সবেদা বা সফেদার আদি নিবাস উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল। বিদেশি ফল হলেও উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে জন্মায় বলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সফেদা স্থানীয় ফলগুলোর মতোই সহজলভ্য। অত্যন্ত মিষ্টি, মাংসল ও নরম ফলটি এদেশে বেশ জনপ্রিয়। সুমিষ্ট এই সফেদার উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু। নতুন এই জাত চাষে কৃষকরা পাবেন সফলতা। পাশাপাশি উচ্চফলনশীল হওয়ায় উৎপাদন বেশি হলে বিদেশেও রফতানি করা যাবে।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, সফেদার গবষণা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এটির সায়নে গামা রেডিয়েশন এবং ইএমএস প্রদান করে irradiate scion-গুলোকে grafting করে রোপণ করা হয়। ফল আসার পর Evaluation-এর পরে দুটি Mutant identify করা হয়। এতে দেখা যায়, Identified Mutant-গুলোর ফল অনেক বড় হয়। চামড়া খুবই পাতলা। শাঁস খুবই রসালো, সুমিষ্ট ও বীজ ছোট। এসব দিক বিবেচনা করে জাতীয় বীজ বোর্ড এটিকে বিনা সফেদা-১ নামে ছাড়পত্র দিয়েছে।
উচ্চফলনশীল ও নাবি জাত
এটিকে উচ্চফলনশীল ও নাবি জাত সফেদা বলে উল্লেখ করেছেন বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু। তিনি বলেন, ‘এই জাতের সফেদার গাছ মাঝারি ও ঝোপালো হয়। ফল আকারে বেশ বড় হয়। সুস্বাদু, সুগন্ধিযুক্ত ও মিষ্টি হয়। ফল পাকার পর তামাটে রঙ ধারণ করে। বীজ আকারে খুব ছোট হয়, গড় ওজন চার গ্রাম। ফলের ওজন ২৫০-৪৫০ গ্রাম হয়। বর্তমানে বাজারে থাকা সফেদার ওজন সর্বোচ্চ ১০০-১৫০ গ্রাম। নতুন জাতে প্রতি ১০০ গ্রামে ভিটামিন-সি-এর পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ মিলিগ্রাম; ট্রাইটেবল অ্যাসিডিটি ০.৯১ শতাংশ। টিএসএস-এর পরিমাণ ২৪-২৮ শতাংশ। খাবারযোগ্য অংশের পরিমাণ ৭৫-৯০ শতাংশ। দেড় বছরের একটি গাছে দুই থেকে পাঁচ কেজি ফল পাওয়া যাবে। যা প্রচলিত জাতের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ। ফলের প্রধান মৌসুম জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এই জাতের ফলন প্রতি হেক্টরে ২৫ থেকে ৪০ টন পাওয়া যাবে। এ ছাড়া এটিতে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে কম বলে প্রমাণ পেয়েছি আমরা।’
চাষ-পদ্ধতি
চাষ-পদ্ধতি সম্পর্কে ড. শামসুল আলম মিঠু বলেন, ‘এই ফসলের জন্য বেলে-দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটি সম্পন্ন পানি সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত জমি ভালো। পাহাড়ি ও সমতল উভয় এলাকায় সফলভাবে চাষ করা যাবে। সফেদা সাধারত উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু পছন্দ করে। জলাবদ্ধতা সহ্যক্ষমতা কম। তবে খরা মৌসুমে দুই-তিনবার সেচ দিয়ে চাষ করা যায়। কলমের চারা মার্চ-সেপ্টেম্বর মাসে রোপণ করলে পরের বছরে সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে ফুল আসে এবং জানুয়ারি-এপ্রিল মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়। পরের বার ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল আসে এবং মে-সেপ্টেম্বর মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়।’
নতুন জাতটি চাষাবাদের আওতায় আনতে বিপুল পরিমাণ চারা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে বলেও জানালেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামসুল আলম মিঠু। তিনি বলেন, ‘জাতটি কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা যাবে।’
বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে সফেদা চাষাবাদ কম হওয়ার কারণে বাজারে পর্যন্ত পরিমাণ পাওয়া যায় না। এ ছাড়া অনেক মানুষ এখনও সফেদা ফল খাওয়া তো দূরের কথা; এটির নামও জানে না। ফলে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের আওতায় এনে বিপুল পরিমাণ সফেদা উৎপাদনের জন্য দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে ফলটির উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে সফলতা অসবে।’
উৎপাদন বেশি হবে
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সফেদা বাজারে পর্যাপ্ত বিক্রি হলে বিভিন্ন পুষ্টির অভাব দূর হবে। নতুন জাত উচ্চফলনশীল হওয়ায় উৎপাদন বেশি হলে বাজারে ফলটির দাম কমে যাবে। কৃষকরাও বাণিজ্যিকভাবে নতুন জাতটি চাষাবাদ করলে লাভবান হবেন। কারণ উৎপাদন বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই লাভ বেশি হবে।’
সফেদার পুষ্টিগুণ
অন্য ফলগুলোর তুলনায় এর পুষ্টিগুণ কম নয়। এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ট্যানিনের মতো উপকারী উপাদান। বর্তমানে বাজারে থাকা ১০০ গ্রাম সফেদায় আছে ৮৩ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, পাঁচ দশমিক ছয় গ্রাম আঁশ, ১৯৩ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ১৯ দশমিক ৯ গ্রাম চিনি, ২১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ১২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, শূন্য দশমিক ৮০ মিলিগ্রাম লোহা, ১২ মিলিগ্রাম ফসফরাস ও শূন্য দশমিক ১০ মিলিগ্রাম জিংক। এ ছাড়া এতে ফোলেট, পাইরিডক্সিন, থায়ামিন, রিবোফ্লোবিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি আছে। নতুন জাতে এগুলোর পরিমাণ আরও বেশি আছে বলে জানালেন বিনার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা।
সফেদার উপকারিতা
সফেদায় প্রচুর পরিমাণ পলিফেনলস যৌগ ট্যানিন থাকার কারণে শরীরে প্রদাহ প্রতিরোধ করে এবং জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকায়। সফেদা ট্যানিনের পরিমাণ আঙুর বা ডালিমের মতোই। এর আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। গ্যাস্ট্রিক ও বুক জ্বালাপোড়া কমায়। অন্ত্রের ক্যানসার সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর রাসায়নিক তৈরিতে বাধা দেয়। এভাবে ক্যানসার প্রতিরোধ করে। এতে থাকা প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, লোহা ও ফসফরাস, যা হাড়ের গঠন মজবুত করে। ত্বক ও চোখ ভালো রাখে। এ ছাড়া মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে। কফ বসে যাওয়া এবং কাশি থেকে উপশম করতে সাহায্য করে। শ্বাসকষ্ট দূর করে এবং ফুসফুস ভালো রাখে। আধা পাকা সফেদা পানিতে ফুটিয়ে কষ বের করে খেলে ডায়রিয়া ভালো হয়। ওজন কমাতেও সাহায্য করে। নিয়মিত খেলে স্থূলতাজনিত সমস্যার সমাধান হয়। এতে আরও আছে প্রচুর পরিমাণ গ্লুকোজ, যা শরীরে শক্তি জোগায়।