আরেকটি সংগ্রামের। সেটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও শিল্প সংস্কৃতির শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের সংগ্রাম। দিশাহীন পথের গন্তব্য খোঁজার চেষ্টায় পাশে পেলেন ‘আখন্দ’ ভাতৃদ্বয়কে- হ্যাপি আখন্দ এবং লাকী আখন্দ, গড়ে তুললেন ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। ব্যান্ড স্পন্দনের পর এটি ছিল বাংলা নামে স্বাধীন দেশের দ্বিতীয় ব্যান্ড। গিটারে থাকলেন আজম খানের বন্ধু নিলু আর মনসুর, ড্রামে সাদেক আর নিজে রইলেন প্রধান ভোকাল হিসেবে। ১৯৭২ সালে বিটিভির ডাকে দুটি গান উপস্থাপন করল তাদের ব্যান্ড। একটিতে গাইলেন,
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে
এতো সুন্দর দুনিয়ায়
কিছুই রবে না গো
হে আল্লাহ, হে আল্লাহ রে।
আরেকটি গান ছিল, ‘চার কালেমা সাক্ষী দেব’। মরমী ধারার এই গান দুটি মানুষের অন্তরের গভীরে নতুন এক আবেগের সঞ্চার ঘটায়, যা আজম খানকে কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে দেয়।
১৯৭৪-১৯৭৫ সাল, যুদ্ধ পরবর্তী হাহাকার চলছে চারদিকে। না পাওয়ার বেদনা স্বাধীনতার উল্লাসকে অনেক পেছনে ফেলে রেখে এসেছে। এই সময় আজম খান গাইলেন এক হতাশার গান,
রেললাইনের ঐ বস্তিতে
জন্মেছিল একটি ছেলে
মা তার কাঁদে
ছেলেটি মরে গেছে।
হায়রে হায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ
হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিক। এ যেন এক নতুন জাগরণ। হাজার মানুষের মনের কথা যেন ফুটে উঠছে তার কণ্ঠে। শুরু হলো বাংলায় পপ গানের বিস্তার। তারই হাত ধরে ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের গানের জগতে আসা। ধীরে ধীরে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে পপ সম্রাট হয়ে উঠলেন সঙ্গীতের মহাগুরু আজম খান।
অপারেশন তিতাস :
২১ বছরের টকবটে তরুণ আজম খান পায়ে হেঁটে আগরতলায় যান। আগরতলার পথে তার সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা।
সেখান থেকে তিনি যান ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। সেখান থেকে তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে কুমিল্লার সালদায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন আজম খান। কুমিল্লার সালদায় ছিল তার প্রথম যুদ্ধ। যুদ্ধ সফল ভাবে সম্পন্ন হলে তিনি ফিরে যান আগরতলায়।
প্রথম সম্মুখযুদ্ধে তাঁর বীরত্বের কারণে আগরতলা থেকে ঢাকার গেরিলাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়। তিনি ২ নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইন-চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানকার সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ছিলেন কর্ণেল খালেদ মোশাররফ। আজম খান ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন।
আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি- গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত ঢাকার ‘অপারেশান তিতাস’। সেখানে কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল), হোটেল পূর্বাণী ইত্যাদির গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য ছিল, হোটেলে অবস্থানরত বিদেশীরা যাতে বুঝতে পারে, যে দেশে যুদ্ধ চলছে। এই অপারেশনে তিনি বাম কানে আঘাত পান। পরবর্তীতে এই আঘাত তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়।
আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংগঠিত যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করেন।
যুদ্ধ ও গান:
আজম খানের গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাতো। যুদ্ধক্ষেত্রেও কখনো তাঁর গানটাকে ও গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসাকে ভোলেননি তিনি। সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতেও সহযোদ্ধাদের কাছে তাঁর গানই ছিল একমাত্র বিনোদন। এই বিষয়টা চোখে এড়ায়নি শহীদ জননী জাহানারা ইমামেরও।
আজম খানের স্মৃতিকথা উল্লেখ করতে গিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেন,
“২০শে আগস্ট, ১৯৭১ একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর: হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ- বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।”
তার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। জন্মেছিলেন ঢাকার আজিমপুরে দশ নাম্বার কোয়ার্টারে, ১৯৫০ সালে। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন। তার ছিল তিন ভাই ও এক বোন।
পড়ালেখা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পড়ালেখা আর এগোয়নি তার।
তার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। জন্মেছিলেন ঢাকার আজিমপুরে দশ নাম্বার কোয়ার্টারে, ১৯৫০ সালে। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন। তার ছিল তিন ভাই ও এক বোন।
পড়ালেখা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পড়ালেখা আর এগোয়নি তার।
বিবাহ ও একাকিত্ব:
বিয়ে করেন ১৯৮১ সালে ঢাকার মাদারটেকের সাহেদা বেগমকে। তাদের ঘরে আসে এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। সহধর্মিণী মারা যাবার পর থেকে অনেকটা নিভৃতে অনাড়ম্বর একাকি জীবন যাপন করে গেছেন আজম খান। একটা সময় গান থেকেও অনেক দূরে সরে যান। সুরের বাণিজ্যিকরণে নিজেকে কখনো বিকোতে চাননি তিনি।
নাটক, বিজ্ঞাপন ও ক্রিকেট:
১৯৮২ সালে ‘এক যুগ’ নামের এ্যালবাম দিয়ে অডিও জগতে আত্মপ্রকাশ করেন আজম খান। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে মোট ১৭টি একক এ্যালবাম করেন। তার উল্লেখযোগ্য এ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে দিদি মা, বাংলাদেশ, কেউ নাই আমার, অনামিকা, কিছু চাওয়া, নীল নয়না ইত্যাদি।
আজম খানের মঞ্চে বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনা, গান গাওয়ার আকর্ষণীয় ভঙ্গি এখনও আমরা ভুলতে পারি না। সঙ্গীত ছাড়াও মিডিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন জগতে তিনি পদার্পণ করেন ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। পরবর্তিতে বাংলালিংক ও কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন তিনি।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
তাঁর বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন, যার মধ্যে হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে ‘বেস্ট পপ সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড’, ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বটল’ সহ ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’, ‘একুশে পদক’ অন্যতম।
মৃত্যু:
২০১০ সালে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন আজম খান। এজন্য দুবার তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়েও চিকিৎসা করানো হয়। অসাধারণ প্রতিভা ও দৃপ্ত কণ্ঠের এক সংগীত জাদুকরের জীবন থেমে যায় ৬১ বছর বয়সে। দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন রোববার সকাল ১০টা বেজে ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গানের জগতকে শূন্য করে এবং অসংখ্য ভক্তকূলের চোখের পানি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই পপ তারকা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আজম খান হলেন আমাদের অন্যতম ক্ষণজন্মা এক বীর। একরকম অভিমান করেই আমাদের কাছ থেকে তিনি চলে গেলেন দূরে, বহু দূরে। মহাগুরুর স্মরণে তাঁর গাওয়া একটি গান বারবার মনে বাজে অসংখ্য ভক্তের,
“হারিয়ে গেছে খুঁজে পাবো না।
এতো দিনের আশা হল নিরাশা।
যদি জানিতাম তবে আর মিছে মরিতাম না।।
ভালোবাসা, শুধু মিছে আশা।
এ জীবনে তারে আর ফিরে পাব না।।”