উজানের ঢলে ফুঁসে ওঠা ব্রহ্মপুত্রের দৃষ্টির সীমায় শুধু পানি আর পানি। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার দুপুরে আমাদের নৌকা পৌঁছালো কুড়িগ্রামের চিলমারীর নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার চরে। নৌকার শ্যালো ইঞ্জিনের শব্দে বাড়ির আঙিনার হাঁটুসমান পানি মাড়িয়ে কাছে আসলেন শুকুরজান। ত্রাণ সহায়তার নৌকা ভেবে এগিয়ে আসা শুকুরজান সংবাদকর্মীদের দেখে হতাশ হলেন। শেষে নিজেদের দুর্দশার কথা বললেন।
জানালেন, গত আট দিন ধরে পানিবন্দি জীবন কাটছে তাদের। পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে স্বামী আব্দুর রশিদ নিকটবর্তী হাটে গেছেন বাড়ির পোষা মুরগি বিক্রি করতে। সেই টাকা দিয়ে খাবার কিনে বাড়ি ফিরবেন। শুকুরজান পানিবন্দি ঘরে যখন স্বামীর ফেরার অপেক্ষায়, তখন শিশুরা বন্যার পানিতে সাঁতার কাটছে।
বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে শুকুরজান বলেন, ‘আমগো খুব কষ্ট হইছে। রান্দনের কষ্ট, খাওনের কষ্ট। আইজ আট দিন ধইরা ঘরে পানি। নৌকায় রান্দি, নৌকায় খাই। স্বামীর কামাই নাই। কেউ খোঁজ নিতেও আহে না। একমুঠো সাহায্য পাই নাই।’
শুকুরজান যখন নিজেদের দুর্দশার কথা বলছেন তখন পাশের আরেক পানিবন্দি বসতি থেকে বেরিয়ে এলেন প্রতিবন্ধী নারী মনোয়ারা। জানালেন, স্বামী মাইদুল ও তিনি প্রতিবন্ধী। শুকুরজান-আব্দুর রশিদ দম্পতির মতো তারাও পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।
শুকুরজান ও মনোয়ারা চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের উত্তর খাউরিয়ার নাইয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা। ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপচর এই ইউনিয়নের কয়েকশ পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এক সপ্তাহ ধরে এসব পরিবারের বসতির ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
শুকুরজান ও মনোয়ারার পাশের গ্রাম সুখেরবাতি গোয়াইলবাড়ি। এই গ্রামের রাজ্জাক প্রামাণিক ও রূপবানু দম্পতির বাড়ির ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। নদের পানি রূপবানুর প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে জীবনধারণ কষ্টসাধ্য করে তুলেছে। হাঁস-মুরগির ঘর পানিতে নিমজ্জিত। রান্নাঘরের মাচার ওপর চুলা, থাকার ঘরে বেঞ্চের ওপর সদ্য ফোটা বাচ্চাসহ মুরগি। শুকনো জায়গার অভাবে কয়েকটি ছাগল আশ্রয় নিয়েছে আঙিনায় চালার নিচে মাচার ওপরে। এ যেন ‘সুখের চরে’ জীবন সংসারের করুণ চিত্র।
রূপবানু বলেন, ‘এক সপ্তা থাকি পানি। মানুষটার (স্বামী রাজ্জাক) কাম নাই। বাড়ির কাম করার জন্য মাইনষের কাছত একটু পাট আনচিল। সেগুল বেচতে পাশের জাফরগঞ্জ হাটে গেছে। সেই ট্যাহা দিয়া বাজারঘাট কইরা আনলে খামু।’
রূপবানু-রাজ্জাক দম্পতির মতো কুড়িগ্রামে বন্যায় পানিবন্দি এমন কয়েক হাজার পরিবারে এমন সংকট চলছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই জেলার সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কিছু অংশ, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ, হাতিয়া ও সাহেবের আলগা এবং চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট, চিলমারী, রমনা ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবে বানভাসিদের সংকট পূরণে তা অপ্রতুল।
ফেরার পথে দেখা গেলো স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নৌকায় করে বন্যাদুর্গতদের বাড়ি বাড়ি সরকারি খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, শুক্রবার তার ইউনিয়নে পাঁচ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। শুকুরজান-আব্দুর রশিদ এবং মাইদুল-মনোয়ারা দম্পতির মতো ইউনিয়নের পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে তা বিতরণ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার শুক্রবারের দেওয়া তথ্যমতে, চলমান বন্যায় জেলায় পাঁচ হাজার ২৮০ পরিবারের ২০ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণের জন্য ১৮২ মেট্রিক টন চাল, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে; যা বিতরণ চলমান আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শুক্রবার দিনভর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি স্থিতিশীল থেকে নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে অন্যান্য নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘দুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের।’