হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন ৫৭ বছর বয়সী লাল খাঁন। পাশে তার স্ত্রী রমজীয়া বেগম। অনবরত সেবা করে যাচ্ছেন তাকে। চোখেমুখে যেন তার বিষন্নতার ছাপ। টিভি রোগে আক্রান্ত হয়ে গত সাতদিন ধরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই তার। কৃষি কাজ করে চলাতেন অভাবের সংসার। গত ঈদের মতো এই ঈদও তাকে হাসপাতালে কাটাতে হবে।
অন্যান্য বছরের মতো এবছরের ঈদের আনন্দ তাকে ছুঁয়ে যাবে না। হাসপাতালের বিছানাই হয়তো সুস্থ হওয়ার প্রবল ইচ্ছাটাই তাকে ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও ভুলিয়ে রাখবে। তার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরাটা হবে এবারও পরিবারের কাছে ঈদের আনন্দের মতো।
লাল খাঁন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেরে দুই নম্বর ওয়ার্ডের অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারি বিভাগের ১৮ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার স্ত্রী রমজীয়া বেগম বলেন, তিনমাস আগে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তার স্বামীর টিভি ও জন্ডিস ধরা পড়ে। তারপর তাকে সাভারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে কোন উন্নতি না হওয়ায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসি। অভাবের সংসারে একমাত্র খরচ চালাতেন তিনি। কৃষিকাজ করে যা আয় হত তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলতো। আয় করার মতো আর কেউ নেই পরিবারে। আর এখন সে বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। হাটতেও পারে না।
কথা বলার একপর্যায়ে দু’চোখের পানি গড়িয়ে পরে স্ত্রী রমজীয়া বেগমের। তিনি বলেন, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে বাড়ি তার। কখনও ভাবতে পারিনি এত বড় রোগে আক্রান্ত হবে সে। সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। মেয়েটাকে এখনও বিয়ে দেওয়া হয়নি। ছেলে দিনমজুরের কাজ করে চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাঠায়। চিকিৎসা খরচ চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। গ্রাম থেকে কেউ কেউ সাহায্য করছে। বাইরের খাবার বেশি কিনে খেতে হচ্ছে। এত টাকা কই পাবো। হাসপাতাল থেকে সব ঔষধ দেয় না। বাইরে থেকে অনেক ঔষধ কিনতে হয়। তিনি আরও বলেন, গরীব মানুষের আবার ঈদ আছে নাকি। ঈদের সময়তো হাসপাতালে থাকতে হবে। ঈদ দিয়ে কি করবো। গত ঈদেও স্বামীকে নিয়ে সাভারের একটি হাসপাতালে ছিলাম। আগে স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ঈদের দিন সবার মন খারাপ থাকবে। ছেলেমেয়ে দুইটা বাড়িতে বসে মন খারাপ করবে। কিন্তু কি করার। ওদের বাবার সুস্থতা আগে দরকার। সে সুস্থ হলে ওদের আর ঈদের আনন্দের প্রয়োজন হবে না।
শুধু লাল খাঁন নয়, এ রকম শত শত মানুষের ঈদ কাটবে হাসপাতালের বিছানায়। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসারত রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বেডে ভর্তি সৌরভ ইসলাম (৮)। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে ব্লাড ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জে তাদের বাড়ি। সৌরভের বাবা শিমুল শিকদার বলেন, পাঁচমাস ধরে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আছি। ছেলের প্রথমে কোমড়ে ব্যথা ছিল। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেওয়ায় তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়। ঝালকাঠির একটি হাসপাতালে তাকে কয়েকটি পরীক্ষা করতে বলে। তখন ছেলেন শরীরে কিছুই ধরা পড়েনি। ধীরে ধীরে তার শরীর আরও দূর্বল হতে থাকে। এরপর বরিশাল হাসপাতালে নিয়ে ব্লাডের সঙ্গে অন্যান্য পরীক্ষা করোনো হয়। সেখানে তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরে। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি করা হয়। এখনও পর্যন্ত তার চিকিৎসা চলছে। তিনি আরও জানান, আগে রডের মিলে কাজ করতাম। তিন মাস ধরে কিছু করা হয় না। ছেলের কাছে থাকতে হয় সবসময়। একমাত্র ছেলে আমার। ধার-দেনা করে ছেলের চিকিৎসা চালাচ্ছি। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা ও ছোট ভাইবোন আছে। তাদেরও দেখাশোনা করতে হয়। এখন আয় নেই কোন। ঈদ হাসপাতালেই করতে হবে। আগে ছেলের সুস্থতা দরকার। গত ঈদও কেটেছে এই হাসপাতালে। বাড়িতে সবাই হয়তো মন খারাপ করবে। কিন্তু কি করার আছে। ছেলেটা বসতেও পারেনা। সারাদিন শুয়ে থাকে।
মুস্তাকিম হাসান মাত্র দুই বছর দশ মাস বয়স তার। গত ছয় মাস ধরে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। সে ঢাকা মেডিকেলের ২০৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ১৫ নম্বর বেডে ভর্তি আছে। মুস্তাকিমের মা সাথী আক্তার বলেন, গত ছয় মাস ধরে তার ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা চলছে। ১৫ দিন আগে ছেলের করোনা পজেটিভ ছিল। তখন সে বার্ন ইউনিটে ভর্তি ছিল। গত চারদিন হল করোনা নেগেটিভ আসছে। মুস্তাকিম আমাদের একমাত্র সন্তান। তার বাবা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। গত ঈদেও আমাদের মনে কোন ঈদের আনন্দ ছিল না। বাড়িতেও যারা ছিল তারা কোন ঈদের আনন্দ করেনি। ভেবেছিলাম এই ঈদের আগে ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলে আমরা ঈদ করতে পারবো পরিবারের সবাইকে নিয়ে। কিন্তু ছেলের টেস্টের রিপোর্ট গুলো ভালো আসছে না। ছেলেকে নিয়ে আরও অনেকদিন থাকা লাগবে হাসপাতালে।
জাকির হোসাইন ঢাকা মেডিকেলের সার্জারী বিভাগের ১১ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার বোন ফাতেমা বেগম বলেন, নারায়ণয়গঞ্জে তাদের বাড়ি। তার ভাই বালুর কাজ করতো। মাথায় করে বালু আনার সময় হঠাৎ স্লাব ভেঙ্গে পড়ে যায়। তখন ঘাড়ের রগে আঘাত পায়। এরপর সারা শরীরে প্যারালাইসেসের মতো হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, কাল অপারেশন করার কথা। সংসারে আয় করার মত কেউ নেই। ধারদেনা করে চলছে চিকিৎসার খরচ। একটি ছেলে আছে তার। সে গার্মেন্টস কাজ করে। এই ঈদেও থাকতে হবে হাসপাতালে।