একদিকে জলদস্যু অন্যদিকে মিয়ানমারের গুলি, আতঙ্কে কক্সবাজারের জেলেরা
বাংলাদেশ

একদিকে জলদস্যু অন্যদিকে মিয়ানমারের গুলি, আতঙ্কে কক্সবাজারের জেলেরা

কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়ায় দুই হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে চলে তাদের পরিবার। টানা ৯ মাস ধরে চলা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ জেলের সাগর ও নাফ নদে নামতে পারছেন না। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মাছ ধরা নিয়ে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। তা নিয়েও চিন্তিত পরিবারের সদস্যরা। সর্বশেষ এক জেলে নদীতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। এখন তার পরিবারে চলছে আহাজারি। আতঙ্কে আছেন পাড়ার অন্য জেলেরাও।

কাঁদছে ওসমানের পরিবার

চার দিন পর ফেরার কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন মো. ওসমান (৬০)। মাছ ধরে যা আয় হবে তা দিয়ে দাদনের টাকা পরিশোধের কথা ছিল। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দেওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত বুধবার লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। ৯ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় স্ত্রী হাসিনা বেগম। তাদের ঘরে এক মেয়ে, দুই ছেলেসন্তান রয়েছে। সবার বড় মেয়ে ইসমত আরা ১৩ বছরের। বাবার মৃত্যুতে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সবার ছোট ছেলে তিন বছরের হাম জালাল বাবা না ফেরার কথা বুঝছে পারছে না এখনও। আর ৯ বছরের মেজো ছেলে সৈয়দ আলম অনবরত কাঁদছে।

শাহপরীর দ্বীপের কোনাপাড়ায় পলিথিনে মোড়ানো ঝুপড়ি ঘরে থাকেন হাসিনা বেগম। কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন স্বামী। কিন্তু এখন কী হবে আমাদের। কীভাবে সংসার চলবে? ২০ বছর ধরে সাগরে মাছ ধরে সংসার চলছিল। এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের কেউ নেই।’  

ছেলে সৈয়দ আলম জানায়, সাগরের মাছ ধরতে যাওয়ার আগে নাফ নদের পাড়ে বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। তখন বাইরে ঘোরাফেরা না করে ঘরে যেতে বলেছেন। এখন আর বাবা নেই, কষ্টের শেষ নেই।

এই জেলে পরিবারকে কোনও সহায়তা দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই পরিবারকে অনুদান দেওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি, তারা সরকারি সহায়তা পাবে। পাশাপাশি নাফ নদ-সাগরে এ ধরনের ঘটনারোধে আমাদের সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন।’

সাগরে যাচ্ছেন না জেলেরা 

মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে নিহতের ঘটনায় শাহপরীর দ্বীপের জেলেদের মাঝে ভীতি কাজ করছে। মৃত্যুভয়ে কেউ সাগরে নামছেন না। দ্বীপের জেটি ঘাট, মিস্ত্রিপাড়া ঘাট, দক্ষিণ পাড়া ঘাট ও পশ্চিম পাড়া ঘাটে অনেক নৌকা ও ট্রলার নোঙর করা দেখা গেছে। এসব ঘাটে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০টি মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। ইতিমধ্যে জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় শনিবার দিবাগত রাত থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।

বেড়েছে জলদস্যুতা

জেলেরা জানান, টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের পর গত ১৫ জুলাই থেকে সাগরে ইলিশ ধরা পড়েছিল। বেশ কিছু ট্রলার ইলিশ ধরে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছিল। কিন্তু অক্টোবর মাসের শুরু থেকে সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত বাড়তে থাকে। দস্যুরা ট্রলারের মাছ, জাল, জ্বালানি তেল লুটে করেই থামছে না, জেলেদের গুলি করে ও পিটিয়ে আহত করেছে। প্রাণহানির ভয়ে বহু জেলে মাছ ধরা বন্ধ রাখেন।

২০ ট্রলারে লুটপাট

জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির তথ্যমতে, গত সাত দিনে সাগরে জলদস্যুরা অন্তত ২০টি ট্রলারে লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় ট্রলারের কয়েক কোটি টাকার মাছ, জাল ও জ্বালানি তেল লুট করা হয়। দস্যুদের গুলি ও পিটুনিতে আহত হন অন্তত ৩৪ জেলে। সর্বশেষ ৯ অক্টোবর সাগরে লুটপাটে শিকার হয় দুটো ট্রলার। লুটপাটে বাধা দেওয়া দস্যুদের গুলিতে আহত হন একটি ট্রলারের জেলে জহির আহমদ। তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বাড়ি নোয়াখালী।

ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ জানান, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে সাগরে ডাকাতি করতে গিয়ে ১০ জলদস্যুর মৃত্যু ঘটে। এরপর কয়েক মাস জলদস্যুদের তৎপরতা বন্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইলিশ ধরার মৌসুমে জলদস্যু বাহিনী আবার তৎপর হয়। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলে লুটপাটে জড়ায় চার-পাঁচটি সশস্ত্র দস্যু বাহিনী।

পাঁচ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে

শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাটের জেলে মোহাম্মদ জাকারিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলদস্যুতার পাশাপাশি মিয়ানমার পুলিশ ও নৌবাহিনী প্রায় সময় এখানের জেলেদের ওপর হামলা করে। সর্বশেষ গত বুধবার মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে নিহতের ঘটনায় আমাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সাগর থেকে সব মাছ ধরার ট্রলার ঘাটে ফিরে এসেছে। সবাই মাছ ধরতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ এর আগেও নাফ নদ থেকে পাঁচ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমার বাহিনী। তবে বিজিবির চেষ্টায় তারা ফিরেছেন।’

শাহপরীর দ্বীপ ঘাট ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর গফুর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ঘাটে ২৫-৩০টি মাছ ধরার ট্রলার আছে। অধিকাংশ ট্রলার ঘাটে নোঙর করা আছে। মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে জেলে নিহতের পর অনেক মাঝিমাল্লা সাগরে মাছ শিকারে যাচ্ছেন না। আবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়েও চিন্তিত জেলে পরিবারগুলো। আমরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ। এভাবে হলে আমরা কীভাবে চলবো।’ 

তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে সাগরের জলসীমায় বয়া না থাকায় জোয়ার-ভাটায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানা বুঝতে কষ্ট হয় জেলেদের। অনেক সময় সীমানা না বুঝে মিয়ানমারে ঢুকে পড়েন জেলেরা। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, নাফ নদ ও সাগরে জেলেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সীমানায় বয়া দেওয়া জরুরি।’

  মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে নিহতের ঘটনায় শাহপরীর দ্বীপের জেলেদের মাঝে ভীতি কাজ করছে

জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গণি বলেন, জালিয়াপাড়া ও শাহপরীর দ্বীপের পাঁচ শতাধিক নৌযান কয়েক এক মাস ধরে ঘাটে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। হাজারো জেলে পরিবার অভাব অনটনে অমানবিক জীবনযাপন কাটালেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কোনও সহায়তা পাচ্ছে না।

ওসমানের শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন

গত বুধবার সাগরে শাহপরীর দ্বীপের ছয়টি ট্রলার মাছ ধরতে গেলে মিয়ানমারের নৌবাহিনী গুলি বর্ষণ চালিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ওসমানের মৃত্যু এবং দুই জেলে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকায় মিয়ানমারের দূতাবাসে বিবৃতি পাঠিয়ে গভীর উদ্বেগ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বাংলাদেশের জলসীমার অখণ্ডতার প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানানো হয়।

ওসমান নিহতের ঘটনায় শনিবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের ট্রলার মালিক আলী আহমদের ছেলে বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেছেন। টেকনাফ নৌ-পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক কাশেম বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে ওই জেলের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। কিন্তু বাদী অজ্ঞাতদের নামে মামলা করেন। নিহত জেলের শরীরে, মাথায়, গলায়, কানে ও হাঁটুতে পাঁচটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।’

জেলেদের সতর্ক থাকার পরামর্শ

টেকনাফ কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন জহিরুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরে জেলেদের সুরক্ষার জন্য আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি যাতে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম না করে সেজন্য মাঝিমাল্লা ও আমাদের জেলেদের সতর্ক করা হয়েছে।’

প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল পাবেন

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, ‘গত শনিবার দিবাগত রাত থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে নৌবাহিনী-কোস্টগার্ডের পাশাপাশি মৎস্য বিভাগ অভিযান পরিচালনা করবে। ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সভা করে জেলে ও ট্রলারমালিকদের সচেতন ও সতর্ক করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল পাবেন। জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৯৩। ছোট বড় ছয় হাজার ট্রলারে শ্রমিক রয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইতিমধ্যে গভীর সাগর থেকে ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরে এসেছে। সবগুলো ট্রলার ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আছে।’

Source link

Related posts

অনলাইন পাঠদান নিয়ে অসন্তোষ

News Desk

কক্সবাজারে পানিবন্দি ২ লাখ লাখ মানুষ

News Desk

এক খাল খননে ৯ বছর পার, প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে পাঁচ গুণ  

News Desk

Leave a Comment