মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এর মধ্যেই অর্থনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার। একইসঙ্গে গত আট বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় কক্সবাজারের স্থানীয়রা শঙ্কিত। কারণ দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানের পরিবেশ পরিস্থিতি নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছেন। কারণ তারা মনে করেন, তারা ফেরত গেলে সংকট সমাধান এবং স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাপন সহজ হবে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। ইতিমধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছেন এক লাখ ২১ হাজার। আর অন্যরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই নারী-শিশু। সবমিলিয়ে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। কিন্তু গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এটি বড় উদ্বেগের কারণ।
তহবিলের তীব্র সংকট
রোহিঙ্গা নেতা ও নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয় বাংলাদেশে। এরই মধ্যে অনুপ্রবেশের আট বছর পেরিয়ে গেছে। বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক মনোযোগও হারিয়েছে। কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে কমেছে তাদের জন্য মানবিক সহায়তা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। তাদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলেরও তীব্র সংকট চলছে। এ সুযোগে অনেক রোহিঙ্গা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন।
কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আসার আট বছর পেরিয়ে গেছে। এত বছরে একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমি এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেইসঙ্গে ৩৩টি ক্যাম্পেও বসবাস করছেন। কখন তারা দেশে ফিরবেন তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘ মেয়াদে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ফেরত পাঠানো না গেলে ভবিষ্যতে স্থানীয়দের জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে। প্রত্যাবাসন যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই স্থানীয়দের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। একসময় রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘাত তৈরি হবে।
আতঙ্কিত-উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লাখ লাখ রোহিঙ্গার কারণে দিন দিন অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বোঝা আমরা মাথায় নিয়ে বসে আছি। আমরা স্থানীয়রা কোন অবস্থায় আছি, রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের কথা কেউ ভাবেও না। কারণ রোহিঙ্গারা চাঁদাবাজি, মাদক, খুন, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসন। আমাদের কথা কখন ভাববে। আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হোক।’
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানালেন উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন। তাদের কারণে আমাদের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ, শ্রমবাজার ও নিরাপত্তা ঝঁকিতে পড়ছে। তাদের নানামুখী অপরাধ কর্মকাণ্ড বিশেষ করে অপহরণ ও চাঁদাবাজির কারণে এখানের বাসিন্দাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা। রোহিঙ্গা সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে আমরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যাবো। বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা উচিত।’
আন্তর্জাতিক মনোযোগ হারিয়েছে রোহিঙ্গা সংকট
বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক মনোযোগ হারিয়েছে বলে জানালেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আগামী চার মাসের মধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে। এসব সম্মেলনের আয়োজক জাতিসংঘ, কাতার ও বাংলাদেশ। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়াতে এবং তাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক প্রয়াস জোরদার করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আলোচনার বিষয় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা এবং তাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসন শুরু করা।’
মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি পালনের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চায় তারা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তি চায়। গত আট বছর ধরে তাদের সেবা দিতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি, এনজিও, আইএনজিও ও দাতা সংস্থাগুলোও এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।’
আট বছরে একজনও ফেরত পাঠানো যায়নি
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি তখন। পরে প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়নি। সে সময় নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছিল রোহিঙ্গারা।
ওই সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমারবিষয়ক দূত ইয়াংহি লি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি স্বেচ্ছায় হতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে প্রকল্প নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এ অবস্থায় গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। বরং গত এক বছরে নতুন করে দেড় লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। আরও অনেকে আসছেন এখনও।
চলছে এখনও সংঘাত, কবে ফিরে যাবেন তারা
রোহিঙ্গাদের দাবি, নাগরিকত্ব, জাতিগত পরিচয়, জায়গা-জমি ও গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে তারা মিয়ানমারে গিয়ে আবার নির্যাতনের মুখে পড়বেন। এ ছাড়া বর্তমানে রাখাইনে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান যুদ্ধে সেখানের এমন পরিস্থিতিতে ফিরতে নারাজ অনেক রোহিঙ্গা।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্বাসী বেগম বলেন, ‘রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। আট বছর পার হয়ে গেছে। এখনও রাখাইনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। সেখানে আমাদের বাড়িঘর। বাপ-দাদার কবর। ফেলে আসা ভিটাবাড়ির কী অবস্থা জানি না। দেশে ফেরার জন্য মন কাঁদে। কিন্তু চলমান যুদ্ধে কীভাবে সেখানে ফিরবো আমরা।’
একই ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর আয়েশা বলেন, ‘কত আশা ছিল নিজেদের বাড়িঘরে একদিন ফিরে যেতে পারবো। অথচ আট বছর হয়ে গেলো। পরের দেশে পড়ে আছি। আমাদের নিজ দেশে পাঠানোর কোনও উদ্যোগ নেই। কারও কোনও ভাবনা দেখি না। আমরা সম্মানের সঙ্গে আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই।’
জান্তা সরকারই নিতে চায় না রোহিঙ্গাদের
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা শান্তি চান, নিরাপদে জন্মভূমিতে ফিরতে চান। এখানে কেউ আর থাকতে চান না। দীর্ঘদিন পর হলেও বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি সম্মেলনের ব্যবস্থা করেছেন। অথচ বিদেশে থাকা কিছু বিত্তশালী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কিছু অর্থের লোভে নানাভাবে একটি দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমরা চাই, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কথা বলা হোক।’
একই সংগঠনের সহসভাপতি মোহাম্মদ তৈয়ব বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই টালবাহনা শুরু করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। রাখাইনে আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের বাহিনীর যুদ্ধটিও নাটক। বিশেষ করে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির হয়ে মিয়ানমারের কিছু দালাল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই এসব দালালের তৎপরতা শুরু হয়। এগুলো করা হয়, যাতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো না যায়। জান্তা সরকারই আমাদের ফেরত নিতে চায় না।’