৩০ বছর পর বাড়ি ফিরলেন নিখোঁজ গৃহবধূ, স্বজনরা জানতেন মারা গেছেন
বাংলাদেশ

৩০ বছর পর বাড়ি ফিরলেন নিখোঁজ গৃহবধূ, স্বজনরা জানতেন মারা গেছেন

নিখোঁজ হওয়ার ৩০ বছর পর বাড়ি ফিরেছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সুবিধপুর গ্রামের গৃহবধূ রেজিয়া খাতুন (৫৫)। এত বছর পরিবার ও গ্রামবাসী জানতেন তিনি মারা গেছেন। হঠাৎ ফিরে আসায় তাকে দেখতে বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।

গত ১০ নভেম্বর মেহেরপুর সদর উপজেলার শোলমারি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে দেশে ফেরেন রেজিয়া। বাড়ি ফিরে তিনি স্বজনদের জানিয়েছেন, স্বামী আজগর আলী ৩০ বছর আগে ভারতের এক পাচারকারীর কাছে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এত বছর তিনি ভারতের জম্মু-কাশ্মিরের বড়গ্রাম বিরু এলাকায় ওই পাচারকারীর কাছে বন্দি ছিলেন। গত তিন মাস ধরে স্বজনরা যোগাযোগ করলে তাকে ছাড়তে রাজি হন ওই পাচারকারী। ১০ নভেম্বর শোলমারি সীমান্ত এলাকায় তাকে রেখে যাওয়া হয়।

এ ঘটনায় গত ১৬ নভেম্বর মেহেরপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। মামলায় স্বামী আজগর আলী ও প্রতিবেশী জয়নাল আবেদীনকে আসামি করা হয়। মামলাটি আমলে নিয়ে সোমবার (২০ নভেম্বর) আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মেহেরপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) একেএম আছাদুজ্জামান।

স্বজনদের কাছে খবর পাঠানোর বর্ণনা দিয়ে রেজিয়া খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন মাস আগে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে আমার পা ভেঙে যায়। তখন কাশ্মিরের বিরু এলাকার ওই পাচারকারী গোপনে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য আমাকে নদীয়া জেলার পন্ডিতপুর গ্রামের এক চিকিৎসকের কাছে পাঠান। চিকিৎসা নিতে এসে মেহেরপুরের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে নিজের বেঁচে থাকার কথা স্বজনদের জানাই। এরপর পরিবারের লোকজন বিভিন্ন মাধ্যমে ওই পাচারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।’

পাচারের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে এই নারী জানান, প্রায় ৩৮ বছর আগে গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় রেজিয়ার। ওই সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়েসন্তান আছে। ছয় বছরের মাথায় বিচ্ছেদ হয় তাদের। এক বছর পর নিজ গ্রামের আজগর আলীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকেন আজগর। একদিন রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পাশের একটি মাঠে মারধর করেন আজগর ও প্রতিবেশী জয়নাল। এতে অজ্ঞান হয়ে যান। ওই অবস্থায় ভারত সীমান্তে নিয়ে পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেন। জ্ঞান ফেরার পর ফারুক হোসেন নামের এক ব্যক্তি রেজিয়াকে জানান, তিনি জম্মু-কাশ্মিরে আছেন। ফারুকের কাছে তাকে বিক্রি করেছেন আজগর ও জয়নাল। এরপর থেকে তাকে সেখানে আটকে রাখেন ফারুক। 

রেজিয়া আরও জানিয়েছেন, তিন মাস আগে নদীয়া জেলার পন্ডিতপুর গ্রামে পায়ের চিকিৎসা নিতে আসেন। সেখানে মেহেরপুরের বাসিন্দা আমিরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে স্বজনদের কাছে বেঁচে থাকার খবর দেন। একইসঙ্গে তার কাছে ফারুকের ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেন। তখন দেশে ফিরে রেজিয়ার স্বজনদের খবর দেন আমিরুল। খবর পেয়ে রেজিয়ার বড় ভাই ও পরিবারের সদস্যরা ফারুকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেন। একাধিকবার অনুরোধের পর ফেরত পাঠাতে রাজি হন ফারুক। ১০ নভেম্বর শোলমারি সীমান্ত এলাকায় তাকে রেখে যাওয়া হয়। ওই দিন সীমান্ত এলাকা দিয়ে গোপনে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন স্বজনরা।

৩০টি বছর বহু কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছি জানিয়ে রেজিয়া খাতুন বলেন, ‘কষ্টের কোনও শেষ ছিল না। আমার ছেলেমেয়ে আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। এরই মধ্যে মা-বাবা মারা গেছেন, শেষবারের মতো তাদের মুখটা পর্যন্ত দেখতে পাইনি। আমাকে পাচারের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।’

রেজিয়ার স্বজনদের কাছে খবর পাঠানো আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক মাস আগে নদীয়া জেলার পন্ডিতপুর গ্রামে আমার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাই। তখন স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে রেজিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। ঘটনার বিস্তারিত শুনে মেহেরপুরে এসে রেজিয়ার ভাইকে খবর দিই। একইসঙ্গে রেজিয়ার দেওয়া মোবাইল নম্বর ও কাশ্মিরের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বলেছি। পরে ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন স্বজনরা।’

রেজিয়ার বড় ভাই আনারুল ইসলাম বলেন, ‘৩০ বছর আগে আজগর আলী আমার বোনকে পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এতদিন জানতাম মারা গেছে। তিন মাস আগে আমিরুলের মাধ্যমে জানতে পারি বোন বেঁচে আছে। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে পাচারকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। অসুস্থ থাকায় গত কয়েক দিন চিকিৎসা করিয়েছি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আদালতে মামলা করেছে রেজিয়া।’

কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছে রেজিয়ার বড় মেয়ে সালেহা খাতুনের। মায়ের ফিরে আসার খবর তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এতে দারুণ খুশি। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর-স্নেহ বঞ্চিত হয়েছিলাম। সবাই বলেছিল মা মারা গেছে। কিন্তু আমার মন বলছিল একদিন মা ফিরে আসবে। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া, ৩০ বছর পর মাকে ফিরে পেলাম। এজন্য আনন্দিত। এত বছর মায়ের কাছ থেকে যারা আমাকে দূরে রেখেছিল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে কোনও সন্তান এভাবে মা-হারা না হয়।’

পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আজগর আলী বলেন, ‘বিয়ের এক বছর পরই রেজিয়ার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। পরে শুনেছিলাম মারা গেছে। এখন আমার বিরুদ্ধে পাচারের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটি ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে আমার।’ 

অভিযুক্ত প্রতিবেশী জয়নাল আবেদীন

অভিযুক্ত জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘রেজিয়াকে মারধরের ঘটনায় আমি জড়িত ছিলাম না। এমনকি পাচারের বিষয়েও কিছু জানি না। এত বছর পর দেশে ফিরে কেন আমাকে অভিযুক্ত করছে, তাও বলতে পারছি না।’

কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এতদিন আমরা জানতাম রেজিয়া মারা গেছেন। ৩০ বছর পর জানতে পারলাম বেঁচে আছেন এবং বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়ি ফেরার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের মানুষ তাকে দেখতে ভিড় করছেন। ওই গৃহবধূ জানিয়েছেন, স্বামী ও প্রতিবেশী জয়নাল তাকে ভারতে পাচার করে দিয়েছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করে আমরা পুলিশে সোপর্দ করবো। সেইসঙ্গে ওই নারীকে সহযোগিতা করবো।’

মেহেরপুর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী একেএম আছাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানবপাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। আমরা ভুক্তভোগীকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেবো।’

Source link

Related posts

ঈদের আগে লকডাউন শিথিল

News Desk

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ভাইভা পরীক্ষা হবে অনলাইনে

News Desk

জলোৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে বৈসাবি উৎসব

News Desk

Leave a Comment