Image default
বাংলাদেশ

হারিয়ে যাচ্ছে ‘নয়া দামানের’শাইল ধান

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার প্রবীণ কৃষক বেনু দাস। একসময় নানা সুগন্ধি ধানের চাষ করতেন তিনি। এখন আর সেসব করেন না। স্মৃতি রোমন্থন করে বেনু দাস বলেন, আগে এই অঞ্চলে প্রচুর সুগন্ধি ধানের চাষ হতো। শাইল ধান তার মধ্যে অন্যতম। আমিও চাষ করতাম। এই ধানের চাল সুগন্ধি ও খেতে সুস্বাদু। শাইল ধানের চাল দিয়ে বিভিন্ন জাতের পিঠা, চিড়া ও মিষ্টান্ন তৈরি হতো। প্রবীণ এই কৃষক বলেন, এখন আর শাইল ধান বা এরকম পুরনো জাতের ধান খুব একটা চাষ হয় না। এখন সবাই হাইব্রিড জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানে ঝুঁকেছে। কম সময়ে অধিক ফলন পাওয়া যায় বলে হাইব্রিজ জাতের ধান চাষে সবাই ঝুঁকেছে বলে মন্তব্য তাঁর। সাম্প্রতিক সময়ে একটা গান সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। সিলেট অঞ্চলের একটি বিয়ের গান এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও গীত হচ্ছে। গানের কথাগুলো এমন- ‘আইলারে নয়া দামান আসমানের তেরা/ বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেরা।।/ দামান বও, দামান বও।

প্রায় অর্ধশতাব্দি প্রচীন এই লোকগান হঠাৎ করে তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে এখন পুণরুজ্জীবন পেলেও হারিয়ে যাচ্ছে গানে উল্লেখিত ‘শাইল ধান’। অথচ এই গানের মতো শাইল ধানও একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো এই অঞ্চলে। সিলেট বিভাগ হাওর বেষ্টিত অঞ্চল। বিভাগের চার জেলায়ই রয়েছে হাওর। হাওরের প্রধান শস্য বোরো ধান। তবে অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিতে আউশ এবং আমনেরও আবাদ হয়। স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, শাইল ধানের স্থানীয় পর্যায়ের একটি জাত। যা রোপা আমন মৌসুমে, সাধারণত অগ্রায়ণ মাসে চাষ হয়। আবার শাইল ধানের মধ্যেও কয়েকটি জাত রয়েছে। যেমন ইন্দ্রশাইল, কাকশাইল, ময়না শাইল, কামিনীশাইল, মোটাশাইল, কার্তিক শাইল প্রভৃতি। জাতভেদে স্বাদ ও গন্ধে রয়েছে তারতম্য। শাইল ধানকে অনেকে শালি ধানও বলে থাকেন।

তাদের প্রায় প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, সিলেট অঞ্চলে একসময় প্রচুর পরিমাণে শাইল ধানের চাষ হতো। তবে বর্তমানে উচ্চফলনশীল জাতের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের এই ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো। ধানের মতো সিলেট অঞ্চলের গানেরও খ্যাতি রয়েছে। এই অঞ্চলের অসংখ্য বাউল-বৈষ্ণব সাধক, লোককবি, শিল্পী সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গান ও সংস্কৃতিকে। তাদের গানে উঠে এসেছে এই অঞ্চলের ফসল, প্রকৃতি ও জীবনচারণ। স্বভাবতই উঠে এসেছে এই অঞ্চলের ধানের কথাও। হবিগঞ্জে জন্ম নেওয়া গণসংঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘উজান গাঙ বাইয়া’তে লিখেছেন- ‘অঘ্রাণে আমাদের দেশ ভারী সুন্দর হয়ে ওঠে। ধানের দেশে বাড়ি আমাদের। ধানের গন্ধে বড় হয়েছি। এই ধানই আমায় গান দিয়েছে। এই গানই কৃষক আন্দোলনকে আরও স্ফূরিত করেছিল।

তিনি লিখেছেন- ‘শাইল ধানের মাঠ। আশ্বিন কার্তিক মাসে সড়কের মাথার কাছে ঢেউ দুলিয়ে আছাড় খেয়ে পড়তে ময়না শাইল, কার্তিক শাইল, কালিজিরা, কৃষ্ণচূড়া- কতরকমের ধান। কত বর্ণ, কত গন্ধ। ধানের শীষ টেনে কচি ধানের দুষ বের করে খেতাম। আমাদের দেশে আউশ আর শাইলধানের চাষ হতো খুব। মাঝেমাঝে আখের চাষ হত। ১৯১২ সালে জন্ম নেওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজের এলাকায় শাইল ধানের খুব চাষ হওয়া দেখলেও এখন সিলেট অঞ্চলে এই ধরণের ধান চাষ হয় না বললেই চলে। সৌখিন কোনো কোনো কৃষক সামান্য পরিমানে চাষ করে থাকেন। এসব ধান চাষে কৃষি অফিসেরও কোনো উৎসাহ নেই। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ধানের বৈচিত্র। হারিয়ে যাচ্ছে সুগন্ধি ধান। কেবল গানেই উল্লেখ থাকছে এসব ধানের। বাস্তবে তা মিলছে না।

শাইল সুনামঞ্জ অঞ্চলেই ধান বলে দাবি করেছেন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন। তিনি বলেন, এক সময় ব্যাপকহারে এই ধানের চাষাবাদ হতো। এখন শখের বসে কেউ কেই এর চাষ করে। এই ধান ফলনে দীর্ঘ সময় লাগে এবং ফলন কম হয় তাই কৃষকরা বর্তমান হাইব্রিড ধানের দিকেই ছুটছেন। শাইল ধান সুনামগঞ্জে তেমন হয় না বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফরিদুল হাসান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হবিগঞ্জ কার্যালয়ের উপ পরিচালক তমিজ উদ্দিন ও মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপ পরিচালক কাজী লুৎফুর বারী জানান, এই দুই জেলায় সামান্য পরিমাণে শাইল ধানের আবাদ হয়।

কেনো এখন আগের মতো চাষ হচ্ছে না শাইলসহ সুগন্ধি জাতের এসব ধান- এমন প্রশ্নে সুনামগঞ্জের বাসিন্দা সরকারি চাকরিজীবী দেবল সরকার বলেন, এই ধান দেরিতে পাকে। উৎপাদনে সময় বেশি লাগে। তখন হাওরে বন্যা হলে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া এটার ফলনও হয় কম। তাই আগের মতো চাষ হয় না। এখন আধুনিক জাতের উচ্চফলনশীল ব্রি ২৮, ২৯ ধানের কারণে এই ধানটা আর চাষ হচ্ছে না। একই ধরণের তথ্য জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের উপ পরিচালক সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, শাইল ধান প্রতি বিঘায় ২ থেকে আড়াই মণ হয়। অথচ উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান প্রতি বিঘায় ১০ থেকে ১২ মণ হয়। একারণে শাইলসহ ধানের স্থানীয় পুরনো জাতগুলো চাষে এই কৃষকদের আগ্রহ কম। তবে কেউ কেউ শখে সামান্য পরিমাণে এসব ধান চাষ করে থাকেন। তবে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদন কম হলেও এই ধানের চাল উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এছাড়া সুগন্ধি জাতের চাল বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।

Related posts

যৌতুক না পেয়ে গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

News Desk

চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ

News Desk

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে: তথ্যমন্ত্রী

News Desk

Leave a Comment